ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী নাফিসের লাশ গ্রহণ করবে না পরিবার

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮

জঙ্গী নাফিসের লাশ গ্রহণ করবে না পরিবার

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ‘ছেলে জঙ্গী হয়ে গেছে। জঙ্গী হওয়ার আগ পর্যন্ত সে আমার ছেলে ছিল। নিখোঁজ হয়ে মারা যাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া একজন জঙ্গীর লাশ আমরা কেন গ্রহণ করব?’ এভাবেই বললেন- রাজধানীর নাখালপাড়ায় জঙ্গী আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানে নিহত জঙ্গী নাফিস উল ইসলামের পিতা নজরুল ইসলাম। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, জঙ্গী হয়ে যাওয়া ছেলের মরদেহ তিনি গ্রহণ করবেন না। বরং এ বার্তা দিতে চান যে, যারা ঐ পথে যাচ্ছে তাদের লাশ পরিবারও গ্রহণ করে না। তিনি বলেন, ছেলের মরদেহ চট্টগ্রামে পাঠানো হলেও আমি তা নেব না। যারা আমার সন্তানকে বিপথে নিয়েছে সরকার তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক। উল্লেখ্য, রাজধানীর নাখালপাড়ায় গত ১২ জানুয়ারি জঙ্গী আস্তানায় নিহত তিনজনের মধ্যে একজন এই নাফিস। সে ছিল চট্টগ্রাম নগরীর কাজেম আলী স্কুল এন্ড কলেজের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। গত ৪ অক্টোবর স্কুলে গিয়ে সে নিখোঁজ হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে তার পিতা নজরুল ইসলাম চকবাজার থানায় একটি জিডিও করেছিলেন। এর ভিত্তিতে পুলিশ তার সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছিল। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এই নাসিফের অনুসন্ধানে গত ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট থানার পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকার এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সন্ধান মিলেছিল একটি জঙ্গী আস্তানার। সেখানে জঙ্গীরা অবস্থান করে সদরঘাট থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। ওই থানার ওসি একজন নারী হওয়ায় জঙ্গীরা থানাটিকে টার্গেট করে। সদরঘাটের জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয় হ্যান্ডগ্রেনেড, থানা এরিয়ার ম্যাপ, সুইসাইডাল ভেস্ট, কম্পিউটারসহ কিছু সামগ্রী। গ্রেফতার হওয়া দু’জনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, নাসিফ তাদেরই মন্ত্রে দীক্ষিত ছিল। সে তথ্যের ভিত্তিতে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সদস্যরা তাকে ধরতে সম্ভাব্য স্থানগুলোতে সন্ধান চালাচ্ছিল। কিন্তু ১২ জানুয়ারি ঢাকার নাখালপাড়ায় জঙ্গী আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানে নিহত তিনজনের মধ্যে একজন ‘নাফিস’ হিসেবে শনাক্ত হয়। চট্টগ্রামের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে দায়িত্বরত গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এএএম হুমায়ুন কবির নাসিফের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার কথা জানান। এই কর্মকর্তা জানান, তারা নাখালপাড়া অভিযানে নিহত এই কিশোরের ছবি নিয়ে তার বাবা-মাকে দেখালে তারাই তাদের সন্তানকে শনাক্ত করেন। পরে ঢাকায় গিয়ে নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করেন যে, এই নাফিস তারই সন্তান। শেরপুরের রবিনের লাশও গ্রহণ করল না পরিবার ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর জানান, রাজধানী ঢাকার নাখালপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় নিহত ৩ জনের একজন শেরপুরের নকলা উপজেলার কুর্শাবাদাগৈড় গ্রামের মৃত ফজর আলীর পুত্র রবিন মিয়া (১৭)। রবিবার রবিনের পরিবারের পক্ষে বড় ভাই ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা ও ভগ্নিপতি আল আমিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত করেন। তবে রবিনের জঙ্গী কানেকশনে বিব্রত হয়ে ও ঘৃণায় তার লাশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েই সোমবার তারা এলাকায় ফিরে এসেছেন। এদিকে ওই জঙ্গী আস্তানায় নিহত ৩ জনের একজন রবিন কি-না তা নিয়ে সংশয় শেষ হওয়ায় সোমবার তার জঙ্গী কানেকশনের বিষয়ে এলাকায় আফসোসের পাশাপাশি বিরাজ করছে উদ্বেগ। সোমবার দুপুরে নকলা পৌর শহরের কুর্শাবাদাগৈড় এলাকায় অবস্থিত রবিনদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার মা মালেকা খাতুন (৫৫) ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছেন। রবিনের বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ও তার স্ত্রী লাকি বেগমও শোকে-লজ্জায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাড়িতে ভিড় করেছেন আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ উৎসুক লোকজনও। ওই সময় গোলাম মোস্তফা জানান, তারা ৩ ভাই ও এক বোন। রবিন ছিল সবার ছোট। সে স্থানীয় সাহারিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। প্রায় ১৩ বছর আগে তাদের বাবা মারা যান। ২০১৩ সালে রবিন পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে সে তার (মোস্তফার) চালের দোকানে কাজে যোগান দিত। এক বছর ধরে সে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। কাজের একটু ফাঁক পেলেই মোবাইল ফোন সেট নিয়ে পড়ে থাকত। ওই অবস্থায় ৭ জানুয়ারি হঠাৎ করে সে (রবিন) বাসা থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। এরপর আর তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনায় ২০ জানুয়ারি নকলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এরই মধ্যে ১২ জানুয়ারি ঢাকার পশ্চিম নাখালপাড়ার রুবি ভিলার পঞ্চম তলায় র‌্যাবের অভিযানে নিহত হয় ৩ জঙ্গী। তাদের মধ্যে কুমিল্লার মেজবা ও চট্টগ্রামের নাফিজের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও পরিচয় না পাওয়ায় তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য র‌্যাবের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা ছবি শুক্রবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত অজ্ঞাতনামা যুবকের ছবি দেখে রবিনের সাদৃশ্য পায় তার পরিবারের লোকজন। গোলাম মোস্তফা একই আস্তানায় নিহত নাফিজের ছবি দেখে তাকেও শনাক্ত করে জানান, রবিন ৩ মাস আগে নাফিজকে তাদের বাড়িতে গিয়েছিল এবং ওই সময় তাদের বাড়িতে এক রাত ছিল। নাফিজের পরিচয় বলেছিল তার বাসা পুরান ঢাকায়। ৬ মাস আগে রবিন কাউকে না বলে সম্ভবত ওই বাসায় গিয়েছিল। তার মতে, রবিন উগ্রবাদী ফেসবুক আইডির মাধ্যমে বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন ছেড়ে হয়তো জঙ্গী কার্যক্রমে যোগ দিয়েছিল। এজন্য তারা অনুতপ্ত। তার লাশটি জঙ্গী হওয়ার কারণে তা গ্রহণ করিনি আমরা। রবিনের মা মালেকা বেগম বলেন, নিখোঁজের দিন দুপুরে তার ছোট ছেলে রবিন ভাত খেয়ে দোকানের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি দাবি করেন, রবিন কোন খারাপ কাজ করতে পারে না। দিনের বেশির ভাগ সময়ই রবিন তার বড় ভাই গোলাম মোস্তফার চালের দোকানে কাজ করত। কাজের চাপে অনেক সময় ভাত খাওয়ারও সময় পেত না সে। রবিনের প্রতিবেশী রুহুল আমিন, আব্দুস সামাদসহ বেশ কয়েকজন জানান, রবিনের জঙ্গী কানেকশনের খবরে এলাকাবাসী বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে শেরপুরের পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি) রফিকুল হাসান গনি বলেন, জঙ্গী আস্তানায় নিহত যুবক রবিনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ঘৃণায় তার পরিবার লাশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তা এলাকায় নিয়ে আসা হয়নি। তবে পরিবারটি রবিনের কৃতকর্মের কারণে অনুতপ্ত।
×