ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বছরে দু’বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে থাকে, যা একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই মাসে) এবং অপরটি শেষ প্রান্তিকে (জানুয়ারি মাসে)। তাত্ত্বি¡ক বিশ্লেষক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের মতে মুদ্রানীতির অন্যতম কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে (১) মুদ্রার গতিবিধি প্রক্ষেপণ করা; (২) মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; (৩) ঋণের প্রেক্ষাপণের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী খাতে ঋণ ধার্য করা; (৪) মুদ্রার প্রচলন নিয়ন্ত্রণ করা। এরই প্রেক্ষাপটে গত ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবারকার ঘোষিত মুদ্রানীতির বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারী অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ব্যবহার কমানো, বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানো, ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর)-এর যৌক্তিকতা নির্ধারণকরণ, ঋণ প্রবাহের সীমাটা বাড়ানো, ঋণ সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি, বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকা-ে প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা বজায় রাখা, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রেখে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৪ শতাংশ বজায় রাখা, রেপো অপরিবর্তিত রাখা, ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ১৩.৯ থেকে কমিয়ে ১৩.৩ শতাংশ করা ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়নে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক এডি অনুপাত অর্থাৎ ঋণ-আমানতের অনুপাত নিয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে। এতদিন আমার জানামতে যে কোন ব্যাংক শাখা তার আমানতের অথবা সামষ্টিক ভিত্তিতে কোন ব্যাংক তার আমানতের শতকরা ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে। আবার ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে শতকরা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে। সাম্প্রতিক চিত্রে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ বেসরকারী ব্যাংক এডিআর সীমানা ছাড়িয়ে তাদের আমানতের শতকরা ৯০ শতাংশ বিনিয়োগ করে চলছে, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে তারল্য সঙ্কট। আবার সরকারী মালিকানার ব্যাংক এই ধারা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে অর্থাৎ বিনিয়োগের স্থবিরতার কারণে টার্গেট পূরণ সম্ভব হয়ে উঠছে না একটি ভয়ে যে, টাকা ঋণ হিসেবে প্রদান করলেই খেলাপী ঋণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়ে যায়, বিশেষত ব্যাপক দুর্নীতি, ঋণ প্রদানে অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের ঘাটতি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার কারণে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদকে জানান, গত দশ বছরে ঋণখেলাপী হয়েছে ১৯৫৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যেখানে অনাদায়ী খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৬৫ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঋণ অনুমোদন/বিতরণ, উচ্চ আদালতে রিট, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, প্রভাবশালীদের বাঁচাতে উচ্চ পর্যায়ের চাপ এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ কিংবা সুপারিশের ওপর কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। এই খেলাপী ঋণের কারণে শুধু ব্যাংকগুলোই মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে এমন কথা নয়, বিনিয়োগকৃত মূলধনের ঘাটতি অর্থনীতির জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থমন্ত্রী রূপালী ব্যাংক লিঃ-এর এক ব্যবসায়ী সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছেন নির্বাচনের বছরে সকল ব্যাংক ঋণ প্রদানের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে আর সরকারী ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের অব্যাহত সহায়তা চলমান থাকবে। এবারকার ঘোষিত মুদ্রানীতি সবটুকু রয়েছে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, ঋণ আমানতের অনুপাতের যৌক্তিকতা, খেলাপী ঋণ ইত্যাদি। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত ৮ জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে ব্যাংকের সদর দফতরে মুদ্রানীতি নিয়ে যে পরামর্শ সভা করেছিল তার সুপারিশগুলো তেমন কোন আমলে নেয়া হয়নি। অর্থনীতিবিদদের একটিই সন্দেহ যে, নির্বাচনী বছর সামনে রেখে উন্নয়ন খাতে ঋণের বিনিয়োগ বাড়বে এবং এই বিনিয়োগ যদি নির্বাচনের প্রচারণায় অনুৎপাদন খাতে ব্যয় হয় তবে মূল্যস্ফীতি অনিবার্য। এরই মধ্যে সরকার প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশের বিপরীতে রয়েছে বর্তমানে ৬.৪৪ শতাংশ এবং খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে ৭.৬২ শতাংশ সরকারী হিসাব মতে (বিবিএস)। এখন উৎপাদকসহ ব্যবসায়ী মহলের ধারণা নির্বাচনের বছরে যেখানে কয়েক শ’ কোটি টাকা অর্থনীতিতে ব্যয়ের খাতায় স্থান পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, তখন পরিস্থিতি কোন্দিকে গড়াবে? অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। সেক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি জিডিপি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন ব্যাংক থেকে সরকারী ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে। এ কারণে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রণীত মুদ্রানীতি বেসরকরী ঋণের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টায় বিনিয়োগে কি প্রভাব ফেলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়, যা হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির প্রধান কৌশল। তা যদি না হয় তবে মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবং খেলাপী ঋণের সৃষ্ট ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির কারণে সরকারের টাকার মূল্যমান কমবে, যা ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে সহায়ক হবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি খাতে প্রবৃদ্ধি যাতে কোনভাবেই সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি না হয় এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সংযত মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে প্রচিলত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুদের হারের মধ্যে ব্যবধান যে শতকরা ৫ ভাগ রয়েছে তা সঙ্কোচনের ব্যাপারে কেউ কেউ মত প্রকাশ করে থাকেন, যা মোটেই সঠিক নয়। এতে ব্যাংক লভ্যাংশ হারাবে, যা স্থায়িত্বশীলতার জন্য বিশেষ হুমকি বলে প্রতীয়মান। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসছে, তা হলো কোন প্রকার মূল্যায়ন কিংবা নীতি গবেষণা ছাড়াই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ধারায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করে চলছে বছরে দু’বার, যা সঠিক নয়। আবার মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সকল হাতিয়ার ব্যবহার করছে তার মধ্যে গুণগত হাতিয়ারের ব্যবহারের কোন কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায় না, অথচ নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যাংক পরিচালনার জন্য সেগুলোর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক লেনদেন খাতে স্থিতিশীলতার কারণে স্বল্পমেয়াদী ঝুঁকিও অনেকটা বেড়েছে এবং আমদানি ব্যয়ের আকস্মিক স্ফীতি বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ঘাটতি তৈরি করেছে যাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। এখন জিডিপিতে সূচনা হওয়া গতিশীলতা ধরে, রাখার স্বার্থেই মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক লেনদেনের খাতে স্থিতিশীলতার ওপর চাপের বর্ধিত ঝুঁকি উপশম করে সহনীয় মাত্রায় নামানো প্রয়োজন। তবে সরকার প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অর্জন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রণীত এ মুদ্রানীতিতে বিতর্কের তেমন অবকাশ নেই, যা মাঝে মাঝে পরিবর্তন করতে হয় অর্থনীতির চাহিদা বিবেচনা করে। তবে এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা আগামী ছয় মাসের একটি ধারণা পাবে, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। এখন শুধু দেখার বিষয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রণীত এ মুদ্রানীতি সরকারী ঋণের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টায় বিনিয়োগে কি প্রভাব ফেলে। লেখক : গবেষক
×