ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অরুণ কুমার বিশ্বাস

ভালবাসা আজকাল!

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভালবাসা আজকাল!

রম্যের শুরুতে একটা রসোময় গল্প না বললে নয়। যারা রসজ্ঞ তারা বিলক্ষণ বুঝবেন, উপদেশের চেয়ে উদাহরণ ভাল। বড়লোকের এক সুশ্রী, বিদূষী ও প্রিয়ংবদা মেয়ে বাবাকে গিয়ে আদুরে গলায় বলল, বাবা বাবা, তুমি আমার জন্য একটি বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও ভালমানুষ গোছের বর এনে দাও। তাকেই আমি বিয়ে করব। বাবা কী যেন ভাবলেন। তারপর মিয়ানো গলায় উত্তর দিলেন, মা জননী, এই আমাকে ঠেকালে তুমি। ভালবাসার জন্য ছেলে আমি অনেক খুঁজে দিতে পারি। তবে বর খুঁজতে আমি পারব না। কারণ বুদ্ধিমান ছেলেরা আজকাল খুব একটা বিয়ে করে না, ওরা ক্যারিয়ার গড়ে। শুধু কি তাই, এমনও দেখবেন, একটু পদোন্নতি বা মওকা মতো পোস্টিং বাগানোর ধান্ধায় চালিয়াত ছেলেরা আজকাল শ্যালিকাকে বউ সাজিয়ে পার্টিতে নিয়ে যায় বসের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। বস খুশি তো চাকরিতেও দুরমুশ, মানে আপনি কাজকাম যাই করেন, কলিগদের সমানে মুগুরপেটা করে তরতরিয়ে উঠে যাবেন করপোরেট মইয়ে। তো যা বলছিলাম, আজকাল ভালবাসা শব্দটিও যেন আর নিখাঁদ নেই, সেখানে ভেজাল মিশে গেছে। আবার কারও কারও প্রেমে আবেগের চেয়ে বেগ বেশি। দু’চারদিন দেখা-সাক্ষাত করেই অমনি সলিড কিছু পেতে চায়। বস্তুত বিয়ে অব্দি গড়ায় খুব কম সম্পর্ক। কারণ প্রেমের বাহুডোরে যাকে খুশি বাঁধা যায়, কিন্তু বিবাহ! অনেকটা সেই শিয়ালের লেজ কাটা যাবার মতো। একবার কাটা গেলে বন্ধুসমাজে মুখ দেখানো দায়। তাই একটু পরখ করে দেখবেন, আগের মতো ছেলে-ছোকরারা এখন আর দুদ্দাড় বিয়ে করে না। সময় নেয়, দেখে-চাখে, তারপর সবদিক মিলে গেলে তবে ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে এত্তেলা পাঠায়। অনেকেই আবার সখেদে রবি ঠাকুরের সুরে গেয়ে ওঠেন, সখি, ভালবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই যাতনাময়! খাসা প্রশ্ন বা খেদ যাই বলুন। সত্যিই তো, ভালবাসলে কি একটুও সুখ পেতে নেই! পুরোটাই অর্থহীন প্যানপ্যানানি! উঁহু, অতটা হতাশাবাদী হতে আমি কিন্তু রাজি নই। কেউ কেউ আবার বলেন, ভায়া, সেই চ-ীদাস-রজকিনী, শিরি-ফরহাদ কিংবা সেলিম-আনারকলির যুগ কি আর আছে! এখন তো বলতে গেলে দাঁড়িপাল্লায় মেপে প্রেম হয়। বেশ মেপেজুপে পঞ্জিকা দেখেই তবে কপোত-কপোতীরা ডেট করে, একে অপরকে ভেট পাঠায়। মোদ্দা কথা হলো এই, প্রেম আজকাল মনে নয়, বরং মগজ থেকে উৎসারিত হয়ে কোথায় প্রোথিত হয় কে জানে! ভালবাসার উপযুক্ত পরিবেশ পরিম-লেরও অভাব এখন। শর্টকাটের যুগ চলছে বাবা। সময় নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেম করার টাইম কি আর আছে! ফেসবুকে সমানে প্রেম হচ্ছে, টুকটাক আলাপ থেকে দুদিনে জমে যাচ্ছে আবেগের ক্ষীর। এর নাম টুঙ-টাঙ প্রেম। ইনবক্সে মেসেজ এলো, হাই জান, আই’ম ডায়িং ফর ইউ। আগেকার দিনে এই অব্দি পৌঁছতে বলতে গেলে একযুগ বা তারও বেশি সময় গড়িয়ে যেতো। আর এখন! এ যেনো কব্জির মোচড়ে গুগলি প্রেম। ভাবিকালো আরও কী হবে কে জানে! এখন তরুণ-তরুণীর প্রেম হয় বদ্ধ প্রকোষ্ঠে বা ধাবমান উত্তোলকযন্ত্রের মাধ্যমে। কী, ঠিক মালুম হয়নি তো! বদ্ধ প্রকোষ্ঠ বলতে এটিএম বুথ, খালি ক্লাসরুম, চীনে রেস্তোরাঁর জম্পেশ আলো-আঁধারি কিংবা ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রিকশামামাকে হুড তুলে দিয়ে একরকম আরোপিত রোম্যান্সঘর বানানো যেতে পারে। আবার ধরুন লিফট নয়তো ক্যাপসুলে করে ওরা উঠে গেল অনেকটা উঁচুতে। সেই ওঠানামার ফাঁকে টুক করে প্রেম হয়ে গেল। এর নাম রেডিমেড ভালবাসা। মনে