ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মন্টিভিডিও টু মস্কো

বিশ্বকাপকথন-৬ ॥ চতুর্থ বিশ্বকাপ : ব্রাজিল ১৯৫০

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-৬ ॥ চতুর্থ বিশ্বকাপ : ব্রাজিল ১৯৫০

২০তম বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আলোচনা বাণিজ্যমেলা ও গ্রন্থমেলার কারণে খানিকটা শ্লথ হয়ে পড়লেও এখন আবার সরগরম হতে শুরু করেছে চায়ের টেবিলে, অফিসপাড়া। চলছে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক। এখন বলা যায়, দরজার ওপাশে উঁকি দিচ্ছে ২১তম বিশ্বকাপ। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ২১তম বিশ্বকাপের টিকেট বিক্রি। আগেই বলেছি, ১৪ জুন শুরু হয়ে এ প্রতিযোগিতা শেষ হবে ১৫ জুলাই। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করছে রাশিয়া সে কথাও সবার জানা। রাশিয়ার মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী ও সমাপনী (ফাইনাল) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথা সবার জানা, ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন...প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ’৪৬ সালে বিশ্বকাপের কোন আসর বসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর বসবে কিনা তা নিয়েও একটু হলেও সংশয় ছিল। বিশ্বকাপের চতুর্থ আসরের আয়োজকের দায়িত্ব নিয়ে খুব একটা বেশি ভাবতে হয়নি। পর পর দুইবার ইউরোপে বিশ্বকাপের আসর বসেছে। ফলে এবারে যে ইউরোপের বাইরে বিশ্বকাপের আসর বসবে সেটা অনেকটা নিশ্চিত ছিল। কেবল আলোচনার বিষয় ছিল কোন দেশে হবে বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর। ফিফার ৬৮টি দেশের প্রতিনিধিদেরও এবারে আয়োজক নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হল না। সর্বসম্মতিতে তৃতীয় বিশ্বকাপের আয়োজকের দায়িত্ব পেল পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দেশ ব্রাজিল। ব্রাজিলের দাবির কাছে অন্য কোন দেশের নাম পাত্তাই পায়নি। যথারীতি ১৬টি দেশ তৃতীয় বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার কথা থাকলেও আগের বিশ্বকাপের ধারাবাহিকতায় এবারেও শেষ মুহূর্তে ৩টি দল নাটকীয়ভাবে ল্যাটিন আমেরিকায় খেলতে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নাম প্রত্যাহার করে নেয়ায় এবারের বিশ্বকাপে প্রথম বিশ্বকাপের মতো মূল পর্বে অংশ নেয় ১৩টি দেশ। এই ১৩টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৩২টি দেশের মধ্যে থেকে। ফুটবলের জনক ইংল্যান্ড এ বিশ্বকাপে প্রথমবার অংশ নেয়। এ বিশ্বকাপের আগে ইংরেজরা বিশ্বকাপকে ফুটবলের বড় কোন আসর বলে মনেই করেনি। অনেকেই আশা করেছিল, এবারে এশিয়া থেকে কোন দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া থেকে এবারও কোন দেশ বিশ্বকাপে অভিষেক হলো না। বিশ্বকাপ আটকে থাকল সেই ইউরোপ-আমেরিকার গ-িতেই। চতুর্থ বিশ্বকাপে অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ থেকেÑ ইতালি, সুইজারল্যান্ড যুগোশ্লাভিয়া, স্পেন, ইংল্যান্ড, সুইডেন ও বলিভিয়া; কনমোবল থেকেÑ ব্রাজিল, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, চিলি; কনকাকাফ থেকেÑ যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো চতুর্থ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ২৭টি