ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খালেদার ৬ শর্ত কি নির্বাচন বর্জনের আগাম ইঙ্গিত?

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

খালেদার ৬ শর্ত কি নির্বাচন বর্জনের আগাম ইঙ্গিত?

শরীফুল ইসলাম ॥ খালেদা জিয়া জেলে থাকলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করবে বিএনপি। আর এ জন্যই ৮ ফেব্রুয়ারির মামলার রায়ে সাজা হবে এমন আশঙ্কা থেকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় ৬ শর্ত দিয়ে নির্বাচন বর্জনের আগাম ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সভায় প্রয়োজনে শীর্ষ পদে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়ার কথা আলোচনা হলেও আপাতত খালেদা জিয়াই চেয়ারপার্সনের দায়িত্বে থাকার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার দেয়া ৬ শর্তের একটি হচ্ছে ‘সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন’, যেটি করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। আর সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচনের আগে সংবিধান পরিবর্তন হবে না এবং বর্তমান সংবিধান অনুসারেই নির্বাচন হবে। আর বিএনপিও ভাল করে জানে আওয়ামী লীগ সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে না। তাই খালেদা জিয়ার ৬টি শর্তের মধ্যে এই একটি শর্ত পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় তাঁর দল বিএনপি নির্বাচন করবেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, যেহেতু খালেদা জিয়া বুঝতে পেরেছেন মামলায় তার সাজা হবে। আর তিনি জেলে গেলে নির্বাচনকালে দলের সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ থাকছে না। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনে গেলে দলের ভরাডুবি হবে। তাই নির্বাচন বর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবেই তিনি শর্ত দিয়েছেন ‘সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন দিতে হবে।’ নির্বাহী কমিটির সভায় খালেদা জিয়ার দেয়া আরেকটি শর্ত হচ্ছে ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে’। কিন্তু যেহেতু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধনের বিপক্ষে সেহেতু নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোন সুযোগ থাকছে না। আর আওয়ামী লীগের সব পর্যায় থেকে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে নির্বাচনকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ছোট পরিসরে একটি সরকার থাকবে। তাই খালেদা জিয়ার এ শর্তটিও পূরণ করার সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তবে এ কথা জেনে-বুঝেই খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জনের আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। খালেদা জিয়ার দেয়া আরেকটি শর্ত হচ্ছে ‘নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে’। তবে দলীয় সরকারের নিয়োগ করা নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কাজ করা সত্যিই কঠিন। আর নিরপেক্ষ থাকলেও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করেছে রাজনৈতিক কারণে। তাই নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকার বিষয়ে দেয়া শর্তটিই বুঝেশুনেই দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার দেয়া চতুর্থ শর্তটি হচ্ছে ‘জনগণকে ভোট কেন্দ্রে আসার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে’। এটিও নির্দলীয় সরকার ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। আর অতীতে দেখা গেছে সবাইকে নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে আসার সুযোগ দেয়ার পরও যে দল যখন হেরে গেছে সে দল তখন ভোট কারচুপির অভিযোগ করেছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার এ শর্তটিও হচ্ছে নির্বাচন বর্জনের ইঙ্গিতবহ। খালেদা জিয়ার দেয়া আরও একটি শর্ত হচ্ছে ‘ভোটের জন্য ইভিএম বা ডিভিএম ব্যবহার করা যাবে না’। অভিজ্ঞ মহলের মতে এ শর্তটি মানা সম্ভব। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আগাম কিছু বলার সম্ভাবনা কম। তাই বিএনপি আশঙ্কা করছে নির্বাচনে গেলে হয়ত এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের মাধ্যমে তাদের বিপক্ষে রায় নেয়ার চেষ্টা করা হবে। লা মেরিডিয়ান হোটেলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার দেয়া সর্বশেষ শর্তটি হচ্ছে ‘ভোটের সময় মোবাইল ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে’। কিন্তু বর্তমান সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এমন ব্যবস্থা রাখার সম্ভাবনার কথা এখন পর্যন্ত বলা হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন ভোটের সময় এমন ব্যবস্থা রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তাই খালেদা জিয়ার দেয়া ৬ শর্তের মধ্যে এ শর্তটিও নির্বাচন বর্জনের ইঙ্গিত বহন করছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠালে কঠোর আন্দোলনের পক্ষে রায় দিয়েছে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যরা। তবে বিভিন্ন জেলা নেতারা ঢাকার নেতাদের কারণেই বার বার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলে খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ করেন। তারা বলেন, অতীতে জেলা নেতারা জেল-জুলুম উপেক্ষা করে রাজপথে আন্দোলন সফল করলেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকায় সফলতা আসেনি। এ সময় নির্বাহী কমিটির সদস্যরা এবার কি ধরনের আন্দোলন হবে তা চূড়ান্ত করতে খালেদা জিয়ার ওপর দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। অবশ্য আন্দোলন করতে গিয়ে যেন নেতাকর্মীরা ভয় না পান সে জন্যই খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কারণে তার বক্তব্যে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন, পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনী আছে। খালেদা জিয়ার দেয়া বক্তব্যে তরুণ নেতৃত্বেও প্রশংসা করে দেয়া বক্তব্য তাঁর ছেলে তারেক রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করা হলেও খালেদা জিয়া জেলে গেলেও এখনই তাকে চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। নির্বাহী কমিটির বৈঠকে তিনি সবাইকে এমন আভাস দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেভাবে নির্দেশনা দিয়ে দল চালাতেন সেভাবেই দল চালাবেন বলে জানিয়েছেন। অবশ্য রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কেউ কেউ খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান বা তার স্ত্রী ডাঃ জোবাইদা রহমানকে দলের দায়িত্ব দেয়ার কথা উচ্চারণ করেছিলেন। তবে খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি জেলে থাকলেও দলের স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্যরা আছেন এবং মহাসচিব আছেন তারা সমন্বয় করে দলীয় কর্মকা- এগিয়ে নেবেন। আর আমিও বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করব। বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের আগের গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারাটি বাতিলের বিষয়েও অনুমোদন নেয়া হয়। এর কারণ হিসেবে দলীয় নেতাদের জানানো হয়, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের খুব কম নেতাই রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ও বর্তমান সরকারের আমলে অনিয়ম-দুর্নীতির মামলা হয়নি। আর যেকোন সময় যেকোন নেতার বিরুদ্ধে মামলার রায়ে সাজা হয়ে যেতে পারে। আর তা হলে আগের গঠনতন্ত্র অনুসারে সাজাপ্রাপ্ত নেতা আর দলীয় পদে থাকতে পারবে না। আর এ কারণেই বিএনপির আগের গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বাতিল করে সম্প্রতি তা নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে এবং দলের নির্বাহী কমিটির সভায় তা অনুমোদন করে নেয়া হয়েছে। অবশ্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নতুন গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে দেয়ার পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলেই গঠনতন্ত্রেও ৭ ধারা বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির জন্য ভাল হতো বলে দলের একাংশ মনে করলেও আরেক অংশ মনে করছেন এতে স্বল্প সংখ্যক নেতা নির্বাচিত হয়ে লাভবান হলেও অধিকাংশ আসনেই পরাজয় বরণ করতে হতো। আর বিএনপির যে অংশটি মনে করেছিল নির্বাচনে গেলে ভাল হতো তাদের মধ্যে কেউ কেউ এবারও যেকোন পদ্ধতির নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে রয়েছেন বলে জানা গেছে। আর তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেই খালেদা জিয়া বলেছেন, যারা এক পা এদিকে আরেক পা সেদিকে রাখবে সেই বেইমানদের আর ক্ষমা করা হবে না। সূত্র মতে, খালেদা জিয়া জেলে গেলে আর আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে না পারলে বিএনপির ভবিষ্যত অন্ধকার। আর এ অবস্থায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে সফল হতে পারবে না বিএনপি। আর এ জন্যই বিএনপির জন্য নির্বাচন বর্জন করাই রাজনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে তারা মনে করছে। তবে নির্বাচন বর্জন করলেও সুবিধাবাদী নেতারা যাতে সরকারের ফাঁদে পা দিয়ে নির্বাচনে গিয়ে দলে ভাঙ্গণ সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্যই খালেদা জিয়া দল কেউ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করলে আর ক্ষমা করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। পাশাপাশি বলেছেন, যারা সব সময় দলের স্বার্থে কাজ করবেন কোনদিন ক্ষমতায় গেলে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, দলের নির্বাহী কমিটির সভায় খোলা মনে ৪২ জন নেতা দলের স্বার্থে তাদের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। আর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আর নির্বাচনের জন্য যে ৬টি শর্ত তিনি দিয়েছেন তা দেশ, দল ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই দিয়েছেন। নির্বাহী কমিটির বৈঠকে অংশ নেয়া সিলেট মহানগর বিএনপির নেতা ডাঃ শাহরিয়ার বলেন, আগামী দিনে বিএনপি কি করবে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তব্যেই পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, নেতৃত্বের জন্য এখন আর চেয়ে থাকা চলবে না। সবাইকেই দলীয় স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। আমরাও সহমত পোষণ করেছি।
×