ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রয় শিবিরগুলোতে উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ ;###;রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের নতুন কমিটি

প্রত্যাবাসনে হোঁচট ॥ মিয়ানমার সরকারে আস্থা নেই রোহিঙ্গাদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮

প্রত্যাবাসনে হোঁচট ॥ মিয়ানমার সরকারে আস্থা নেই রোহিঙ্গাদের

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার থেকে পূর্বঘোষিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। এ ঘটনায় উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে আনন্দ উল্লাস চলছে। কেননা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ বাংলাদেশে আশ্রয় ও ত্রাণ সহযোগিতা পেয়ে নিশ্চিন্ত জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে বসতি গেড়েছে। অপরদিকে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন প্রশ্নে যাই বলুক না কেন, রোহিঙ্গারা তা কোন অবস্থাতেই বিশ্বাস করছে না। এদিকে মঙ্গলবার ভোরেও রাখাইন থেকে ১০৪ রোহিঙ্গা টেকনাফের জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশকারীদের বিজিবির সহায়তায় টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে সুযোগ যে খুঁজছে তা নিশ্চিত। কিন্তু বিশ্বকে দেখাতে তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়া সংক্রান্ত সে দেশের গণমাধ্যমের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সরকার। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারকে বিষয়টি জানায়নি বলে দোষারোপ করা হয়েছে বার্মিজ গণমাধ্যমে। দেশটির অনলাইন দ্য মিয়ানমার টাইমসকে এ কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট থিন কিউর মুখপাত্র জো ঠুয়ে। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেন, আমরা মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকব। যখন তারা (বাংলাদেশ) আমাদের এ বিষয়ে জানাবে তখনই এ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। যদিও এ প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের আরও আলোচনা করতে হবে। নতুন পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের কাছাকাছি। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে যে অবশিষ্ট ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে তারাও ফাঁকফোকরে চলে আসার চেষ্টায় রয়েছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, মূলত মিয়ানমার মনেপ্রাণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। বর্তমানে তারা যা করছে তা বিশ্ব চাপের মুখে করছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে তাদের ভিটেমাটি। ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে গণহারে হত্যা করা হয়েছে। গণকবর দেয়া হয়েছে অনেককে। একটি গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে সেনা নিয়ন্ত্রিত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে। এ কমিটি স্বীকার করেছে যাদের গণকবর দেয়া হয়েছে তাদের সকলেই সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার। এ ধরনের আরও অসংখ্য গণকবর রয়েছে রাখাইন রাজ্যজুড়ে। যা প্রকৃতভাবে তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এছাড়া রাখাইন রাজ্য প্রশাসন ও সেখানকার রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা কোনভাবেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন মেনে নিতে চাইছে না। সম্প্রতি সেখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাখাইনদের প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করেছে। এমনি পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে সমঝোতা স্মারক ও পরবর্তীতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সে অনুযায়ী ২৩ জানুয়ারি ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ডেটলাইন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে লক্ষণীয় যে, মঙ্গলবার তা শুরু করা যায়নি। তবে সোমবার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে বিদেশী দূতাবাসের কর্ণধারদের ডেকে বৈঠকের মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত করেছে। এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চুক্তি অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় উল্লাসে ফেটে পড়েছে রোহিঙ্গারা। এ উপলক্ষে প্রত্যাবাসন বিরোধী উগ্র রোহিঙ্গারা বালুখালী ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণও করেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়ার প্রতিটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের মধ্যে শুধু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়েই আলাপ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। রোহিঙ্গাদের পক্ষে এমনও বক্তব্য আসছে, ‘জান দেব তারপরও তাড়াহুড়ো করে মিয়ানমারে যাব না।’ প্রত্যাবাসনবিরোধী রোহিঙ্গাদের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা বর্তমানে তটস্থ অবস্থায় রয়েছে। কিছু রোহিঙ্গার ইচ্ছে থাকলেও তারা স্বদেশে ফিরে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষে এমনও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে থাকার জায়গা না দিলে তারা বিদেশে পাড়ি জমাবে। তারপরও মিয়ানমারে তারা যাবে না। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এমনও জানাচ্ছে, অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ সীমান্ত খোলা পাই কিনা, এ চিন্তায় ছিলেন। পার যখন হতে পেরেছে, তখন আর যাব না মগের দেশে। অপরদিকে মঙ্গলবার ভোরেও মিয়ানমার থেকে ১০৪ রোহিঙ্গা টেকনাফের জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ২৩ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত বছর ২৩ নবেম্বর মিয়ানমারের নেপিডোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুযাযী দু’মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। মঙ্গলবার প্রত্যাবাসন কার্যক্রম না হলেও নতুন করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তাও বলা যাচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসনের পূর্বপ্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় কাজগুলো অসম্পূর্ণ থাকায় ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অনেক কাজই বাকি রয়েছে। আবার অনেক রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহীও নয়। তবে প্রশাসনের পক্ষে প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। টেকনাফ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা ও চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় রোহিঙ্গা সমস্যা, ইয়াবা ও নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ, রোহিঙ্গাদের কারণে প্রধান সড়কে যানজট ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ হোসেন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ জাফর আহমদ জানান, বর্তমানে টেকনাফ সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, ইয়াবা চোরাচালান এবং খুচরা বিক্রেতা ও সেবনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু ভয়াবহ এবং ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এটি এখন শুধু জাতীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কমিটি গঠন ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট ইস্যুতে থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরাকিয়ার্ট সাথিরাথাইকে প্রধান করে এডভাইজরি বোর্ড অব দ্য কমিটি ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য রিকমেন্ডেশনস অন রাখইন স্টেট নামে আরও একটি কমিটি গঠন করেছে মিয়ানমার। এর আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানকে প্রধান করে রাখাইন বিষয়ক পরামর্শ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া। নব গঠিত কমিটি মিয়ানমারের জটিল রাজনৈতিক ও মানবিক সঙ্কট সমাধানের সম্ভাব্য উপায়গুলো খুঁজে বের করবে। বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় রোহিঙ্গারা রাখাইনে পৌঁছানোর পর উদ্বোধনী মিটিং করবে ওই কমিশন। নতুন এ কমিটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আউং সান সুচির সঙ্গে রাজধানী নেপিডোতে প্রথম বৈঠকে বসবে বলে সূত্রে জানা গেছে। দেশটির সেনাবাহিনী কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের সম্মত হয় কিনা, সে বিষয়ে নতুন কমিটি কাজ করবে বলে ধারণা করেছেন সীমান্তের ওপারের একাধিক সূত্র। বন্ধই আছে নাফ নদীতে মাছ শিকার ॥ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে শাহপরীর দ্বীপ থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় জেলে, জেলে পরিবার এবং ভোক্তা সাধারণের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। বর্তমানে গরিব অসহায় জেলে পরিবারগুলোতে হাহাকার চলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। অপরাধ প্রবণতাও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ হোসেন সিদ্দিক বলেন নাফ নদী নির্ভর ১ হাজার ১৪৩ জেলেকে রেশনের আওতায় আনতে কাজ চলছে। রোহিঙ্গাদের কারণে চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি ॥ হোয়াইক্যং মডেল ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা নূর আহমদ আনোয়ারী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। রোহিঙ্গারা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবাধে সর্বত্র বিচরণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রা। এমনকি রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে চলে গিয়ে গবাদি পশু ও ইয়াবা নিয়ে আসছে। এভাবে গিয়ে ধরা পড়ে সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
×