ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ঢাকার দিনরাত

আজ পহেলা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন। কাল ভালবাসা দিবস। পাঠককে আনুষ্ঠানিক ভালবাসা জানিয়ে লেখা শুরু করাই উত্তম। পরপর দুটো দিন স্পেশাল, মানে বিশেষ। বসন্তের হাওয়া যদিও বইতে শুরু করেছে কয়েকদিন আগে থেকেই, তবে আজ ঢাকাবাসী অগণিত মানুষের মনে বসন্ত এনে বাঁশি বাজাবে। বছরের পর বছর ধরে ভালবাসা দিবস বিচিত্র বর্ণিলভাবে পালন করতে করতে এবং মিডিয়ার বহুল প্রচারে এর একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে গেছে। নাগরিকদের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছে। ভালবাসা দিবসের গল্পে ফেরার আগে বৃহস্পতিবারটা একটু স্মরণ করা যাক। সেদিন ঢাকাবাসী কারুরর মনেই বোধকরি বসন্তের আগমনী বার্তা সাড়া ফেলেনি। এমনই উৎকণ্ঠা ও অজানা শঙ্কা ছিল নগরবাসীর মনে। বেশ সকালেই উত্তরা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম জনকণ্ঠ ভবনের উদ্দেশে। পথঘাট বেশ হরতাল হরতাল ভাব। গণপরিবহন তেমন একটা ছিল না। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। মানুষের চোখ টিভি পর্দায়। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া চলেছেন তো চলেছেন আদালতের দিকে, পথ যেন আর শেষ হয় না। কী রায় হবে! জেল হলে কোন জেলে নেয়া হবে বেগম জিয়াকে? এসব প্রশ্ন সচেতন মানুষের মনেই ঘুরপাক খাওয়ার কথা। টিভি চ্যানেলগুলো পাল্লা দিয়ে সরাসরি সম্প্রচারে নেমেছে। আমাদের দৃষ্টি অনলাইনেও বিছিয়ে রেখেছি। খুব বেশি একটা সংঘর্ষের খবর আমরা পেলাম না। তবু টেনশন শেষ হয় না। রায় ঘোষণার খবর ঝড়ের চাইতেও বেশি বেগে ছড়িয়ে পড়ল। ফেসবুক আরেকটা মাধ্যম হয়েছে নিউজ ব্রেক করার। নেত্রী তো জেলে গেলেন, এরপর কি? শুক্র-শনি বাদ দিয়ে রবিবার কি হরতাল আসছে? না এলো না। ঢাকাবাসীর মনে আপাত স্বস্তি। যাক, জ্বালাও পোড়াওয়ের পরিবেশ পেতে হরতাল হচ্ছে না। আমরা যারা বইপ্রেমী, তাদের দুশ্চিন্তা বইমেলায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না তো? হ্যাঁ, পড়েছিল। বৃহস্পতিবার সম্ভবত দোকানি আর প্রকাশকেরাই গিয়েছিলেন বইমেলায়। এেেকবারে নিষ্প্রাণ হয়ে উঠেছিল প্রাণের মেলা। ভালবাসা দিবসের রঙ ভ্যালেন্টাইন ডের পুরো নামটা আসলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স্ ডে- ভ্যালেণ্টাইন নামক তৃতীয় শতাব্দীর দুজন সন্তের নামানুসারে। ভ্যালেন্টাইন ডে-কে ভালবাসা দিবস হিসেবে পালন করার প্রচলন অবশ্য তারও অনেক আগে থেকে। কথিত আছে যে, রোমান সাম্রাজ্যের লুপারচেলিয়া অঞ্চলে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে একটি বিশেষ ভোজানুষ্ঠানের আয়োজন হতো যেখানে যুবক-যুবতীরা পরস্পরের জীবনসাথী বাছাই করত। কালে কালে সেটা ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আরেকটা ভোজোৎসবের সঙ্গে মিশে যায়, যার উপলক্ষ ছিল দু’জন শহীদ যোদ্ধাকে স্মরণ করা। দু’জনকে একই নামে নামকরণ করা হয়েছিল- সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে এই সন্তদ্বয়ের একটা বিশেষ স্থান ছিল। দু’জনকেই ভাবা হতো প্রেমের প্রতীক। