ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শফী আহ্মেদ

১৪ ফেব্রুয়ারি ॥ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে শহীদদের সশ্রদ্ধ স্মরণ

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

১৪ ফেব্রুয়ারি ॥ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে শহীদদের সশ্রদ্ধ স্মরণ

আজ ফাগুনের দ্বিতীয় দিন। মিষ্টি হাওয়ার ঋতু শুরুর এই দিনটি বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ এবং আকাশ-সংস্কৃতির দাপটে সব ছাড়িয়ে বিশ^ ভালবাসা দিবসের আওয়াজটাই বেশি শোনা যায়। বিদেশী সংস্কৃতি গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই আমাদের সামনে এগুতে হবে। তবে সেটা নিজেদের মৌলিক অর্জনগুলোকে বিসর্জন দিয়ে নয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের জন্য ভালবাসার ফুল ফোটেনি। ফুটেছিল দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চনের বুকের তপ্ত রক্তে রঞ্জিত হওয়া রাজপথের রক্তাক্ত গোলাপ। সেদিন ছিল স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সচিবালয় অভিমুখে প্রতিরোধ মিছিল। তিন দফা দাবির ভিত্তিতে সেই প্রতিরোধের ডাক দেয়া হয়েছিল। ১. মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল। ২. সকল ছাত্র ও রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি। ৩. সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই তিন দফার দাবিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ১১ জানুয়ারি সকালে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতা ছিলাম তাদের ঘরোয়াভাবে ডেকে বললেন, অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচী পালন করা যাবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে যখন আমরা প্রশ্ন করলাম, কেন? কী সেই অনিবার্য কারণ? নেতারা একান্তে বললেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রস্তুত নয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় আমাদেরই পরম পূজনীয় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সমবেত হয়েছিল জীবন বাজি রেখে সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ শহীদ ও লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত বিসর্জনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা এদেশ স্বাধীন করেছিলাম অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামরিক জান্তার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, ক্যু-পাল্টা ক্যুর মধ্য দিয়েই আমাদের এই কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রের অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ঠা-া মাথায় পরিকল্পিতভাবে একের পর এক কল্পিত অভ্যুত্থানের গল্প সাজিয়ে হত্যা করে শত শত মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তাকে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনর্বাসিত করা হয়। একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূ-লুণ্ঠিত করে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারায় দেশ চলতে থাকে। ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩১ তারিখে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জেনারেল জিয়া এক অভ্যুত্থানে নিহত হন। জিয়া হত্যার বিচারের নামে প্রহসন করে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুরকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। আমরা যদি আরেকটু আগে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ১৯৭৫-এর ৩ থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে জিয়াউর রহমান পুনরায় ক্ষমতাসীন হন। ক্যাঙ্গারু ট্রায়ালের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে আরেক সেক্টর কমান্ডার নিঃশঙ্কচিত্তের বীর কর্নেল আবু তাহেরকে। জিয়া হত্যার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধসে পড়া সাত্তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতার ক্রীড়নক জেনারেল এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। এদেশের ছাত্র-জনতার শত বছরের আকাক্সক্ষা গণতান্ত্রিক অধিকার জনতার হাতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মূলত সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচীতে শামিল হয়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কী সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার! শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি। লুটিয়ে পড়ে শহীদ শত শত কতিপয় ছাত্রের রক্তাক্ত নিথর দেহ, যাদের লাশ গুম করা হয়েছিল পরবর্তীতে। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সামরিক শাসনকে মোকাবিলা করার জন্য তখনও তেমনভাবে প্রস্তুত ছিল না। এরপরও ছাত্র-জনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে মুক্তির আকাক্সক্ষায়। সে কারণেই আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করি। এ কাক্সিক্ষত আন্দোলন অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয় নব্বইয়ের অভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তির ভিন্নরূপ। ১৯৯৩ সালে সেই শক্তির উপদেষ্টা সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন ‘ভালবাসা দিবস’। যায়যায়দিন খ্যাত সাপ্তাহিকে পরকীয়ার আখ্যান ‘দিনের পর দিন’ কলামে ‘মিলা ও মইনের’ টেলিফোনে কথোপকথনের ভালবাসার মূর্তরূপ ধারণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, বিশ্ব ভালবাসা দিবস বাংলাদেশে পালিত হয় আবালবৃদ্ধবনিতার হলুদাভ বস্ত্রের ও গাঁদা ফুলের মর্মর মিলনমেলার আচ্ছাদনে। নগর থেকে বন্দর, রাজপথ থেকে শিক্ষাঙ্গন ছেয়ে যায় হলুদাভ ভালবাসায়। আজ আমরা যে ভালবাসা দিবস পালন করছি এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্যও রয়েছে। প্রায় সাড়ে সতের শ’ বছর আগে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে তখনকার দিনে ইতালির রোম শাসন করতেন রাজা ক্লডিয়াস-২। তখন রাজ্যে চলছিল সুশাসনের অভাব, আইনের অপশাসন, অপশিক্ষা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং কর বৃদ্ধি। এতে প্রজাকুল ফুঁসছিল। রাজা তার সুশাসন ফিরিয়ে আনার জন্য রাজদরবারে তরুণ-যুবকদের নিয়োগ দিলেন। আর যুবকদের দায়িত্বশীল ও সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি রাজ্যে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কারণ, রাজা বিশ্বাস করতেন বিয়ে মানুষকে দুর্বল ও কাপুরুষ করে। বিয়ে নিষিদ্ধ করায় পুরো রাজ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলো। এ সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক যাজক গোপনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালবাসার বন্ধু’ বা ঋৎরবহফ ড়ভ খড়াবৎং নামে। কিন্তু তাকে রাজার নির্দেশ অমান্য করার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে আটক করা হলো। জেলে থাকাকালীন ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় হয় জেলরক্ষক আস্ট্রেরিয়াসের সঙ্গে। আস্ট্রেরিয়াস জানতেন ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে। ভ্যালেন্টাইন পরবর্তীতে মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। এতে মেয়েটির সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রাজা তার এই আধ্যাত্মিকতার সংবাদ শুনে তাকে রাজদরবারে ডেকে পাঠান এবং তাকে রাজকার্যে সহযোগিতার জন্য বলেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা না তোলায় সহযোগিতায় অস্বীকৃতি জানান। এতে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তার মৃত্যুদ- ঘোষণা করেন। মৃত্যুদ-ের ঠিক আগের মুহূর্তে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে একটি কলম ও কাগজ চান। তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লিখেন এবং শেষাংশে বিদায় সম্ভাষণে লেখা হয় ঋৎড়স ুড়ঁৎ ঠধষবহঃরহব. এটি ছিল এমন একটি শব্দ যা হৃদয়কে বিষাদগ্রাহ্য করে। অতঃপর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। সেই থেকে সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ পালন করা হয়। নতুন প্রজন্মকে বলি, আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। বসন্তের এদিনে বাগানে ফুটেছে নানা রঙের কত শত ফুল। কত ফুল আজ শোভা পাচ্ছে রমণীর নোটন খোঁপায়। প্রিয় মানুষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে চলতে চলতে আজ কত ফুল হবে অনুষঙ্গ। এ দিনে তোমরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি ভালবাসাময় পৃথিবী উপহার দাও। তার আগে স্বৈরাচার সরকারের হাতে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে অন্তত একটি ফুল দিও শহীদদের স্মরণে। আজ থেকে ৩৪ বছর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যাদের নিশ^াস স্বৈরাচারের বুলেটে, বেয়নেটে দেহত্যাগ করেছিল তাদের আত্মা শান্তি পাবে। লেখক : ৯০-এর গণআন্দোলনে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা’, বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা
×