ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালীর রক্তস্নাত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাঙালীর রক্তস্নাত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হোক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এতে ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ হন এবং ভাষার ব্যাপারে তাঁরা একটি চূড়ান্ত দাবিনামা প্রস্তুত করেন; দাবিটি হলো- পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও সরকারী কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা আর কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু। ভাষা সংক্রান্ত এই দাবিকে সামনে রেখে সর্বপ্রথম আন্দোলন সংগঠিত করে তমদ্দুন মজলিস। এর নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। ক্রমান্বয়ে অনেক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং এক সময় তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি স্মরণীয় দিন। গণপরিষদের ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া ছাড়া ও পাকিস্তানের মুদ্রা এবং ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাখার প্রতিবাদস্বরূপ ওইদিন ঢাকা শহরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটিদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা। ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই সেøাগানসহ মিছিল করার সময় শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল ওয়াহেদ প্রমুখ গ্রেফতার হন। আবদুল মতিন, আবদুল মালেক উকিল প্রমুখ ছাত্রনেতা ওই মিছিলে অংশ নেন; বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিশাল ছাত্র সমাবেশ হয়। একজন পুলিশের কাছে থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের আঘাতে মোহাম্মদ তোয়াহা মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ১২-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনের মুখে সরকারের মনোভাব কিছুটা নমনীয় হয়। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একাত্মতা পোষণ করেননি। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার দুটি সভায় বাংলা ভাষার দাবিকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সময় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানেই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। জিন্নাহর বক্তব্য তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়; এর আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। ১৯৫২ সালের শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাতে থাকে। ১৯৪৯ সালে সময়ের প্রয়োজনে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। পূর্ব পাকিস্তানে বঞ্চনা ও শোষণের অনুভূতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এ প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন একটি নতুন মাত্রা লাভ করেছিল। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন যে, প্রদেশের সরকারী কাজকর্মে কোন্ ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøাগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের এক সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কর্মসূচির আয়োজন চলার সময় সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে কি-না এ প্রশ্নে সভায় দ্বিমত দেখা দেয়। তবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সঙ্কল্পে অটুট থাকে। পরদিন সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের একাংশে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা হয়। সভা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ উপাচার্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। তবে ছাত্র নেতারা, বিশেষ করে আবদুল মতিন এবং গাজীউল হক নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ছাত্ররা পাঁচ-সাতজন করে ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøাগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে পুলিশ তাঁদের ওপর লাঠিচার্জ করে, ছাত্রীরাও এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসরমাণ মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত নিহত হয়। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাঁদের মধ্যে সেক্রেটারিয়েটের পিয়ন আবদুস সালাম মারা যায়। অহিউল্লাহ নামে আট/নয় বছরের এক কিশোরও সেদিন নিহত হয়। এ সময় গণপরিষদের অধিবেশন বসার প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলি চালানোর খবর পেয়ে গণপরিষদ সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ এবং বিরোধী দলের সদস্যসহ আরও কয়েকজন সভাকক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন বাংলা ভাষার দাবির বিরোধিতা অব্যাহত রেখে বক্তব্য দেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল গণবিক্ষোভ ও পুলিশি নির্যাতনের দিন। জনতা নিহতদের গায়েবানা জানাজার নামাজ পড়ে ও শোকমিছিল বের করে। মিছিলের উপর পুলিশ ও মিলিটারি পুনরায় লাঠি, গুলি ও বেয়োনেট চালায়। এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন শহীদ হন এবং অনেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। ছাত্ররা যে স্থানে গুলির আঘাতে নিহত হয় সেখানে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে এই অস্থায়ী নির্মাণের জায়গায় একটি কংক্রিটের স্থাপনা নির্মিত হয়। গণপরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে। ১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালীদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি উদযাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অপরিমেয়। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতির জীবনের এমন এক ঘটনা, সরকার দাবি মেনে নেয়ার পরও তার চেতনা শেষ হয়ে যায়নি। ওই আন্দোলন বাঙালীদের মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। সেই চেতনাই জন্ম দেয় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের- যা পরিণতি লাভ করে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের মধ্য দিয়ে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×