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বাছাই করার কারণ, প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী এই দিনেই নাকি পাখিরা তাদের সখা-সখী নির্বাচন করে। আমাদেরও আছে প্রেমের কাহিনী। প্রাচীন ভারতবর্ষে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের গল্প। মধ্যযুগীয় পারস্য থেকে আমরা পেয়েছি শিরী-ফরহাদ আর লায়লী-মজনুর করুণ কাহিনী। প্রেম দিয়েই তো আমাদের পুঁথিপত্র পরিপূর্ণ। রাধাকৃষ্ণের চিত্তাকর্ষক প্রেমের গল্প থেকেই কি উৎসারিত হয়েছে উপমহাদেশের প্রেমসমৃদ্ধ কাব্যশিল্পগাথার ঐতিহ্য? তাঁরা বাস্তব ছিলেন কি ছিলেন না তা হতে পারে ইতিহাসের পণ্ডিতদের বিতর্কের বিষয়, কিন্তু তাঁদের প্রেম যে একটা অনুপম মূর্তি নির্মাণ করে গেছে যুগযুগান্তের প্রেমপূজারীদের জন্য তাতে তো কাল্পনিক কিছু নেই। ভালবাসা দিবসের ঢাকার কথা কি লিখে শেষ করা যাবে? ভালবাসা দিবসকে এখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বেশ ভালভাবেই উপভোগ করে। নানা ব্যক্তিগত আয়োজনে তারা দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখার চেষ্টা করে। একইসঙ্গে ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ভালবাসা দিবসকে কেন্দ্রে রেখে বহু বর্ণিল একটি বৃত্ত রচনা করে, যার সময়সীমা ১৪ ফেব্রুয়ারির ২৪ ঘণ্টাকে ছাপিয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বলা অসঙ্গত হবে না যে, বিগত এক-দেড় দশকে আমাদের ভালবাসা দিবস উদ্যাপনের বহুমাত্রিকতা তার পরিসর ও ওজন বিবেচনায় পৃথিবীর যে কোন দেশকে ছুঁয়ে ফেলতে পারঙ্গম। আমাদের প্রেমিকরা বিশ্বের কোন দেশের প্রেমিকের তুলনায় সামান্যতমও পিছিয়ে নেই। আর কে না জানে যে, প্রেমের কোন বয়স নেই। আমি সত্তরোর্ধ এমন ব্যক্তিকেও চিনি (নাম বা পেশা বলার কী দরকার!) যিনি এখনও প্রেমকাতর একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের প্রতিযোগী হতে সক্ষম, প্রেমপ্রকাশ ও প্রেম উপাদান গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে। সত্যি বলতে কি, জীবনের এক শ’ একটা যন্ত্রণার ভেতর সেঁধিয়ে থাকা মানুষের দেহমনে একটুখানি হলেও ভালবাসার সুবাতাস এসে আছড়ে পড়ে এই দিন, হোক তা কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। বড়ই বস্তুবাদী আর কাঠঠোকরার ঠোঁটের মতোই কঠিন ও জটিল স্যুটেড-ব্যুটেড ব্যক্তিও ভালবাসার মন্দিরায় মনটাকে ভিজিয়ে ফেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। এই বঙ্গে ফাগুন আর ভালবাসা দিবস আসে হাত ধরাধরি করে। ভালবাসা দিবসের বারতাই যেন এখন বাংলার ফাল্গুন আকাশে-বাতাসে, মাটিতে ও কংক্রিটে ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের বাংলা পঞ্জিকায় পহেলা ফাল্গুন হলো তেরোই ফেব্রুয়ারি আর ভ্যালেন্টাইন ডে ঠিক তার পরেরদিন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসে আছড়ে পড়ে ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসের ঢেউ। ভালবাসা দিবসের রূপ-রস-গন্ধ-উত্তাপ রাজধানীর যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় তা হলো এ বইমেলা। বইমেলা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমিতে না হতো তাহলে পহেলা ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসে আমরা ভালবাসার ওই সর্বব্যাপী রূপছটা থেকে অনেকখানি বঞ্চিত হতাম কিনা, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। বইমেলা সত্যিই এক মুক্তাঞ্চল, তা যতই পুলিশ-মেটাল ডিটেক্টর-সিসিটিভি ক্যামেরার শ্যেনদৃষ্টি থাকুক না কেন। দলে দলে তরুণ-তরুণী বইমেলায় এসে উদ্যাপন করেন ভালবাসা