ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

লোক ও কারুশিল্প মেলা

দর্শনার্থীদের হৈ-হুল্লোড়, বাহারি রং ডিজাইন ও পণ্যের সমাহার

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮

দর্শনার্থীদের হৈ-হুল্লোড়, বাহারি রং ডিজাইন ও পণ্যের সমাহার

খলিলুর রহমান ॥ লোক কারুশিল্প ও লোকজ গান গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে শিল্প বিপ্লবের উন্নতি-অগ্রগতি অব্যাহত থাকায় বাহারি রং ও ডিজাইনে হস্তশিল্পের তৈজসপত্র আজ বিলীন হওয়ার পথে। কারুকাজ করা কাঠের তৈরি হাতি, ঘোড়া, মাটির তৈরি পুতুলসহ নানা জিনিসও গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এসব তৈজস বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় শুরু হয়েছে লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। দেশের সোনালি আঁশ পাট দিয়ে তৈরি ভ্যানিটিব্যাগ, স্কুলব্যাগ, টিফিনব্যাগ ও ম্যানিব্যাগসহ নানা জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে সোনারগাঁওয়ে ম্যাসব্যাপী চলমান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের মেলায় বসেছেন কারুশিল্পীরা। এই মেলা শুরু হয়েছে গত ১৪ জানুয়ারি। চলবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য মেলা খোলা থাকছে। শুক্রবার ও শনিবার দিনভর সোনারগাঁও জাদুঘরে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে দেশী-বিদেশীসহ নানা বয়সী পর্যটক। তারা দিনভর কেনাকাটা করছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন হস্তশিল্পের তৈজসপত্রও। বিনোদনপ্রিয় দর্শকদের জন্য জাদুঘরের লেকে নৌকাভ্রমণ, বিভিন্ন রাইডসে চড়া, লোকজ গান উপভোগ করা, স্বজনদের নিয়ে সেল্ফি তোলা ও একসঙ্গে পরিবারের ছবি ক্যামেরাবন্দী করা, জামদানি শাড়ি ও বিভিন্ন স্টলে রাখা কারুকাজের নানা ঐতিহ্যের জিনিসপত্র কেনার আনন্দের কমতি ছিল না। প্রতিবছরই শীত মৌসুমে শুরু হয় ম্যাসব্যাপী এই লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। চীন, জাপান ও থাইল্যান্ডের পর্যটকরাও এই লোকজ উৎসব উপভোগ করতে ছুটে এসেছেন। বিদেশী পর্যটকরা বিভিন্ন স্টলগুলোতে ঘুরে ঘুরে হাতে তৈরি জিনিসপত্রগুলোর কারুকাজ দেখেন। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় মেলায় দর্শনার্থীদের সমাগম থাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি। রাজধানী ঢাকার মিরপুর থেকে বাংলাদেশ লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে আসা পর্যটক সীমা আক্তার বলেন, জাদুঘরে এলে গ্রামীণ ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে যায়। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। সুদূর চীন দেশের পর্যটক তরুণী ম্যা ইয়ানও মেলায় ঘুরতে এসে বলেন, বাংলাদেশ সুন্দর, বাংলার মানুষের হাতের তৈরি তৈজসপত্র আরও সুন্দর। ম্যা ইয়ান হাসিমাখা কণ্ঠে বলেন, মাই বেঙ্গলি নেম ‘গোলাপী’। বরিশালের মুলাদির একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান লোকজ মেলায় ঘুরতে এসে বলেন, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আমাদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে। মেলায় ঘুরে আনন্দ পেলাম। নগরীর সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে সোনারগাঁও জাদুঘরে ঘুরতে আসা রাকিব উদ্দিন বলেন, প্রতিবছর লোকজ মেলায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসি। এছাড়াও ফাঁক-ফোকর পেলেই গ্রামীণ ঐতিহ্য দেখতে সোনারগাঁয়ের জাদুঘরে ছুটে আসি। ঢাকার মগবাজার থেকে ঘুরতে আসা শিউলী আক্তার বলেন, রাজধানীর কোলাহল থেকে গ্রামীণ ঐতিহ্য দেখতে মেলায় এসেছি। মেলায় ঘুরে খুবই ভাল লেগেছে। লোককারুশিল্প ফাউন্ডেশন এলাকায় বাইরের খাবার নিয়ে ভেতরে ঢোকা যায় না। শিশুদের খাবারও নিয়ে আসতে পারিনি। এতে কিছুটা হলেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। লোকজ মেলায় এবার টেপাতুল, গ্রামীণ খেলা, শতরঞ্জি, শীতলপাটি, নকশি হাতপাখা শিল্প, নকশা ও পটচিত্র, শোলাশিল্প, বিভিন্ন হস্তশিল্পের তৈজসপত্রসহ একশ’ আশিটি স্টল বসেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চল থেকে ৬০ জন কারুশিল্পী মেলায় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে। তাদের জন্য ফ্রি ৩০টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ ও মাগুরার শোলাশিল্প, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, চট্টগ্রামের নকশিপাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁয়ের হাতি ঘোড়া পুতুল ও