পায়রা সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে ক্রমশ। দেশ-বিদেশের পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়ছে, ছেড়ে যাচ্ছে, রাজস্ব আদায় হচ্ছে নিয়মিত। এমনকি যেসব জাহাজ এখান দিয়ে যাওয়ার সময় অতিক্রম করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা, তারাও টোল দিয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে বহু লোকের। আগামীতে বন্দরটি আরও সচল ও বহু ব্যবহার্য হলে আরও বাড়বে কর্মচাঞ্চল্য। চাপ কমবে চালনা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে ২০১৩ সালের নবেম্বরে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় টিয়াখালীতে এর সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সর্বাধিক মনোযোগ দেয় বিদ্যুত উৎপাদন, বন্দর স্থাপন ও যোগাযোগের উন্নয়নেÑ যা যে কোন দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যক। দেশ বিদ্যুত উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চট্টগ্রাম ও চালনার পর পায়রায় হয়েছে তৃতীয় সমুদ্রবন্দর। সর্বোপরি মাতারবাড়িতে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। আর পদ্মা সেতুর কাজ তো ইতোমধ্যে ৫১ শতাংশ দৃশ্যমান হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে অগ্রসর হতে হলে এসব লাগবে বৈকি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের অঙ্গনেও। এই বন্দরে জাহাজ ভিড়তে এবং পণ্য খালাস করতে অত্যধিক সময় লাগে। কাস্টমসের ঝামেলাও অনেক এবং শ্লথগতিসম্পন্ন। ফলে বিশ্বের যে কোন বন্দরের চেয়ে এখানে পণ্য আমদানি-রফতানিতে ব্যয় অনেক বেশি হয়। ফলে জাহাজ ভাড়াও বেড়ে যায় অনিবার্যভাবে। পণ্যের দামও বেড়ে যায় বহুগুণ। সর্বোপরি নাব্য সঙ্কটে বর্তমানে আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বন্দরের প্রবেশ মুখ। প্রবল জোয়ার ব্যতিরেকে বন্দরের সব জেটিতে জাহাজ ভিড়তেও পারে না। অতঃপর লাইটারেজ জাহাজযোগে পণ্য খালাস করতে হয় আমদানিকারকদের। ফলে জরুরী ভিত্তিতে চালনা ও পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোসহ আরও একাধিক বিকল্প বন্দর তথা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চিন্তাভাবনা চলছে দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমানে যে দুটো বন্দর রয়েছে, চট্টগ্রাম ও চালনায়, এ দুটোই মূলত সমুদ্র সংলগ্ন নদীবন্দর। এর মধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বন্দর দিয়েই দেশের আমদানি-রফতানির ৯২ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকে। চালনাকে বর্তমানে সারা বছর সচল রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে। কিছু পরিমাণ ব্যবসা-বাণিজ্যও হচ্ছে। এর পাশাপাশি বরগুনার পায়রায় তৃতীয় বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সমুদ্রসংলগ্ন নৌবন্দরের প্রধান সমস্যা হলো, এগুলোতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়, যা খুব ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। কেননা প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ নদীবাহিত পলি এসব বন্দরের নাব্য অবস্থায় বিঘœ সৃষ্টি করে থাকে। তদুপরি বিদ্যমান দুটো বন্দরই অনাধুনিক, সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। যে কারণে এসব বন্দরে দেশী-বিদেশী জাহাজ ভেড়া থেকে শুরু করে মালামাল খালাসে সময় বেশি লাগে। সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না।
দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে মাতারবাড়িতে। কক্সবাজার সংলগ্ন মহেশখালী দ্বীপের সন্নিকটে সমুদ্রের গভীরতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুকূল হওয়ায় সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়েছে মাতারবাড়ি। প্রাথমিক পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়ায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই চলবে চূড়ান্ত সমীক্ষার কাজ। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন বা জাইকার বিনিয়োগে এ বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হলেও এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সে অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ও আনুষঙ্গিক দক্ষতা অবশ্যই আরও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে জাইকা ২০১৮ সালের শেষ দিকে বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করতে ইচ্ছুক। ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি অপারেশনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে অবস্থান করছে, যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০৪১ সাল নাগাদ জাতীয় প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিটে রূপান্তরিত হতে পারে। সে অবস্থায় গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন ও গুরুত্ব আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে বৈকি। এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম, চালনা ও পায়রা বন্দরের আধুনিকীকরণসহ সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত জাইকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা, জাপান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও সুহৃদ এবং সর্বোচ্চ দাতা দেশ হিসেবে স্বীকৃত।