দিবস। মোল্লারা আর রক্ষণশীলরা চোখ কপালে তুলে রাখলেও তাতে কোন প্রতিবন্ধকতা পড়ে না। একসময় প্রায় নিয়মিতভাবেই ভালবাসা দিবসেও হরতাল ডাকা হয়েছে। তাতে কী। ভালবাসার মানুষদের কেউ দমাতে পারেনি। বইমেলায় তার অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। ভালবাসা দিবসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, এদিন অল্পবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে নতুন বই উপহার দেয়ার কথা বিবেচনা করেন। তাদের প্রথম পছন্দ কবিতার বই, প্রেমের কবিতার বই হলে তো সোনায় সোহাগা। এরপর তারা খোঁজেন প্রেমের উপন্যাস। এটা একেবারে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। অনেক প-িত লেখক আছেন যারা ভালবাসা নিয়ে মাতামাতিকে বাঁকা নজরে দেখেন। যেন তাঁরা কখনই কাউকে ভালবাসেননি। আবার ভালবাসা প্রসঙ্গে বাচাল হয়ে ওঠেনও কেউ কেউ। ভালবাসা বিষয়টিকে অন্তরে গভীরভাবে ধারণ করে কোন লেখক উচ্চারণ করতেই পারেন : প্রতিবার ভালবেসে আমি হই শুদ্ধ সর্বহারা। ভালবাসা দিবসে পুরুষ লেখককে কোন অনুরাগী একগুচ্ছ লাল গোলাপ উপহার দেবেন এটা কামনা করি মনে মনে। কিন্তু পাঠিকারা লেখকের রচনাকে ভালবাসেন, সেই রচনা তুলে দেন তাঁর প্রেমিকের হাতে। লেখক এখানে হয়ে যান অনেকটা পিতা কিংবা শ্বশুরের মতো, নিদেনপক্ষে বড় ভাই। তবে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ থাকেন প্রায় ঈশ্বরের আসনে। ভালবাসা দিবসের কদিন পরেই আসে জীবনানন্দের জন্মদিন। তাঁকে সেদিন নতুন করে প্রেমনিবেদন করেন জীবনপ্রেমিকরা। বিশেষ কোন নারী বা পুরুষের জন্য প্রেম হয়ত একসময় ঘাস হয়ে আসতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনের প্রতি প্রেম, বলা চাই, মহাজীবনের প্রতি প্রেম কখনও ফুরোয় না। তার নব নব অবয়ব তৈরি হয়, প্রকাশের রূপরেখা তৈরি হয়। তার একটি মাইলফলক কিংবা ফিরে তাকানোর দিন হয়ে উঠতে পারে আমাদের এই ভালবাসা দিবস। ভালবাসা দিবসে তাই উচ্চারণ করেই বলি : বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ তোমাকে ভালবাসি। ভাষার প্রতি ভালবাসা ভাষার মাসে কিছু কথা না বললেই নয়। একবারে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এটা বড় বেশি আশাবাদীর লক্ষ্মণ। একবারে কিছুই হয় না, তাই বার বার বলা দরকার। পথে পথে বাংলা ভাষার প্রতি উপেক্ষা, অপ্রেম বুঝতে অসুবিধে হয় না। বেশিরভাগ গণপরিবহন বাস-মিনিবাসের নাম বাংলা ভাষায় নয়। আরবী বা ইংরেজী ভাষায়। অবশ্য বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করেই লেখা হয় সেসব; যেমন ভিআইপি, স্কাইলাইন, আবাবিল, জাবালে নূর ইত্যাদি। তবু তার সমান্তরালে বিহঙ্গ, বলাকা, অনাবিল এসব বাংলা নাম বাসের গায়ে দেখে ভাল লাগে। তবে দোকান বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম এখনও ইংরেজীতেই রাখা হচ্ছে। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালানোর সুবিধার্থে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইংরেজীতে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন অনেক ব্যবসায়ী। বলাবাহুল্য এটি সুযুক্তি হতে পারে না। ইংরেজী ভাষা যেসব দেশের প্রধান ভাষা সেসব দেশের কথা আলাদা, তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশের যেসব বেসরকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবসা করছে সেসব নাম কি ইংরেজীতে