ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুবেল রেহান

সেদিন বাসন্তী হাওয়ায় পদ্মাপাড়ে

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সেদিন বাসন্তী হাওয়ায় পদ্মাপাড়ে

এবারের ভ্রমণের সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করেই নেয়া। ফেব্রুয়ারির শেষ, ছুটির দিন হওয়ায় দেখা করলাম লিংকন ভাইয়ের সঙ্গে, কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার পর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা মাথায় আসল। ব্যস উঠল বাই তো কটক যাই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সোজা তেজগাঁও, লোকাল ট্রেন ধরে জয়দেবপুর রেলস্টেশন। কোথায় যাব ভাবতে না ভাবতেই মাইকে ঘোষণা, ‘আর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই রাজশাহীগামী ট্রেনটি ছেড়ে যাবে।’ দুজন তাকালাম দুজনের দিকে। গন্তব্যটা যে তখনই মনে মনে ঠিক হয়ে গেল তা টের পেলাম প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ানো ধুমকেতু এক্সপ্রেস উঠে। নির্দিষ্ট আসনে চুপচাপ বসে আছি। হয়ত দুজনের মনেই ভাবনা আসলেই কি রাজশাহী যাচ্ছি? লিংকন ভাই হঠাৎ বলে উঠল অনেক দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল পদ্মাপাড়ে যাওয়ার। মনের নীরবতা ভেঙে আমিও আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম পদ্মা পাড়ের গল্প। তিনি বলে চলছেন, আর আমি কল্পনায় কেবল হাজির করছিলাম নিজেকে পদ্মাপাড়ে। সেসব কল্পনার সঙ্গে যোগ হলো নতুন জায়গা দেখার রোমাঞ্চ। তখনও ভাবিনি কতটা রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। ট্রেনের জানালার ফাঁকে দিনের শেষ রোদ্দুর এসে পড়ছিল মুখের ওপর। সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিমের আকাশে। যেন জানান দিচ্ছিল আজকের মতো ফুরিয়ে এসেছে তার সময়। ভাবছিলাম রাতটা কত তাড়াতাড়ি ফুরাবে আর আমি যাব পদ্মার পাড়ে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা মনে নেই। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে নেমে যাওয়া। তাকিয়ে দেখি রাজশাহী নয়, ঈশ্বরদী। রাত তখন ১২টা। অতপর অপেক্ষা। রাত দুটোর ট্রেনে চেপে পৌঁছালাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন তখন ঝিমুচ্ছে। পেটে ক্ষিধে। খুঁজে পেলাম খাবারের দোকান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে রিক্সা যাত্রা পরিচিত একজনের বাসায়। রাতটা আপাতত ওখানেই কাটাব। অন্ধকার আর কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে চোখের সামনে উদ্ভাসিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। শহরের রাস্তায় নেমে আবিষ্কার করি অন্যরকম কিছু। রাজশাহী সম্পর্কে এতদিন যা জানা ছিল তার থেকেও বেশিকিছু মনে হলো। গোছানো আর পরিচ্ছন্নতার জন্য রাজশাহী বিখ্যাত একটি শহর। কিন্তু এতটা পরিপাটি আর মনোরম, না দেখলে অজানাই থাকত! হয়ত রাজধানীতে বসবাসকারী আমরা কেবল জানি শহর বলতে একটি অপরিষ্কার, জ্যাম, কংক্রিট, দেয়াল আর শব্দদূষণে ভরা। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করতে রাজশাহী শহর চমৎকার উদাহরণ! আয়তনে ছোট শহর রাজশাহী। শহরের এই আয়তন স্বল্পতা অবশ্য বিনোদন ব্যবস্থাকে স্বল্প করতে পারেনি। প্রথমে হাজির চিড়িয়াখানায়, কয়েক ঘণ্টা ঘোরাঘুরি সেখানে। পাশেই অত্যন্ত সুন্দর পরিপাটি একটি পার্ক। পার্কের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে লেক। সেখানে সুযোগ আছে নৌকা করে ঘোরার। এ পার্কটি পরিণত হয়েছে বিনোদন পিয়াসীদের অন্যতম আকর্ষণে। এ শহরে ঘুরতে আসা সবাই একবার হাজিরা দেন এখানে। আর শহরবাসীদের কাছে এটি বিনোদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ওখান থেকে বের হয়ে রিক্সা চেপে শহরের অলিগলি ঘুরে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম কাক্সিক্ষত সেই পদ্মাপাড়ে। নদীর পাশে নির্মিত হয়েছে সুপরিকল্পিত বাঁধ। যেখানে