ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে শুরু হলো না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮

যে কারণে শুরু হলো না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

তৌহিদুর রহমান ॥ পরিবারভিত্তিক তালিকা চূড়ান্ত ও ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন না হওয়ায় ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। যদিও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। এখন কবে নাগাদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে, সেটা কেউই বলতে পারছেন না। এদিকে রোহিঙ্গারা এখনই রাখাইনে ফিরে গেলে বিপদের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। আর জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বাংলাদেশ সফর শেষে আজ বুধবার থাইল্যন্ড যাচ্ছেন। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত ২৩ নবেম্বর নেপিডোয় দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী ২৩ জানুয়ারির মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে পরিবারভিত্তিক তালিকা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের একটি ডাটাবেজ ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে সরকার। এই ডাটাবেজে প্রায় ৯ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে এখন পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। কেননা এককভাবে কোন রোহিঙ্গাকে পাঠানো হবে না। এক একটি পরিবারের পুরো সদস্যদের পাঠাতে হবে। সে কারণে পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরি ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। তবে এই তালিকা তৈরি এখনও সম্পন্ন হয়নি। এছাড়া পরিবারভিত্তিক ফরম তৈরি করতেও বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছে। কেননা এই ফরমে কি থাকবে, তা নিয়ে উভয় পক্ষ আলোচনা করে এটা তৈরি করেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশে ট্রানজিট ক্যাম্প হবে পাঁচটি এবং মিয়ানমারে দু’টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প তৈরি করা হবে। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের লা পো থং নামক একটি জায়গায় অস্থায়ীভাবে রাখা হবে। তারপর বাড়িঘর সংস্কার করে তাদের সেখানে পাঠানো হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে এখন ক্যাম্প স্থাপনের কাজ চলছে। আর ক্যাম্প স্থাপন না হলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে গত ১৬ জানুয়ারি নেপিডোয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ফিজিক্যাল অ্যারেজমেন্ট চুক্তি সই হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর পর আগামী দুই বছরের মধ্যে তা শেষ হবে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুরু হতে পারে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন। এছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গাদের এখনই ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যে আপত্তি তুলছে, সেটাও বিবেচনায় নিয়েছে বাংলাদেশ। কেননা শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের পক্ষেই কাজ করছে। সে কারণে এসব সংস্থার মতামতকে বিবেচনায় নিচ্ছে সরকার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত রবিবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা কাজ করছি। তবে ঠিক কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান। জাতিসংঘের বিপদের আশঙ্কা ॥ রোহিঙ্গারা এখনই রাখাইনে ফিরে গেলে বিপদের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। রাখাইনে ফিরে যাওয়ার আগে সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র এ্যাডরেইন এ্যাডওয়ার্ডস মঙ্গলবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া হতে হবে পুরোপুরি নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও টেকসই। রাখাইন এ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। মিয়ানমার সরকার এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, রাখাইনে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাদের জীবন জীবিকা ও চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সেখানের আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়াতে হবে। তবে এসব উদ্যোগ না নিলে রাখাইনে রোহিঙ্গারা এখনই ফিরে গেলে বিপদের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ্যাডরেইন এ্যাডওয়ার্ডস বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদার ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন হতে হবে। রাখাইনে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা, গণমাধ্যম ও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্যই সেখানে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার জরুরি। আর এখনও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত রয়েছে, এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য দুই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর কাজ করে চলেছে। এই সমস্যা সমাধানে আগামী দিনেও আমরা কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি। জাতিসংঘের বিশেষ দূত থাইল্যান্ড যাচ্ছেন ॥ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বাংলাদেশ সফর শেষ করেছেন। এক সপ্তাহ বাংলাদেশ সফর শেষে তিনি আজ বুধবার থাইল্যান্ড যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সফরের শেষ দিন মঙ্গলবার ইয়াংহি লি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন তারা। তবে বৈঠক শেষে ইয়াংহি লি উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেন নি। বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে দুই সপ্তাহের সফরের অংশ হিসেবে গত ১৭ জানুয়ারি জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি ঢাকায় আসেন। মিয়ানমারের আউং সান সুচির সরকার তার সঙ্গে অসহযোগিতা কথা ও তাকে মিয়ানমারে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর নিজের দায়িত্ব পালনে প্রতিবেশী এই দুই দেশ সফর করছেন। ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত থাইল্যান্ড সফর করবেন লি। তবে ইয়াংহি লি তার বাংলাদেশ সফরে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে। সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। উল্লেখ্য ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর সেনা অভিযানের মুখে ৮৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর গত বছর ২৫ আগস্টের পর নতুন করে বাংলাদেশে আসে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে জাতিগত দমন-পীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
×