রাখা হয়েছে? পণ্যের নামকরণের (ব্র্যান্ডিং) ক্ষেত্রেও ওইসব দেশের নাগরিকরা স্ব স্ব ভাষার ওপরই ভরসা রাখেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয়, কেবল দেশের ভেতর ব্যবসা-বাণিজ্য করছে যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলোর নাম ইংরেজীতে রাখারই বা যুক্তি কী? এখন আবার হিন্দী ভাষায়ও দোকানপাটের নাম রাখার চল শুরু হয়েছে। এটাও মাতৃভাষার প্রতি অবমাননা প্রদর্শনেরই নামান্তর। বাংলা ভাষার মিত্র না বাড়লেও বাড়ছে এ জাতীয় শত্রুর সংখ্যা। বাংলাপ্রেম ভাল, কিন্তু সেই প্রেমে খাদ মিশে যায় তখনই যখন ভাষাটি অশুদ্ধ উচ্চারণে, ভুল বানানে উপস্থাপিত হয়। বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নামফলক (সাইনবোর্ড) একেবারে কম নয়। একটু লক্ষ্য করলেই ভুল বানানের ছড়াছড়ি চোখে পড়বে। এসব অসঙ্গতি নিয়ে সেই কবে থেকেই লেখালেখি চলছে। ব্যঙ্গবিদ্রƒপ কৌতুক চলছে। বিটিভির ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কতই না নাট্যদৃশ্য ও প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। তবু এসব বন্ধ হয়নি। ভাষার মাস এসব অনিয়ম ও অসঙ্গতির দিকে আমাদের নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাতৃভাষাও শেখা ও চর্চার ব্যাপার। তার শুদ্ধতা রক্ষা করা যে জরুরী, এ জন্মদাত্রীর সম্মান রক্ষার সঙ্গে তুলনীয়- এই বোধটুকু জাগানোর জন্য লেখক-সাংবাদিক এবং শিক্ষকদের বারবার উদ্যোগী হতে হবে। বাঙালী মায়ের সন্তান হলেই যে বাংলা ভাষার ব্যাপারে আমি দক্ষতা অর্জন করে নিয়েছি এমনটা ভাবলে বড় ভুল হবে। অভিধান বা ডিকশনারির কয়েকটা পাতা উল্টালেই বোঝা যায় আমাদের বাংলা শব্দের সঙ্গে পরিচয়ের গভীরতা কতখানি। এই লেখা যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের বহুজনের ঘরে হয়ত বাংলা অভিধান নেই। তাঁদের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাই, হাতের কাছে একটি বাংলা অভিধান রাখুন। আপনার অতিব্যস্ত সময় থেকে আলাদাভাবে সময় বের করার কথা বলছি না। কাজের ফাঁকেই মাঝেমধ্যে সেটি হাতে তুলে নিন। পাতা উল্টে শব্দগুলো দেখুন। তার অর্থ খেয়াল করুন। বানানটাও দেখে নিন। আমার বিশ্বাস এভাবে কিছুদিন চললে এটা অভ্যাসে পরিণত হবেই। বাংলা ভাষার জন্য ভালবাসা এভাবেও গভীর রূপ নিতে পারে। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানে সামান্য কটি কথা বলতে চাই। প্রতিক্ষণ জীবনধারণের জন্য পানি ও বাতাসের অপরিহার্যতার সমতুল্য মাতৃভাষা। আবার জীবনের দাবি বা প্রয়োজনকে স্বীকার করে নিয়ে মাতৃভূমির নাড়ি ছেঁড়া ধন যখন ভিন্ন ভাষা পরিমণ্ডলে গিয়ে পড়ে এবং সে-ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে, তখনো তার সত্তার গভীরে জলহাওয়ার মতোই জ্বলজ্বলে থাকে মাতৃভাষাই। মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষা মানুষ পায় জন্মসূত্রে; জন্মের পর যে ভাষা আমাদের কানে পশে, যে ভাষায় বুলি ফোটে এবং জ্ঞান হয়, যে ভাষাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের শেখা হয়ে যায় সেই তো আমাদের আপন ভাষা। মা আর মাসি যেমন এক নয়, তেমনি মায়ের ভাষা ও পরভাষা এক হতে পারে না। তাই মাতৃভাষার উচ্চতার কাছে অন্যভাষা নিশ্চিতরূপেই খর্বকায়। সে কারণে সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প কিছু হতে পারে না। জ্ঞানের পূর্ণতার জন্যেও নয়। অথচ পৃথিবীর কোন একটি জাতির কোন একটি ভাষার বইয়ে তো আর বিশ্বের সব জ্ঞান-বিজ্ঞান মেলে না। সক্রেটিস, আইনস্টাইন, শেক্সপিয়ার, জেমস জয়েস, রবীন্দ্রনাথ- এঁদের মায়ের ভাষা এক নয়। তবে বিশ্বজননীর সন্তান এঁরা সবাই, সে অর্থে তাঁদের মাতৃভাষা আবার অভিন্নÑ সেটি মানবভাষা, মানবজাতির জ্ঞানের ভাষা। বিশ্বজ্ঞানের যে নিরন্তর প্রবাহ তাতে এঁরা এবং এমনি হাজারো মনীষী জ্ঞান সংযুক্ত করে গেছেন। সেসব জ্ঞান পরিপূর্ণরূপে অর্জনের মাধ্যম মাতৃভাষাই; বাঙালীর কাছে বাংলা, রুশীর কাছে রুশ। পাশ্চাত্যের এক ভাষাবিদ বলেছিলেন, একভাষিতা নিরক্ষরতার মতোই মন্দ, কারণ তা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। কথাটাকে উপেক্ষা করা চলে না। যদিও পাশাপাশি এ সত্যও অনস্বীকার্য যে, মাতৃভাষার সমব্যবহারেই আমাদের অপর ভাষার জ্ঞান গ্রহণ করা সমীচীন। কারণ আপন ভাষার উচ্চতাকে ছুঁতে অক্ষম ভিনভাষা। জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝে নিতে পারব তারা মাতৃভাষার উচ্চতার গুরুত্ব অনুধাবনে সমর্থ হয়েছিল বলেই সেই উচ্চতাকে আশ্রয় ও অবলম্বন করেই তারা এগিয়ে গেছে সামগ্রিক উন্নতির সোপানে। আপন উচ্চতাকে ধারণ করে আপনার উন্নতি- এটাই মোক্ষম কথা। বইমেলায় লেখক পরিবার এক পরিবারে তিন ভাইবোনই কবি। বড়জন গল্প-উপন্যাসও লেখেন। গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার। অপর দুই ভাইবোনের প্রথম বইটি এলো এবারের মেলায়। দুটিই কাব্য। বড় ভাই ফয়জুল ইসলাম আছেন প্ল্যানিং কমিশনে, ছোটভাই ফাহিমুলও আমলা। আর বোন ফারহানা নীলা চিকিৎসক, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত। তিন ভাইবোনের একসঙ্গে নতুন বই মেলায় আসা মানে তাদের সন্তান-বাবা মা বন্ধুবান্ধব নিয়ে রীতিমতো উৎসব। বোন লিখেছেন ভাইয়ের বই সম্পর্কে : কবি ফাহিমুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অমিয় প্রেমের বেলা অবেলা। বইটার নতুন পাতার ঘ্রাণটা নিয়ে পাতা উল্টাতেই, চোখ আটকে যায় উৎসর্গে! নাগরিক বিষণœ কবির হাতের লেখায় ভেসে ওঠে অনন্যা এক মুখশ্রী! পাঠক হৃদয় আন্দোলিত হয় প্রেমঘোরে! আমিও মনে মনে ছবি আঁকি— চিত্রিত হয় প্রেমময় জীবনের জলছবি। বলে উঠি- জেগে আছো লাবণী! ফাহিমুল ইসলাম শোভন, আমার ছোট ভাই। নিভৃতচারী মনে, অত্যন্ত নিখুঁত পর্যবেক্ষণে জীবনের জলছবি আঁকে শব্দে শব্দে। শোভনের কবিতা মানেই বিশেষ কিছু। আমি কবি ফাহিমুল ইসলামের ভক্ত পাঠক। আপনারাও পড়ে দেখতে পারেন। অমিয় প্রেমের বেলা অবেলা কাব্যগ্রন্থটি পাওয়া যাবে চৈতন্যে। এক বন্ধু ফয়জুলের উপন্যাস নিয়ে লিখেছেন : ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। দুর্দান্ত উপন্যাস। ঈদ সংখ্যায় উপন্যাসটি সংক্ষেপিত রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। এবারের বই মেলায় বই আকারে প্রকাশ পেল। ঢাকা শহরের মহল্লা সংস্কৃতির ভেতর বেড়ে ওঠা দিশেহারা ক’জন বিষণœ যুবকের ব্যান্ড দল গঠন, জীবিকার ঘূর্ণাবর্ত, গড্ডলিকা সংস্কৃতির ঘেরাটোপ আর হৃদয় ঘটনার আখ্যান ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। উপন্যাসটি নিয়ে বিশেষ বিস্তারে গেলাম না। আমি শুধু প্রেক্ষাপটটি বলে আপনাদের আগ্রহ ও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। ফয়জুল ইসলাম ভাইয়ের জন্য শুভ কামনা। বইটি প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ [email protected]
×