হেঁটে অথবা রিক্সা নিয়ে ঘুরে দেখা যায় পুরোটা। যা হোক আমরা বাঁধের ওপর দিয়ে এগোলাম পদ্মার কাছে। বুকের গভীরে হয়ত একান্ত আকাক্সক্ষা নদী ছুয়ে দেখার। নদীকে আলিঙ্গন করার। কিন্তু নদীর কাছে যাবার আগেই আমরা আলিঙ্গন পেলাম অন্যকিছুর। না এ অন্যকিছু কোন সাধারণ কিছু না। এটা যে বসন্তের বার্তা নিয়ে ফোঁটা শিমুল ফুল। ফুলের ওজনে নুয়ে পড়া গাছের ডালপালা আর ঝরে পড়া ফুল রাস্তার দুপাশকে সাজিয়েছে ফুলেল শোভায় যেন ফুলের ছাউনি দিয়ে ঘেরা রাস্তাটি। বসন্তের পদ্মা প্রস্তুত বরণ করে নিতে তার দর্শনার্থীদের। বসন্ত আসি আসি করছে দক্ষিণা বাতাস আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে শরীরে। রূপসী পদ্মার স্রোতে তখন বসন্তের ভাষা। প্রায় দুপুর। স্থানীয় লোকজন গোসল করছেন নদীতে। কেউ বা দিনের ব্যস্ততা দূরে রাখতে জিরিয়ে নিচ্ছেন পদ্মার পাড়ে থাকা শিমুল তলায়। পদ্মার যে পাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে সেটা কিছুটা উঁচু। জায়গার নাম বড়কুঠির পদ্মাপাড়। সেখান থেকে আশপাশের প্রায় কয়েক কিলোমিটার দেখা যায়। চোখ যতদূর যায় কেবল অবারিত প্রশান্তি। নদীর ওপর দিয়ে উড়ে চলা গাঙচিল কিংবা উপারে সাদা বকের ছড়াছড়ি, এসব শুধু চোখের তৃপ্তিই নয় আত্মার তৃপ্তিও বটে! চাইলে আপনি সে সময় হয়ে যেতে পারেন কবি কিংবা কোন প্রেমিক। যে কবি কবিতা লিখবে সাদা বক কিংবা গাঙচিল নিয়ে। প্রেম রচনা করবে নতুন কোন প্রকৃতির। এখানে নৌকা ভ্রমণের জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। পঞ্চবুটির ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরে দেখা যায় মন চাইলেই। এছাড়া সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত ছোট ছোট স্ন্যাকস, ফুসকা আর চায়ের দোকান যেন বাড়িয়ে তুলছিল পদ্মা পাড়ের সৌন্দর্য। শহরের মানুষ বিকেল হলেই ছুটে আসে আড্ডা দিতে, সে আড্ডা চলে রাত পর্যন্ত অবিরাম। এছাড়া রয়েছে বিজিবির গড়া সুন্দর একটি পার্ক নতুন মাত্রা যোগ করেছে রূপসী পদ্মার রূপে। এ সুন্দরীর চোখে কাজল। চারপাশে চোখ মেললেই উৎসবের ঢেউ। ছড়াবে মুগ্ধতা আর জলরাশির ফোয়ারা। নদীর পাড় ধরে হাটছি। ওপরে খোলা আকাশ আর নিচে বিস্তৃত জলরাশি, মাঝে মাঝে জেগে ওঠা বালুচর যেন টানছে অমঘ আকর্ষণে। শহরের একদিকের বাঁধ ছুয়ে বয়ে চলা পদ্মার জলরাশি। অন্যদিকে প্রকৃতি মেলেছে তার রূপের হাঁট। হাল্কা গরমে ক্লান্ত হওয়ার উপক্রম। ঠিক তখনই লিংকন ভাই বললেন চল নদীতে নেমে পরি। কথা মতোই দুজনে নেমে পড়লাম নদীতে। কিছুক্ষণ সাঁতার কাটা। ওখানকারই কেউ একজন সতর্ক করল নদীর মাঝখানে না যেতে। কারণ নদীর অনেক জায়গায়ই বেশ গভীর। অসতর্ক থাকলে হঠাৎ স্রোত তলিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এমন ঘটনা হয়েছেও আগে। নদীতে নামতে সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। এটা শুনে সাহস পেলাম না আর নদীতে থাকতে। ওদিকে বিকেলও গড়িয়ে পড়ছে। সময় হয়েছে আমাদের ফেরার...। অপেক্ষায় প্রাণহীন এক ইট-কাঠের নগরী ঢাকা। তবে ভয় নেই মনজুড়ে আছে পদ্মা পাড়ের বসন্ত বাতাস। যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে রাজশাহী যেতে ট্রেনে অথবা বাসে করে যাওয়া যায়। ট্রেনের ভাড়া পড়বে ৩৫০-৫৫০ টাক পর্যন্ত। আর বাসের ক্ষেত্রে ৫৫০ টাকা করে যাওয়া যায়। এছাড়া দেশের যে কোন জেলা থেকে যেতে চাইলে আগে রাজশাহী শহরে পৌঁছাতে হবে। আপনি যদি একদিনের ভ্রমণে যেতে চান তাহলে বাস অথবা রেলস্টেশনে নেমে যে কোন লোকাল বাহনে করে পদ্মার পাড় যেতে পারবেন। এ ছাড়া পুরো রাজশাহী শহর ঘুরে দেখতে চাইলে শহরে পৌঁছে যে কোন একটি ভাল হোটেল অথবা রাজশাহী পর্যটন মোটেলে উঠতে পারেন। সেখান থেকে আপনি ইচ্ছে মতো ঘোরাফেরা করতে পারবেন। রাজশাহী ছোট শহর হওয়ায় আপনাকে কোন জায়গা খুঁজে বের করতে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। লোকাল বাহন চালকদের বললেই আপনাকে নিয়ে যাবে নির্ধারিত স্থানে।
×