ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির কর্মীরা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছেন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিএনপির কর্মীরা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছেন

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ৮ ফেব্রুয়ারির ঘোষণার দিনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াত জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মীরা গ্রেফতার এড়াতে এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গত ৩ ফেব্রুয়ারিতে লা মেরিডিয়ান হোটেলে অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির সভায় দলের নেতা-কর্মীদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানোর মধ্যেই আতঙ্ক, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে বলে পুলিশের দাবি। এদিকে খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি ও তার আগে পরে যাতে জঙ্গী, সন্ত্রাসী, দলীয় ক্যাডার, ওয়ারেন্টের আসামি, অপরাধীদের ধরতে পুলিশ রাতের বেলায় চেকপোস্ট বসিয়ে বাড়িতে হোটেলেসহ সন্দেহজনক অবস্থানে ব্লকরেইড দেয়াসহ নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি বিজিবি ও দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান বিশেষ অভিযানসহ প্রস্তুতির সকল ঘটনা দৃশ্যমান হবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে নাশকতা, নৈরাজ্য ও সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে জমায়েত হতে দিবে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দফতরে ও ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ৮ ফেব্রুয়ারিতে জানমালের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈঠক করেছেন। রাজধানীতে ১০ হাজারেরও বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হতে পারে রায় ঘোষণার দিনটিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, বেগম খালেদা জিয়ার ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ও রায়ের আগে পরে যাতে সহিংস ঘটনা এড়ানো যায় সেজন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশবাসীর নিরাপত্তা বিধানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশে র‌্যাব-পুলিশ সতর্ক ও কঠোর অবস্থানে থাকবে। রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে স্পর্শকাতর জেলা এলাকাগুলোতে বিজিবি ও দাঙ্গা পুলিশ নামানো হতে পারে। স্পর্শকাতর এলাকা ও স্থাপনাগুলোতে বাড়ানো হচ্ছে গোয়েন্দা নজরদারি। অরাজকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- রোধে শুধু রাজধানীজুড়ে মোতায়েন থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১০ হাজারের বেশি সদস্য। পুলিশ সদর দফতর থেকে সতর্কাবস্থায় থাকার জন্য জেলা পুলিশ সুপারদের কাছেও জরুরী বার্তা পাঠানো হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রায়কে সামনে রেখে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে হবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে কোনোরকম অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ কাউকে দেয়া হবে না। রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতিরোধ নয়, এ ধরনের কর্মসূচীকে সামনে রেখে যারা নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করবে তাদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। রায় ঘোষণার দিন কেউ গাড়ি চালাতে না চাইলে যেমন পুলিশ বাধ্য করবে না, ঠিক তেমনই রাস্তায় গাড়ি নামাতে চাইলে অবশ্যই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে কেউ যাতে রাস্তায় নামতে না পারে সেজন্য মোড়ে-মোড়ে থাকবে দাঙ্গা পুলিশ। থাকবে র‌্যাব সদস্যরাও। খালেদার রায় ঘোষণাকে ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা ছাড়াও প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ৪৯ থানার ওসিকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হবে। পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও মাঠে নামানো হবে। চোরাগোপ্তা হামলা, বিশৃঙ্খলাসহ যে কোনো ধরনের নাশকতা মোকাবেলায় ডিএমপির ৩২টি স্পর্শকাতর পয়েন্টে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স, দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হতে পারে। অধিকতর স্পর্শকাতর স্পটগুলোকে কাঁটাতারের রোড ব্লকার দিয়ে ঘিরে রাখার জন্য প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। রাস্তায় থাকবে আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি), রায়ট কন্ট্রোল কার (আরসিসি) ও জলকামান, এ্যাম্বুলেন্স। রাজধানী ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্পটে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন ও পথচারী তল্লাশি করবে পুলিশ ও র‌্যাব। সচিবালয়েও কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। রাজধানীর গুলশান থেকে বক্সীবাজার পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা গড়ে তোলা হবে যা চোখে পড়ার মতো। বক্সীবাজারের যেই আদালতে রায় ঘোষণা করা হবে সেই এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। ওই এলাকায় তল্লাশি করে বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে। বেগম খালেদা জিয়ার রায়ের দিন নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যাতে কোন নৈরাজ্য ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্যই এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পুলিশ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার দিনে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় গোটা নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হবে। গোটা রাজধানীকে ৯টি সেক্টরে ভাগ করে রায়ের দিনের অরাজকতা ঠেকানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২০টি ভিডিওচিত্র ও আলোকচিত্র গ্রাহক দল কাজ করবে। তারা খালেদা জিয়ার সমর্থনকারীদের নামে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি তুলে রাখবে। পরে ছবি দেখে যাতে দোষীদের গ্রেফতার করা যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা ও নজরদারি শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মাঠের কর্মী বলে পরিচিত ও অতীতে যারা পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার আসামি তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে গত এক মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমণ, প্রিজনভ্যানে ভাংচুর, পুলিশের মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ, যানবাহনে ভাংচুর করার মামলার এজাহারে নামোল্লেখ করা ছাড়াও আসামির সংখ্যা কয়েক হাজার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালিয়ে আসামিদের বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না বলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে এমন ধরনের তথ্য জানিয়েছেন অভিযান পরিচালনাকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। ডিএমপি সূত্র জানান, শুধু রাজধানীতে গ্রেফতার এড়াতে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী আত্মগোপনে চলে গেছে। পুলিশ ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশকে মারধর করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের গ্রেফতার করার ঘোষণা দেয়া হলেও তাদেরকে বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার ৪৯ থানা পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গত ক’দিন ধরেই নগর জুড়ে তৎপর রয়েছে। তারা বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের তালিকা ধরে খোঁজ করছে। দিনে-রাতে চলছে পুলিশের এই অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি। এই অভিযানের ফলে জাতীয় নেতা থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও এখন আত্মগোপনে চলে গেছে। নিজের বাসায় না থেকে অন্যত্র অবস্থান করছেন নেতা-কর্মীরা। ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা দূরে কোথাও না গিয়ে আশপাশেই বন্ধুর বাসায় রাত যাপন করছেন। কিন্তু দিনের বেলায় পুনরায় তারা নিজ বাসায় ফিরে আসছেন। অধিকাংশ বিএনপি নেতাকর্মী তাদের মোবাইলে অপরিচিত নম্বরের কল রিসিভ করছে না। নিজের বাড়ি থেকে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। কেউবা আবার গ্রেফতার এড়াতে পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবান বা রাজধানীতে পারিবারিক ভ্রমণ করছে, আবার কেউবা বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি রাজনীতির নামে বরাবরই সহিংসতা আর নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। তারা আন্দোলনের নামে জ¦ালাও পোড়াওসহ ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালনা করে। এছাড়াও বিএনপি নেতাকর্মীরা সবার আগে টার্গেট করে পুলিশ সদস্যদের। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের হাজিরাকে কেন্দ্র করে লোক সমাগম ঘটায়। গত এক মাসে তারা ২টি ঘটনা ঘটাল। এর আগে সচিবালয়ের সামনে পুলিশ সার্জেন্টের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় তারা। এরপর গত সপ্তায় পুলিশভ্যানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও পুলিশ সদস্যদের মারধর করে। এ ঘটনায় পৃথক ২টি মামলায় ৯শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে-ঘটনায় যারা জড়িত, কেবল তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা হয়েছে যার মধ্যে নাম উল্লেখ করা ছাড়াও আসামির সংখ্যা কয়েক হাজারের মতো। রাজধানী ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা জেলা ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা ও জেলা এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা বিগত দিনে আন্দোলনে, মাঠে সক্রিয় থেকে সহিংস সন্ত্রাসে জড়িয়েছেন তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছেÑ মাত্র দুই দিন আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে বেগম খালেদা জিয়া ৮ ফেব্রুয়ারিতে তার মামলার রায়কে সামনে রেখে রাজধানীর বিলাসবহুল হোটেল লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও বেঈমানী না করার যে আহ্বান জানিয়েছেন। নেত্রীর আহ্বান জানানোর মাত্র তিন দিনের মাথায় বিএনপির নেতাকর্মীরা তো বটেই, ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছে। এতে ৮ ফেব্রুয়ারিতে রায় ঘোষণার দিন নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, বেগম খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে যাতে বিশৃঙ্খলা রোধে জননিরাপত্তার জন্য রাজধানীতে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। জানমালের নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যা করণীয় তার সবটুকুই করা হবে। নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও সহিংস সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া হলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
×