ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভাষা আন্দোলনের অমর গান বরিশালেই রচিত

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভাষা আন্দোলনের অমর গান বরিশালেই রচিত

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে যেমন বরিশালবাসী সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন তেমনি ভাষা আন্দোলনের গানেও বরিশালের ভূমিকা ছিল অন্যতম। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ বিখ্যাত এ গানের গীতিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং সুরকার আলতাফ মাহমুদ দু’জনই বরিশালের কৃতি সন্তান। এছাড়া সেই বিখ্যাত গান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’ কিংবা ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়, ওরা কথায় কথায় শিকল পড়ায় আমার হাতে পায়....’ সাড়াজাগানো গানের গীতিকার ও সুরকার বরিশালের আরেক সঙ্গীতসাধক আব্দুল লতিফ। এদের গণসংগীতই পরবর্তীতে সাধারণ মানুষকে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। বরিশালের চারণকবি মুকুন্দ দাসের গান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছিল। মুকুন্দ দাসের গান শুনে মানুষ বিদেশী পণ্য বর্জন করেছিলেন। ব্রিটিশরা বিভেদ সৃষ্টির জন্য কূটচাল হিসেবে হিন্দুদের জন্য ভারত ও মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন করে। শুরু থেকেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শোষণ করতে থাকে বাঙালীদের। যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করা হয়, তখন গর্জে ওঠে বাংলার ছাত্র-জনতা। উন্মেষ ঘটে বাঙালী জাতীয়তাবাদের। তারা বুঝতে পারে প্রকৃতি বাঙালীদের একই আকৃতির ছাপে, একই ভাষা দিয়ে সৃষ্টি করেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। শহীদের স্মরণে বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া গ্রামের কৃতী সন্তান আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী গান লিখেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রথমে গানটির সুর দিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ। তার বাড়িও বরিশালের রায়পাশা কড়াপুর গ্রামে। বর্তমানে আমরা যে সুরে গানটি শুনি বা গেয়ে থাকি তার সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তার সুরটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বরিশালের মুলাদী থানার পাতারচর গ্রামের এএম নেজাম আলীর পুত্র আলতাফ মাহমুদ (ডাকনাম ঝিলু) ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একদিন বরিশাল নগরীর শ্রীনাচ্যাটার্জী লেনের একটি দোতালা টিনের বাড়িতে আসেন। ওই বাড়িটি ছিল প্রগতিশীল সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টির ডেন অর্থাৎ মেস। এখানে চলতো প্রগতিশীল ছাত্র-জনতার সাংস্কৃতিক কর্মকা-। মনের খেয়ালেই তিনি (আলতাফ মাহমুদ) বেহালায় বর্তমান সুরটি তোলেন। এর কিছুদিন পরে সদর রোডের শিল্পী সংসদে বসে (বর্তমান রূপালী ব্যাংকের তৃতীয় তলায়) হারমোনিয়ামে গানটি নতুন সুরে গাইলেন। তখন তবলা বাজিয়ে ছিলেন নারায়ণ সাহা। নতুন সুরে গানটি শুনে উপস্থিত সবাই বিমোহিত হলেন। ওই বছরই ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় ওই শিল্পী সংসদে। তখন মাইক ছিল দুষ্প্রাপ্য। তবুও মাইক জোগাড় করা হল। আলতাফ মাহমুদ তার দেয়া সুরে গাইলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। তার সাথে কোরাস গাইলেন বিএম স্কুলের শিক্ষক চন্দ্রশেখর বাবু, বরুণ বর্মণ, রমিজুল হক চুন্নু, মামুনুর রশিদ ও আলম। ৫৪’তে আলতাফ মাহমুদ বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। এরপরই প্রতিষ্ঠা পায় বর্তমান সুরটি। তা হয়ে ওঠে বাঙালীর আবেগের গান, প্রাণের গান হয়ে। তৎকালীন সময়ে গ্রামোফোন রেকর্ডেও গানটি শোনা যেত। শিল্পী আব্দুল লতিফও আলতাফ মাহমুদের সুরকে প্রশংসা করেছিলেন। অপরদিকে আব্দুল লতিফ অমর হয়ে রয়েছেন ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’ এবং ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’ এই গান দুটি গেয়ে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই আসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
×