ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পতনের গান শুধু শোনা যায় -জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পতনের গান শুধু শোনা যায় -জাফর ওয়াজেদ

ক্ষমতার অপব্যবহারেরই নাম দস্যুবৃত্তি। ক্ষমতার অপব্যবহার মানবকে পরিণত করে দানবে। শক্তি মদে মত্ত হলে দেশ জাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে যেতে হয়। শক্তির প্রকাশ যথেচ্ছ ব্যবহারে নয়। যথার্থ শক্তির পরিচয় শক্তি সম্বরণে। আস্ফালন শক্তিমানকে মানায় না। সূর্য অপরিমেয় শক্তির উৎস। অগ্নিতাপে পৃথিবীকে ভস্মীভূত করতে পারে। কিন্তু প্রয়োজনবোধে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে স্তিমিত করে যাতে জীব-জন্তু, পশু-পক্ষী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা সকলেই জীবন ধারণ করতে পারে। যা বৃহৎ এবং মহৎ তা সব সময়ই শান্ত বিনীত। যা সুন্দর তারও স্বভাবটি মৃদু এবং বিনয়-নম্র। ফুল ফোটে নিঃশব্দে আর পটকা ফোটে সশব্দে। রবীন্দ্রনাথ কোনটা বলেছেন, সংসারের পরম আশ্চর্য ব্যাপারগুলো পরম নিঃশব্দে ঘটে। দুর্নীতির বিষয়গুলো নিঃশব্দে ঘটলেও তার প্রকাশ ঘটে সশব্দে। ক্ষমতার মদ মত্তে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে যাওয়ার মাসুল এক সময় দিতে হয়। তারই নজির দেখা গেল বিএনপি নেত্রী ও তারপুত্র এবং অন্যান্য সহযোগীদের ক্ষেত্রে। তাদের মধ্যে যে ব্যাধি বাসা বেঁধেছে, তাতে সুবুদ্ধির কাজ দুর্বুদ্ধিতে নষ্ট হয়েছে। ভেতরে তাদের পচন ধরেছে। রাজনীতিও তাদের নীতিবিহীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই দেখা যায়, বিএনপি নেত্রীর কাছে দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। আর ব্যক্তির চেয়ে পুত্র বড়। ফলে রাজনীতি পর্যবসিত হয়েছে দলাদলিতে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকা এই পুত্রই বিএনপি নেত্রীকে ডুবিয়েছে শুধু নয়, দলটিকেও ডুবিয়ে মারছে। ভেসে ওঠার সব প্রক্রিয়া করা হচ্ছে বিনষ্ট। পুত্র ও অন্য নেতাদের উদ্দাম উদ্ধত ব্যবহারের কারণেই কালস্রোত ক্ষণে ক্ষণে উত্তাল হয়ে মানব সমাজের উপরে আছড়ে পড়েছিল, এখনও পড়ছে। তার আগ্রাসী মনোভাব বিএনপি নেত্রীকেও শান্তিতে-সোয়াস্তিতে থাকতে দেয়নি, দিচ্ছে না। অসতর্ক, বিষম উত্তেজিত; বলতে গেলে উন্মত্ত। এরই ফলে বিএনপি নামক দলটির গণতান্ত্রিক বিকাশের পথটি হয়ে গেছে রুদ্ধ। এ কারণেই সমাজের শান্তিও বিঘিœত। দেশকাল হয় বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত। দেশবাসী তথা দলীয় নেতা-কর্মীদেরও কানাকড়ি মূল্য না দেয়া মাতা-পুত্র হয়ে গিয়েছিলেন দেশের ‘কা-ারি’। কিন্তু আদতে দেশ তাদের কাছে ছিল সম্পদ লুটপাট আর আখের গোছানোর উপকরণ। ধর্মীয় মৌলবাদকে হৃষ্টপুষ্ট করে তুলে তাদের হাতেই বন্দী হয়ে গেছে মাতা-পুত্র, এমনকি বিএনপি নামক দলটি। নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচী ফেলে জামায়াতে ইসলামী নামক যুদ্ধাপরাধী দলটিকে বক্ষে ধারণ করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োজিত থেকে সব কুলই হারিয়েছে। বিএনপি নামক দলটি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এখন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। ক্ষমতার মোহে অন্ধ বিএনপি নেত্রী জনগণের কাছে যেতে পারছেন না। পেট্রোল বোমায় মানুষ মেরে আগুন সন্ত্রাসের নেত্রী, জঙ্গীদের নেত্রী, সন্ত্রাসের নেত্রীতে পরিণত হয়ে তিনি আর রাজনৈতিক নেত্রীর স্তর থেকে দূরত্ব দূরে সরে গেছেন। কোন প্রচেষ্টাতেই আর স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় ফিরতে পারেননি। কারাগার তাকে হয়ত সংশোধনের পথ করে দেবে। সংশোধিত রূপে হয়ত তিনি বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু রাজনীতিতে ফেরার পথ অতি বন্ধুর। তাই ফিরতে চাইলেই তো আর ফেরা যায় না। দলের অনেক নেতাই চায় না তিনি আর রাজনীতিতে ফিরে আসেন। বিশেষত দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক পুত্রের অনুসারীরা। তাই মা যখন কারাগারে পুুুত্র তখন বিদেশের আলিশান প্রাসাদে রাজকীয় অবস্থানে। মায়ের কারাবন্দী তার স্বপ্নপূরণের পথ তৈরি করে দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হিসেবে পলাতক জীবন থেকে দলকে এককভাবে পরিচালনার মোক্ষম সুযোগ তার হাতে এসে গেছে। এটাই ছিল তার অনেক দিনের আকাক্সক্ষা। মাকে দুর্নীতির শিখ-ি বানিয়ে পুত্রটি দুর্নীতি, লুটপাটের স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল হাওয়া ভবন বানিয়ে। ‘মি. টেনপার্সেন্ট’ অবস্থা থেকে ক্রমশ ‘ফিফটি ফিফটি’ পার্সেন্টে উন্নীত হয়েছিলেন। এক-এগারোর সময় দুর্নীতির দায়ে কারাগারে অন্তরীণ হয়। ‘আর রাজনীতি করবেন না’ বলে মুচলেকা দিয়ে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে সেই যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন প্রায় দশ বছর আগে, আর দেশে ফেরার সাহসটুকু অর্জন করতে পারেনি। দুর্নীতিবাজ না হলে দেশে ফিরে এসে আইনের মুখোমুখি হওয়ারই কথা। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে নিজের কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে বিবৃতিও দিয়েছিলেন দুর্নীতির এই বরপুত্রটি। লন্ডনে বসে দেশে নাশকতা পরিচালনা, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, মাফিয়াদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন, সবই তিনি করে যাচ্ছেন। অনেক বিষয়ে মায়ের সঙ্গে মতভেদ হলেও মাতৃহৃদয় পুত্রের সব অন্যায়, অন্যায্য আবদারকে মেনে নিয়ে বেগম জিয়া দেশবাসীর কাছে নিজের অবস্থানকে করেছিলেন ঘৃণ্য পর্যায়ের। জনগণের ঘৃণার মাত্রা এতই যে, তার বিচারের রায় ও কারান্তরীণ হওয়ার বিষয়টি জনবিক্ষোভে পরিণত হয়নি। বরং জনগণ এতে সন্তোষই প্রকাশ করেছে। দুর্নীতির যে পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন মাতা-পুত্র ক্ষমতায় থাকাকালে, জনগণ তা ভালভাবে নিতে পারেননি, যেমন পারেননি হরতাল, অবরোধের নামে নির্বিচারে গণহত্যা চালানো, প্রতিপক্ষ রাজনীতিক, লেখক, শিক্ষক হত্যা করতেও তারা কসুর করেননি। ভেবেছিল, এই পথ ধরে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ক্ষমতা দখল করা যাবে। যেভাবে তাদের প্রতিভূ জান্তা শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এজন্য জিয়াকে হত্যাযজ্ঞে নামতে হয়েছিল সহযোগীদের নিয়ে। সেই পথ ধরেও মাতা-পুত্র কামিয়াব হতে পারেননি। ক্ষমতায় থেকে তারা যত দুর্নীতি করেছেন, তত মামলা না হলেও, এখনও বড় বড় দুর্নীতির মামলার বিচার কাজ চলছে। এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার কাজটি যারা করতে পারে, পরিমাণ যা-ই হোক, তাদের হাতে দেশ ও জাতি নিরাপদ নয়। ‘মানি ইজ নো প্রবলেমে’র যে আপ্তবাক্য জান্তা শাসক উচ্চারণ করছেন, মাতা-পুত্রের জীবনে এসে সেই অর্থ অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। তারা এই বাক্য ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করে যখন যেখানে অর্থ পেয়েছে, তা-ই সাবাড় করার জন্য লালসাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলায় তারা এতটাই নিবিষ্ট ছিল যে, দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারে কাছেও যেতে পারেনি। তাদের কথাই পরিণত হয়েছিল আইনে। ২০০৬ সালে বগুড়ার এক জনসভায় পুত্র ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগকে কচুকাটা করতে হবে। ইউটিউবে সেই ভাষণটি এখনও সংরক্ষিত। প্রতিহিংসা ও নৃশংসতার ভাষা কী রকম হতে পারে, এটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ বৈকি। মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত হবার পর দুর্নীতির বরপুত্রটি দেশে নাশকতা পরিচালনার কাজটি সুচারুরূপে করে আসছিলেন। কিন্তু বেশিদূর যাওয়া যায়নি। এই যে রায়ের পর লন্ডনে ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা ও জাতির পিতার প্রতি অবমাননা প্রদর্শনের কাজটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের নির্দেশেই ঘটেছে। মনের বিকার তাকে সব জিনিসই বিকৃত করে দেখায়। তাই অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতার চাপে পড়ে সরকার উৎখাতে এখনও ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। দলের প্রধান হর্তাকর্তার যে দায়িত্ব সে পেয়েছে এখন, তা থেকে সরে এসে মাতাকে দায়িত্ব দেবার মানসিকতা যেহেতু লালন করে না, তাই সর্বময় দলীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এখন ছড়ি ঘোরাবে দলে মায়ের অনুসারীদের দল থেকে বিতাড়ন করার কাজটিও চালু করতে যাচ্ছে। লন্ডনে বসে আদেশ-নির্দেশ দিয়ে নিজস্ব অনুসারীদের সামনের কাতারে নিয়ে আসাই তার প্রধান লক্ষ্য। প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা বাধ্য হবেন নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে কিংবা নতুন দল গঠনে। খালেদা-তারেক যে দুর্নীতি করেছেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা তা জানেন। এই কারণে দলের গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বাতিল করে দুর্নীতিবাজদের দলে অবস্থান সুদৃঢ় করা হয়েছে। এই ধারা বাতিল দলীয় সভায় গৃহীত হয়নি। যদিও এই দলে কোন সিদ্ধান্তই নির্বাহী কমিটির সভায় গৃহীত হয় না। সবই মাতা-পুত্রের ইচ্ছে আকাক্সক্ষার উপর নির্ভরশীল। বেগম জিয়া জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার রাজনীতির হাল ধরেন, এমনটা দলের অনেক সিনিয়র নেতা যেমন চাইছেন না, তেমনি হিংস্রতায় ভরপুর যার অন্তর, সেই পুত্রও আর চাইবে না। ক্ষমতার একচ্ছত্র স্বাদ পেতে পেতে এমনও হতে পারে, মাতাকে আর দল চালানোর সুযোগ দেবে না। বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ তো বলেছেনই, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়ের ফলে বিএনপিই লাভবান হয়েছে। কোন বিএনপি সেটা, তা খোলাসা করে না বললেও স্পষ্ট যে তারেক নেতৃত্বাধীন বিএনপি এখন লাভের হিসেব কষছে। পুত্র নেতৃত্বাধীন দলে মওদুদের অবস্থান কী দাঁড়াবে, তা নিশ্চয় তার অজানা নয়। তবে দুর্নীতির অভিযোগে মওদুদও অভিযুক্ত। জিয়া, এরশাদ আমলে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মওদুদের হাতে বিএনপির ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য। পুত্রকে এখন তাল দেবেন এক হাতে, আরেক হাতে বেগম জিয়াকে জেলে রাখার জন্য অন্যান্য মামলার উপর নির্ভর করবেন। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনকেও দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশে খালেদা জিয়া দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকার বহু বছর পর শাস্তি পেলেন। তার এই সাজাপ্রাপ্তিতে দেশবাসী অখুশি হয়নি এই কারণে যে, দেশে সুশাসন রয়েছে বলেই আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিরা যেভাবে জেলে আটক রয়েছেন সেভাবে বিরোধী নেতা নেত্রীরাও আইনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক বিবেচিত হয় না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে বেগম জিয়ার এই মামলার রায় অনেক আগেই হতো। সামনে আরও মামলা রয়েছে, সেসব মোকাবেলা করতে করতে বেগম জিয়া কারাজীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবেন। আর পুত্র চাইবে না বেরিয়ে এসে চেয়ারপার্সন হোক। সুতরাং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তাই মাতার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে পর্যুদস্ত করে জামায়াতসহ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কব্জায় ও বশে নিয়ে পুত্র উগ্র জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীতে পুরোপুরি পরিণত করবে বিএনপিকে। ফলে দলে যেসব নেতৃত্ব বিদ্যমান, তাদের সরে যেতে হবে। দলনেতা, যারা বুদ্ধিমান তারা দুর্নীতির মাতা-পুত্রের দাপট আর মেনে নিতে চাইবে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে তারেকের অবাঞ্ছিত, দুশ্চরিত্র মানুষের অবস্থান দুষ্টামি ও নষ্টামির দুয়ার খুলে দেবে। এসব প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে দলের চরিত্রকেই দূষিত করে ফেলেছে। ক্ষমতার লোভে মদমত্ত পলাতক দুর্নীতিবাজ তারেক প্রবাসে বসে যে দল চালাবে সে দল ক্রমশ উন্নতমানের সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়ে এক সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর সেই ধ্বংস থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন সময়ে নতুন দল। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে হবে একাট্টা।
×