ম্যাচ। মূল পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ২২টি ম্যাচ। ফ্রান্সের ৬টি স্টেডিয়ামে এই ২২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বকাপের মতো এবারও গ্রুপিং করা হয়। গ্রুপ পর্বে ১৩টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ক ও খ গ্রুপে ৪টি করে গ গ্রুপে ৩টি ও ঘ গ্রুপে ২টি দল অংশ নেয়। যার কারণে উরুগুয়ে ও বলিভিয়াকে গ্রুপ পর্বে মাত্র একটি ম্যাচ খেলতে হয়। এরপর চার গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়নকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘ফাইনাল পুল’। ফাইনাল পুলে প্রত্যেক দল একে অপরের মোকাবেলা করে। এ বিশ্বকাপে কোন কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমি ফাইনাল অথবা ফাইনাল ছিল না। এ রকম এক অদ্ভুত নিয়মের খেলা কেন আয়োজকরা খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন তার কারণ কারো বোধগম্য হয়নি। যার কারণে ব্রাজিল নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই আটকা পড়ে। ১৩টি দল নিয়ে চারচে পুল করা হয় এভাবে : পুলকÑ ব্রাজিল, যুগোশ্লাভিয়া, সুইজারল্যান্ড ও মেক্সিকো; পুল-খÑ ইংল্যান্ড, স্পেন, চিলি ও যুক্তরাষ্ট্র; পুল-গÑ ইতালি, সুইডেন ও প্যারাগুয়ে; পুল-ঘÑ উরুগুয়ে ও বলিভিয়া অংশ নেয়। চতুর্থ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ব্রাজিল ৪-০ গোলে মেক্সিকোকে হারিয়ে উড়ন্ত সূচনা করে। তবে এ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যান্ডের ০-১ গোলে হেরে যাওয়া। প্রথমবার খেলতে আসা নাক উঁচু ইংরেজ সাহেবরা এ পরাজয় মানতেই রাজি ছিল না। গ্রুপ পর্বে আমেরিকানরা অপ্রত্যাশিতভাবে ১-০ গোলে বিশ্বকাপে অভিষিক্ত ইংল্যান্ডকে হারিয়ে তামাম ফুটবলবিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেয়। এই ফলাফল ইংরেজদের কাছে এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে তারা তা বিশ্বাস তো করেইনি বরং ভেবেছিল ইংল্যান্ড ১০-০ গোলে জিতেছে। ইংল্যান্ডের এক পত্রিকার স্পোর্টস রিপোর্টার তো সেটা লিখেও ফেলল। তিনি ভাবলেন টেলিপ্রিন্টারে ভুল লিখেছে। তারা নিউজ করে বসল, ইংল্যান্ড ১০-০ গোলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে জিতেছে। ওই ম্যাচের পরাজয় ইংল্যান্ডের সকল দম্ভ, অহঙ্কার আর দীর্ঘদিনের লালিত গর্বকে ধুলিসাৎ করে দেয়। যে অহঙ্কারে তারা প্রথম ৩টি বিশ্বকাপকে তুচ্ছ মনে করে অংশই নেয়নি। প্রথম লেগে চার গ্রুপে বিজয়ীদের তালিকায় ছিল স্বাগতিক ব্রাজিল, উরুগুয়ে, স্পেন ও সুইডেন। আর বাদের তালিকায় ছিল চ্যাম্পিয়ন ইতালি, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, প্যারাগুয়ে বলিভিয়া, মেক্সিকো, চিলি, ও বলিভিয়া। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : পুল-১ : ব্রাজিল-৪ মেক্সিকো-০; যুগোশ্লাভিয়া-৩ সুইজারল্যান্ড-০; যুগোশ্লাভিয়া-৪ মেক্সিকো-১; ব্রাজিল-২ সুইজারল্যান্ড-২; ব্রাজিল-২ যুগোশ্লাভিয়া-০; সুইজারল্যান্ড-২ মেক্সিকো-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল। পুল-২ : স্পেন-৩ যুক্তরাষ্ট্র-১; ইংল্যান্ড-২ চিলি-০; যুক্তরাষ্ট্র-১ ইংল্যান্ড-০; স্পেন-২ চিলি-০; স্পেন-২ ইংল্যান্ড-০; চিলি-৫ যুক্তরাষ্ট্র-২; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : স্পেন। পুল-৩ : সুইডেন-৩ ইতালি-১; সুইডেন-২ প্যারাগুয়ে-২; ইতালি-২ প্যারাগুয়ে-২; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : সুইডেন । পুল-৪ : উরুগুয়ে-৮ বলিভিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : উরুগুয়ে। ফাইনাল পুল : উরুগুয়ে-২ স্পেন-২; ব্রাজিল-৭ সুইডেন-১; উরুগুয়ে-৩ সুইডেন-২; ব্রাজিল-৬ স্পেন-১; সুইডেন-৩ স্পেন-১; উরুগুয়ে-২ ব্রাজিল-১ তৃতীয় স্থান : সুইডেন। চ্যাম্পিয়ন : উরুগুয়ে রানার্স আপ ব্রাজিল। ফাইনাল পুলে ব্রাজিল অসাধারণ খেলছিল। প্রথম ম্যাচে তারা সুইডেনকে ৭-১ গোলে এবং দ্বিতীয় ম্যাচে স্পেনকে ৬-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় সময়ের ব্যাপারে নিয়ে আসে। কথায় বলেÑ ‘বিধির বিধান-না যায় খ-ন’। কথাটি ব্রাজিলের বেলায় শতভাগ প্রমাণিত হয়। যাকে বলে ‘বিধি বাম’। প্রথম দুই ম্যাচে এতবড় জয় নিয়েও ব্রাজিলের শেষ রক্ষা হয়নি। চতুর্থ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে প্রথম বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। সবাই ভেবেছিল কাপ জিতবে ব্রাজিল। তথ্য পরিসংখ্যানও তাই বলছিল। যদিও অভিষেক বিশ্বকাপপের শিরোপাজয়ী উরুগুয়েও স্পেন ও সুইডেনকে হারিয়ে সমান পয়েন্ট নিয়ে শেষ ম্যাচে মাঠে নামে। তবে ব্রাজিলের একটা সুবিধে ছিল, বেশি গোল করার সুবাদে তারা ড্র করলেও চ্যাম্পিয়ন। আর এটাই ব্রাজিলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। ব্রাজিল জেতার পরিবর্তে ড্রয়ের দিকে মনোযোগ দিল বেশি। অপরদিকে উরুগুয়েকে কাপ জিততে হলে সরাসরি ম্যাচ জিততে হবে। এমতাবস্থায় খেলতে নেমে ব্রাজিলের ফ্রিয়াংকা গোল করে দলকে এগিয়ে নিলে মারকানা স্টেডিয়ামের দুই লাখ দর্শক সোল্লাসে মেতে ওঠে। তবে সে উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হতে দেননি উরুগুয়ের শিয়াফিনো। তিনি গোল করে সমতা আনলে তামাম স্টেডিয়াম বিষাদে ভরে ওঠে। খেলার শেষ দিকে উরুগুয়ের স্ট্রাইকার ঘিগিয়ার অপ্রত্যাশিত গোল ব্রাজিলের পরাজয় নিশ্চিত করে। ব্রাজিলের দর্শকরা এ পরাজয় সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। আর তাই এ পরাজয় মেনে নিতে না পেরে মারকানা স্টেডিয়াম থেকে লাফিয়ে পড়ে শত শত ব্রাজিলীয় সমর্থক আত্মাহুতি দেয়। প্রিয় দলের হার মেনে না নিয়ে এতগুলো মানুষের স্বেচ্ছায় জীবন দেয়ার ঘটনা ফুটবল ইতিহাসে বিরল। চতুর্থ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের নেতৃত্ব দেন তাবেলা আর ব্রাজিলের অগাস্টো। সুইডেন পায় তৃতীয় স্থান আর স্পেন চতুর্থ। ব্রাজিলের ৬টি স্টেডিয়ামে এ বিশ্বকাপের ২২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সুইডেনের ওয়াল্টার ট্রোয়েম বিশ্বকাপের ২০০তম গোলটি করেন এ বিশ্বকাপে। চতুর্থ বিশ্বকাপে মোট ৮৮টি গোল হয়। চতুর্থ বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন ব্রাজিলের আদেমির মাকুইস দ্য মেনজেস। তিনি এ বিশ্বকাপে ৮টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। আদেমির ফাইনাল পুলে সুইডেনের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। চতুর্থ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন ইংল্যানেইর রেফারি জন রিডার। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ e-mail : [email protected]
×