ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 রিপোর্টারের ডায়েরি

পড়শির কাছে কৃতজ্ঞ ৬ ডিসেম্বর, বুধবার। সচিবালয়ে হাজির হলাম সকাল ১০টায়। আমার স্ত্রীকে তার অফিসে নামিয়ে দিয়ে মোটরসাইকেলে সচিবালয়ে গিয়ে পৌঁছাই। পৌঁছে দেখি বাড়ি থেকে দিদি কয়েকবার ফোন করেছে। দিদিকে কল ব্যাক করে শুনি অপরপ্রান্ত থেকে দিদি কাঁদছে, আর বলছে স্বপনের স্ট্রোক করেছে। স্বপন আমার বড় ভাই। আমরা দুই ভাই-এক বোন। দিদি সবার বড়। আর আমি ছোট। হঠাৎ খবরটি শুনে আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত গ্রাম্য ডাক্তার এনে প্রেসার দেখতে বললাম। একই সঙ্গে ঢাকার পরিচিত ডাক্তারদের সঙ্গে ফোনে পরামর্শ নিলাম। তাদের পরার্মশ অনুযায়ী আমি বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে ফোনে জানালাম বিষয়টি। তার শরীরটাও খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। এদিকে ছেলেটি সকালেই সিলেট গিয়েছে। অনার্স পরীক্ষা শেষ। তাই ঘুরতে গেছে। সেখানে ওর এক বন্ধু থাকে। সে মেডিক্যালের ছাত্র। এই অবস্থায় স্ত্রী বাসায় থাকতে পারবে কি-না এমন চিন্তা থেকেই তাকে ফোন করলাম। সে একটু ভীতু টাইপের। তারপরও সে আমাকে যাওয়ার জন্য বলল। সে বলল তুমি না গেলে বাড়িতে ওরা কিছুই পারবে না, বুঝবেও না। সঙ্গে সঙ্গে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে অফিসে চলে এলাম। অফিসে এসে আমাদের চিফ রিপোর্টার (ডেপুটি এডিটর) ওবায়েদ ভাইয়ের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওবায়েদ ভাই বললেন, ফোনে বলে চলে গেলেই হতো। যাই হোক, বাসায় ফিরে আবার বেরিয়ে পড়লাম খুলনার উদ্দেশে। মোটরসাইকেলে চলি, তাই যানজট থাকলেও অতটা বুঝি না। বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুই পাই না। গুলিস্তান যেতে হবে। টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস ধরতে হবে। বাসার পাশেই নির্বাচন কমিশনের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করে একটি সিএনজি অটোরিক্সা পেলাম। উঠেও পড়লাম। বাসের কোন টিকেট করিনি। তাই যে বাস ছাড়বে তাতে গিয়ে উঠে বসব, এমন চিন্তা করে বেরিয়েছি। প্রচন্ত জ্যাম ঠেলে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা পর ঠিক ৪টা ৫ মিনিটে টুঙ্গিপাড়া বাস কাউন্টারে গিয়ে শুনি ৪টার বাস ছাড়তে যাচ্ছে। এতে আই লাইনে সিট হবে। অর্থাৎ সবার পেছনে। কোন কথা না বলে টিকেট নিয়ে উঠে পড়লাম। মুহূর্তে বাসটি ছেড়ে দিল। রাজধানীর জ্যাম কাটিয়ে আস্তে আস্তে বাসটি এগিয়ে গেল। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে আমরা মাওয়া লঞ্চ ঘটে পৌঁছলাম। রাত পৌনে ৮টার দিকে আমরা লঞ্চ থেকে নেমে বাসে উঠি। সন্ধ্যারাতে ফাঁকা রাস্তায় বাস দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে খুলনার উদ্দেশে। সাড়ে ৮টার দিকে স্ত্রী টুলুরানীর ফোন। প্রথমে জানতে চাইল নদী পার হয়েছি কিনা। এরপর অপরপ্রান্ত থেকে জানালো, তার ব্লাড প্রেসার কোন অবস্থায় কমাতে পারছে না। ওই মুহূর্তে তার প্রেসার ২১০-১১০। শুনে আমি কি করব বুঝতে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম জাতীয় হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ডাঃ দীপঙ্কর দাকে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। আরও দুই ডাক্তারকে ফোন করে পেলাম না। পরে ফোনে পেলাম আমার এক বন্ধু ডাক্তার কৌশিক মল্লিককে। তাকে প্রথমেই বললাম আমি বিপদে আছি, তোমাকে আজ বার বার বিরক্ত করব। ফোন ধরিও কিন্তু। সে জানতে চায় কি হয়েছে। তাকে বিস্তারিত বলতে সে ব্লাড প্রেসার দ্রুত কমানো ওষুধ বলে দেয়। বাসায় কেউ না থাকায় কে ওষুধ এনে দেবে এমন প্রশ্নও মাথায় আসে। তখন পাশের বাসার মিজান ভাইকে ফোন করে ওষুধ কিনে দিতে অনুরোধ জানালাম। সে তৎক্ষণাৎ ওষুধ এনে দিল। কিন্তু এতেও প্রেসার কমছে না। কি আর করা। আবার ফোন কৌশিককে। এবার সে নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়ল। এবার সে একটি পাওয়ারফুল ঘুমের ওষুধের নাম বলে দিল। সেটিও মিজান ভাই এনে দিল। ওষুধটি খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। মিজান ভাইয়ের স্ত্রী (ভাবি) তার পাশে সারারাত ঘুমিয়ে রইল। এভাবেই রাত ১১টার দিকে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দেখি স্ট্রোকের পর দাদার ডান পাশ অবস হয়ে গেছে। দাদাকে দেখে এবার ছেলেকে ফোন করে জানালাম তার মায়ের কথা। কিন্তু ঘুমিয়ে গেছে বিধায় ফোন না করতে বললাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীর ফোন পেলাম। সে দাদার অবস্থা জানতে চাইল। নিজের বিষয়ে জানালো প্রেসার কিছুটা কমেছে। দাদাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাকে ওই দিনই ফিরে আসতে বলল। আমি সকালেই দাদাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দুপুরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। Ñতপন বিশ্বাস কম্পোজ শিখে ভাগ্যগুণে চাকরিপ্রাপ্তি! ২০০৯ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহ। তখন আমি পাক্ষিক ক্রীড়ালোক ম্যাগাজিনের সহকারী সম্পাদক। দৈনিক জনকণ্ঠ অফিসে এসেছি ইন্টারভিউ দিতে। ক্রীড়া সম্পাদক মজিবর রহমান ভাই ইন্টারভিউ নিয়ে সন্তুষ্ট হলেন। বললেন পরেরদিন থেকে কাজে জয়েন করতে। চলে আসার সময় জানতে চাইলেন কম্পিউটারে বাংলা কম্পোজ করতে পারি কি-না। ‘না’ বলাতে সাফ জানিয়ে দিলেন কম্পোজ না জানলে চাকরি হবে না। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়! বের হয়ে এলাম একরাশ হতাশা নিয়ে। মনে পড়ে গেল গত ছয়টি বছর ধরে ক্রীড়ালোকে থাকতে আমাকে বিনা পয়সায় বাংলা কম্পোজ শেখানোর জন্য অনেক সাধাসাধি করেছিলেন গ্রাফিক্স এবং কম্পিউটার বিভাগের তারেক-উর-রহমান, রশমা কর্মকার, খোকন খান এবং রেহানা সুলতানা। তখন বলেছিলাম, ‘এত তাড়াহুড়ার কি আছে? আস্তে আস্তে শিখে নেব। তাছাড়া আপনারা তো আছেনই!’ আসলে তখন মনে করতাম বাংলা টাইপ অনেক কঠিন ব্যাপার! তাই এমন ভীতি, অনীহা ও আলসেমির কারণে ছয় বছরেও শিখিনি! অথচ এখন বাংলা কম্পোজ না জানার কারণে আমার জনকণ্ঠে তো বটেই, কোন পত্রিকাতেই চাকরি হবে না! বিষয়টা আমাকে নাড়া দিল প্রবলভাবে। কথায় আছে, ‘ঠেলার নাম বাবাজী’! কাজেই আমার এলাকার (মুগদাপাড়া) একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র্রে ভর্তি হয়ে গেলাম। এক মাসের কোর্স। শুধু বাংলা কম্পোজ শিখব। ৫০০ টাকা ফিস। সাত দিনের মধ্যেই কমান্ডগুলো মুখস্থ করে ফেললাম। তবে টাইপিং স্পিড অনেক সেøা। ভেঙ্গে পড়লাম হতাশায়। বুঝলাম, জনকণ্ঠে আর চাকরি বুঝি হলো না। কারণ, কবে বাংলা টাইপ শিখব, তার জন্য কি জনকণ্ঠ আমার জন্য বসে থাকবে? নিশ্চয়ই ততদিনে তারা অন্য লোক নিয়ে নেবে। তারপরও শেষ চেষ্টা হিসেবে দুরু দুরু বুকে, এক চিলতে আশা নিয়ে মজিবর ভাইয়ের সামনে ৮ সেপ্টেম্বর আবারও হাজির হলাম। বললাম, ‘ভাইয়া, আমি এখন বাংলা কম্পোজ জানি।’ ভাবলাম এই বুঝি উনি বলবেন, ‘তাতে কি? তোমার জন্য আমরা এতদিন অপেক্ষা করব কোন্ দুঃখে! লোক নেয়া হয়ে গেছে। তুমি এবার রাস্তা মাপো!’ কি আশ্চর্য, উনি তা বললেন না! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। তার কথাগুলো যেন আমার কানে মধুর মতো বাজল, ‘তাহলে আজ থেকেই জয়েন কর। ওই কম্পিউটারে গিয়ে বস।’ আমি বললাম, ‘মানে? এখনই কাজ শুরু করব?’ ‘হ্যাঁ, কেন কোন সমস্যা?’ ‘না, কোন সমস্যা নেই।’ বাসায় ফোন করে আম্মাকে চাকরিপ্রাপ্তির কথা জানিয়ে দিলাম। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করলেও আমাকে জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ কাউন্ট করে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে। সে হিসাবে জনকণ্ঠে আমার আট বছর হয়ে গেছে। এই সময়ে পেয়েছি দারুণ কিছু সহকর্মীদের। যাদের অনেকেই এখন জনকণ্ঠে বা সাংবাদিকতা পেশাতেই নেই, কেউ আবার অন্য সংবাদ মাধ্যমে আছেন। এখন মজিবর ভাই বাদে বাকি যারা আছে, তারা সবাই আমার জুনিয়র ও পরে এসেছে। তাদের মধ্যে জাহিদুল আলম জয় এবং শাকিল আহমেদ মিরাজ দুজনেই এসেছে আমার মতোই পাক্ষিক ক্রীড়ালোক থেকে। নব্বই দশকের শুরুতে (১৯৯২) জনকণ্ঠ প্রথম বাজারে আসে। তখন থেকেই পত্রিকাটি নিয়মিত পড়তাম। অনেক ভাল লাগত। কিছুদিনের মধ্যেই এটি সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের তালিকায় স্থান করে নেয়। প্রায় একযুগ এমনটা ছিল। তখন জনকণ্ঠের অফিস ছিল মতিঝিলে (এখন ইস্কাটনের নিজস্ব ১৩ তলা ভবনে)। সেদিক দিয়ে যাবার সময় অনেকবারই কৌতূহলী হয়ে ভেবেছি, কি আছে এই বিল্ডিংয়ের ভেতরে, কিভাবে স্টাফরা কাজ করে। ক্রীড়ালোকে যখন চাকরি করি, তখন মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, যদি কখনও জনকণ্ঠে চাকরি করতে পারতাম! সেই স্বপ্ন সৃষ্টিকর্তা পূরণ করেছেন। ভবিষ্যতের কথা কেউ বলতে পারে না। জানি না কতদিন জনকণ্ঠে কাজ করব। জনকণ্ঠে চাকরি করার সময় চারটি সংগঠনের (ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি, বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জ সাংবাদিক ফোরাম) সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। সাংবাদিকদের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নানা পুরস্কার পেয়েছি। অনেক সহকর্মীকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে দেখিছি। দেখেছি বিশ্বের সেরা ফুটবলার আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসিকে সামনা সামনি... আরও কত কি! জনকণ্ঠের জয় হোক! -রুমেল খান
×