ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুপ্রীমকোর্টে সংবর্ধনা

রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করে যাব ॥ প্রধান বিচারপতি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করে যাব ॥ প্রধান বিচারপতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন,বিচার বিভাগের অগ্রসরতার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন আমি তার সব করার চেষ্টা করব। রাষ্ট্রের প্রধান তিন অঙ্গ- বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের চেষ্টা তিনি করে যাবেন। আমার জীবনের স্মরণীয় এ মুহূর্তে আমি স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের, আমার পিতা-মাতার অমূল্য অবদানকে স্মরণ করছি।’ একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদের তাজা প্রাণের রক্ত নহর আর ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভ্যেম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করে আমি আজ ধন্য ও গর্বিত। প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেয়ার পর রবিবার ওই দায়িত্বের প্রথম দিনে সুপ্রীমকোর্টের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি মাহমুদ হোসেন এ কথা বলেন। এর আগে রবিবার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ সময় তার সঙ্গে আপীল এবং হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতিরাও এজলাসে অংশ নেন। ১০টা ৪০ মিনিট থেকে ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য দেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তারপর ১১টা ৫ থেকে ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য দেন সুপ্রীমকোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন। আর তারপর বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। রেওয়াজ অনুযায়ী আপীল বিভাগের ১ নম্বর বিচারকক্ষে নতুন প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। উভয় বিভাগের বিচারপতি ছাড়াও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নতুন প্রধান বিচারপতি প্রথমদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত ৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। এরপর দুপুরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান তিনি। এরপর বিকেলে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। এ সময় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আপীল বিভাগের বিচারপতিরাও ছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের এমন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে যেন, আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তিমান-দুর্বল, ধনী-গরীব সকলের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সকলেই সমান এবং আদালতের কাছ থেকে শুধু আইন অনুযায়ী ন্যায্য বিচার পাবেন। এতে করে আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা দৃঢ় হবে। বিচারকদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সততা। তার জবাবদিহিতার জায়গা হচ্ছে বিবেক। সংবিধান ও দেশের আইন তার একমাত্র অনুসরনীয়। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, মামলা জটই এখন আদালতের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি অকারণে মামলা মুলতবি, প্রত্যাহারের প্রবণতা পরিহার করতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ সময় সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের আইন প্রণয়ন অপরিহার্য বলেও উল্লেখ করেন নতুন প্রধান বিচারপতি। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে যে, আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তিমান দুর্বল, ধনী-গরীব সকলের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সকলেই সমান এবং আদালতের কাছ থেকে শুধু আইন অনুযায়ী তারা ন্যায্য বিচার পাবেন। এতে করে আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা দৃঢ় হবে।’ নতুন প্রধান বিচারপতির মতে, মামলা জটই এখন আদালতের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ‘এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি অকারণে মামলা মুলতবি, প্রত্যাহারের প্রবণতা পরিহার করতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশনের পথে অগ্রসর হতে হবে।’ এ অবস্থা চললে বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে ॥ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কয়েক বছর ধরে দেশের বিচার বিভাগের ‘অবক্ষয়’ ঘটছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। তবে নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন যেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন, দৃঢ় পদক্ষেপ নিলে তার পক্ষে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, অনেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর স্থিতাবস্থা বজায় রেখে নির্বিঘ্ন মেয়াদ পার করতে চান এবং তা অনেক সময় অসম্ভবও নয়। কিন্তু ইতিহাসে তারাই বেঁচে থাকেন, যারা চিন্তা জগতে পরিবর্তন আনতে চান, সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চান। ‘সংবিধানের বিধানমতো আপনি ২০২১ সালের শেষ দিন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকবেন। এটা দীর্ঘ সময়। আমাদের বিচার বিভাগের বর্তমান যে অবস্থা, আপনার এই সময়কালে তাতে আপনি আমূল পরিবর্তন আনতে পারেন। যদি এ বিষয়ে আপনি দৃঢ় পদক্ষেপ নেন।’ সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতিকে মাহবুবে আলম এই ভূ-খন্ডে জনগণের ‘বহুদিনের চিন্তা চেতনার ফসল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। আর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণকে সংবিধান-বহির্ভূত ও বেআইনী ঘোষণার রায়কে বর্ণনা করেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য ‘রেনেসাঁ’ হিসেবে। ‘কিন্তু বেশ কয়েক বছর যাবত আমাদের বিচার বিভাগের অবক্ষয় ঘটেছে। সাধারণ জনগণের কাছে এ আদালতের যে ভাবমূর্তি ছিল, তাতে পরিবর্তন ঘটেছে।’ আগাম জামিনে ‘বিশেষ দৃষ্টি’ ॥ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন ‘পুলিশের গ্রেফতার ও নির্যাতন’ থেকে রক্ষার জন্য আগাম জামিনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির ‘বিশেষ দৃষ্টি’ আশা করেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে ঢালাওভাবে হাজার হাজার লোককে নির্বিচারে আসামি করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা চলছে। সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট অবশ্যই পুলিশের গ্রেফতার ও নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য আগাম জামিনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাবেন বলে আমরা আশা করি। এ বিষয়ে আপনার বিশেষ দৃষ্টি থাকবে বলে আইনজীবী সমাজ মনে করে এবং আশা করে।’ প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিএনপিপন্থী এ আইনজীবী বলেন, গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত হচ্ছে স্বাধীন বিচার বিভাগ। কিন্তু দেশের বিচার ব্যবস্থা, বিশেষ করে নিম্ন আদালত এখনও ‘সরকারী প্রশাসনের প্রভাব বলয়ে’ আটকা। ‘এই অবস্থা থেকে বিচার ব্যবস্থাকে বের করে আনা আপনার জন্য হবে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’
×