কাঠের কারুশিল্প, নকশিকাঁথা, নকশি হাতপাখা, মুন্সীগঞ্জের শীতল পাটি, মানিকগঞ্জের তামা-কাঁসা পিতলের কারুশিল্প, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্প, সোনারগাঁয়ের পাটের কারুশিল্প, নাটোরের শোলার মুখোশশিল্প, মুন্সীগঞ্জের পটচিত্র, ঢাকার কাগজের হস্তশিল্প। লোকজ মেলায় ১৮০টি স্টলের মধ্যে হস্তশিল্প ৪৫টি, পোশাক শিল্প ৪৫টি, স্টেশনারি ও কস্মেটিক্স ৩৪টি, খাবার স্টল ১৬টি, মিষ্টির ১০টি ও ৩০টি স্টল কারুশিল্পের কারুপণ্য উৎপাদন প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। এছাড়াও লোক কারুশিল্পমেলা ও লোকজ উৎসবে বাউলগান, পালাগান, কবিগান, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গান, জারি-সারি ও হাসন রাজার গান, লালন সঙ্গীত, মাইজভা-ারী গান, মুর্শিদী গান, আলকাপ গান, গায়ে হলুদের গান, বান্দরবান, বিরিশিরি, কমলগঞ্জের-মণিপুরী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শরিয়ত-মারফতি গান, ছড়া পাঠের আসর, পুঁথিপাঠ, গ্রামীণ খেলা, লাঠি খেলা, দোক খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, লোকজ জীবন প্রদর্শনী, লোকজ গল্প বলা, পিঠা প্রদর্শন হচ্ছে। সোনারতরি মঞ্চে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলছে অনুষ্ঠানমালা। ফাউন্ডেশনের পরিচালক কবি রবীন্দ্র গোপ সাংবাদিকদের বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার বিলুপ্তপ্রায় লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রতি বছরের মতো এবার মাসব্যাপী সোনারগাঁয়ে লোককারুশিল্প ও লোকজ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, এবারের মেলার আকর্ষণ গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম ‘কাঠের কারুশিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন’ শিরোনামে বিশেষ প্রদর্শনী। এছাড়াও রয়েছে নিরাপত্তা ও পুলিশবক্স এবং মিডিয়া ও তথ্য কেন্দ্রের স্টল। রয়েছে দেশীয় তাঁতের জামদানি শাড়ি। সোনারগাঁ তাঁত বস্ত্রশিল্প, আধুনিক জামদানি তাঁত কেন্দ্র, বিভিন্নœ নামকরা জামদানি হাউসসহ ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পে শাড়ি ও শালসহ নানা ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ। টেপাপুতুল স্টলে রয়েছে মাটি দিয়ে তৈরি কারুকাজের পুতুলের খেলনা। মেলায় বোনা হচ্ছে শীতল পাটি, নক্শি করা হাতপাখা, জামদানির নকশা ও পটচিত্র। মাগুরা থেকে শংকর মালাকার ও নিখিল মালাকার বাপ ছেলে শোলাশিল্প নিয়ে এসেছেন মেলায়। তারা ২২-২৩ বছর ধরে লোকজ মেলায় আসছেন। শোলা দিয়ে তৈরিকৃত ফুল, মাথার চুপি, বিয়ের ও পূজার ফুল। রায়হান মেলায় বিক্রি করছেন একতারা। মেলায় পাটজাত শিল্পের মধ্যে রয়েছে স্কুলব্যাগ, মেয়েদের ভ্যানিটিব্যাগ, টিফিনব্যাগ, হ্যান্ডেলব্যাগ ও মানিব্যাগসহ নানান জিনিসপত্র। পাটের একটি ছোট ব্যাগ পঁয়ষট্টি টাকা থেকে শুরু করে ভ্যানিটিব্যাগ চার শ’ টাকায় পর্যন্ত কেনা যায়। মেলার দর্শনার্থীদের সং সেজে বিনোদন দেন আব্দুর রহমান ও সোলেমান মিয়া। তারা সং সেজে দর্শনীতে নানা ভঙ্গিতে মাতিয়ে রাখেন। সোনারগাঁও জাদুঘরে ইজাদার কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা বলেন, গত ২-৩ বছর থেকে জাদুঘরে কোন দর্শনার্থী খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারেন না। এমনকি ভেতরে কোন পিকনিকের স্পট রাখা হয়নি। ফলে দর্শনার্থীকে একবার টিকেট নিয়ে ঢুকে বাইরে থেকে খাবার খেয়ে আবারও টিকেট দিয়ে ঢুকতে হয়। এতে অনেক দর্শনার্থী নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আগে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই ছিল। জাদুঘরের আশপাশের বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, আগে জাদুঘরের ভেতরে খাবার খাওয়া যেত, খাবার আনা যেত। এখন তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে পর্যটকদের সংখ্যা কমছে। এমনকি শিশুদের খাবারও আনা যায় না। ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভেতরে বাইরের খাবার খাওয়া ও খাবার আনা নিষেধ। ট্রাস্টি বোর্ড বলেছে, জাদুঘর পিকনিক স্পট না, একটি লোকজ ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠান। ঐতিহ্য দেখার জন্য দর্শনার্থীরা আসবেন। ভেতরে কোন পিকনিকের স্পট থাকবে না। তিনি আরও জানান, সোনারগাঁওয়ের জাদুঘরের মেলা উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুরো জাদুঘরটি সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া বিপুলসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
×