হতে পারে, আমি ইনিয়ে বিনিয়ে বানিয়ে বলছি সব, আদতে মোটেও তা নয়। জহুরির চোখ, মানে লেখকের চোখ দিয়ে দেখি আর অনুভব করি, ভালবাসা আজকাল কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। অমর কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলতে হয়, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়। আমি বলি বড় প্রেম আজকাল কাছে টানা দূরে থাক, কখনও কখনও রীতিমতো গলায় ফাঁস লাগিয়ে গাছেও তোলে। সেই প্রেমে না আছে আঠা, না হয় মোয়া। সম্পর্কের সুতোয় অমনি ফেঁসো উঠে যায়, রং উঠে গিয়ে ফেকাসে, দুদিন যেতে না যেতেই কী পেয়েছি কী পাইনির হিসাব-কিতাব শুরু হয়। ফলে যারা ভাগ্যবান তাদের ভাব-ভালবাসা বিয়ে অব্দি হয়তো গড়ায়, কিন্তু বছর না পেরোতেই তারা আবার বিবাহবিচ্ছেদ পার্টির আয়োজন করে বসে। মানে সেই পুনর মূষিকও ভব। যারা অফিসমুখী তারা কিনা আবার প্রেমটাকে অনেকটা পার্ট-টাইম হিসেবে নিয়েছে। এ প্রেম বাজেট প্রেম। অল্প খরচে বেশি আবেগ দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। করপোরেট জগতে এর মাখামাখি বেশি দেখা যায়। না, এখানে অবশ্য চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মিছে আকচাআকচি নেই। বরং উইন-উইন সিচুয়েশন বিরাজ করে। বসের সঙ্গে তার পারসোনাল সহকারীর কুসুমগরম প্রেম। যারা কিঞ্চিত মোটাবুদ্ধির অধিকারী তাদেরটা চোখে পড়ে, আর যারা বেশি চালিয়াত তারা কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই বেশ সম্পর্কের রেশ টেনে রাখেন। বলতে নেই, প্রেমের জগতে ‘পরকীয়া’ বলে একটি শব্দ চালু আছে। এটা অনেকটা ফরমালিন লাভের মতো, মানে যারা প্রকৃত প্রেমে বিশ^াসী, তারা এই জাতীয় সম্পর্ককে বড্ড ধুচ্ছাই করেন। এই সম্পর্কের শুরুটা ভাল, কিন্তু শেষটা বড্ড পীড়াদায়ক। ফলে সংসারে ভাঙচুর শুরু হয়, ঠিকঠাক মেনটেন করতে পারলে এককথা, আর না পারলে প্রতিবেশীর কাছে পাঁচকথা শুনতে হয়। লোকলজ্জা বলেও তো কথা আছে নাকি! শেষে বলি, এবম্বিধ বাতচিৎ শুনে এমন ভাববে না যে খাঁটি প্রেম একেবারেই নেই। আলবাত আছে। তবে তার গতিধারা অতীব ক্ষয়িষ্ণু। ভালবাসা কীসে হয়! আমার সোজাসাপটা জবাব- এমনি এমনি হয়। বলেকয়ে প্রেম হয় না। প্রেম যার হয় তারই হয়। ভালবাসা হতে বস্তুত কোন কারণ লাগে না। তাই তো বলে, যেখানে যার মজে মন, কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম! প্রেম জাতপাতের ধার ধারে না, সময় বা ভৌগোলিক দূরত্ব মানে না। সাত-সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপার থেকে সুপারসনিক স্পিডে একজন ছুটে আসে তার প্রেমাষ্পদের জন্য। সমরনীতির ভাষায় স্বাধীনতা পাওয়া কঠিন, কিন্তু তা রক্ষা করা আরও কঠিন। প্রেমও তাই। ভালবাসা হয়ে গেলে বেশ ভাল। তা টিকিয়ে রাখা কিন্তু সহজ কাজ নয়। একে অপরকে রীতিমতো তোয়াজ করতে হয়। গাছের চারার মতো নিয়মিত পরিচর্যা মানে আলো, পানি ও মাটির জোর ধরে রাখতে হয়। নইলে কিন্তু কুঁড়িতেই মরে যায় বড়ই স্পর্শকাতর এই প্রেম। ভালবাসা নিয়ে হেলাফেলা করতে নেই। কবি কাজী নজরুল যথার্থই বলেছেন, ভালবাসাকে যারা অসম্মান করে তারা জীবনে কখনও ভালবাসা পায় না। আর আমাদের জীবনে ‘ভালবাসা ছাড়া আর আছে কী’! তাই বলি কি, মিছে ইমিটেশন লাভ-এর চটকদার গহনা না পরে খাঁটি গিনিসোনা চিনে নিন। তাতে সময় নষ্ট হবে না, বরং জীবনে রং ছড়াবে। বছরে শুধু একটাই ভালবাসা দিবস কেন, প্রকৃত প্রেম তো মিশে থাকে প্রতি ক্ষণে প্রতি নিশ^াসে। তবে মনে রাখবেন, ভালবাসা মানেই কিন্তু বিশ^াস। সেখানে ঘাটতি থাকলে যতই সেজেগুজে আগুনরঙা ফাগুনে শাড়ি পরে আসুন না কেন, প্রেম কিন্তু টিকবে না, সে পালাবেই। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×