ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চরম অনিশ্চয়তায়

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চরম অনিশ্চয়তায়

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ইতোপূর্বে দুদেশের মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ২৩ জানুয়ারির পূর্বে অর্থাৎ ২২ জানুয়ারি থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর দিনক্ষণ ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে উঠে এসেছে চলতি শেষ সপ্তাহেও এ ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কোন লক্ষণ প্রতীয়মান হচ্ছে না। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতার অভাবে ঝুলে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে, বাংলাদেশে আশ্রিত ক্যাম্পগুলোতেও রোহিঙ্গারা রবিবার মানববন্ধন ও মিছিল করেছে এই বলে যে, নাগরিকত্ব প্রদান এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাবে না। এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র সচিবকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। এরপরে আলাদাভাবে বৈঠক করেছে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে। রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগুচ্ছে। পরিবেশ সৃষ্টি হলেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরে যাবে। অপরদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ইয়াং হি লি শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনের দ্বিতীয় দিনে রবিবার উখিয়ার হিন্দুপাড়া ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। এর আগে শনিবার তিনি টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলেছেন। জেনেছেন রাখাইনে থাকাকালীন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতির কথা। এদিকে, সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মূলত হোঁচট খেয়েছে নাগরিকত্ব প্রদানসহ নিজ বসতভিটায় ফিরে যাওয়ার কোন সুবিধা সৃষ্টি না করার কারণে। তবে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এসব দাবিসহ রবিবার ব্যানার, ফেস্টুনে তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে মানববন্ধন ও মিছিল করেছে। এর আগে গত অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে ফিরে যাওয়ার পক্ষে ২১ দফা জানান দেয়া হয়েছিল। পরে তা ১২ দফায় নেমে আসে। পরবর্তীতে আসে তা ৮ দফায়। সর্বশেষ রবিবার এসেছে তা ৬ দফায়। এসব দফায় পূরণ না হলে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় রাখাইনে যাবে না বলে আওয়াজ তুলেছে। অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গাদের মানববন্ধন ও মিছিল করিয়ে তাদের দাবি দাওয়া উত্থাপনের নেপথ্যে কিছু এনজিও’র ইন্ধন রয়েছে। এছাড়া রাখাইন রাজ্যের ৪০ গ্রামে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী নেতাদের পরামর্শমতে, বার্মিজ ও ইংরেজী ভাষায় লেখা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে রোহিঙ্গারা মানববন্ধনে নেমেছে। রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছেন, ৬ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। স্মারকলিপিতে থাকছে এসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে কোন রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাবে না। এখানে উল্লেখ করতে হয়, এ দাবির মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার নাগরিক হিসেবে নিয়ে সরকারীভাবে এর ঘোষণা দিতে হবে। মিয়ানমার স্বীকৃত জাতি গোষ্ঠীর তালিকাতে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যার যার বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে তার তার বসতভিটায় তাদেরকে পুনর্বাসন করতে হবে। অবাধ চলাচল ও ধর্মীয় কর্মকা-ের ওপর কোন বাধা থাকতে পারবে না। সেনা অভিযানের নামে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে যেসব নিরপরাধ রোহিঙ্গাকে আটক করে কারাগারে রাখা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে যেসব ছবি ও তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। রাখাইনে পুনঃ অভিযান ॥ রাখাইন রাজ্যে বুচিদং ওলাফে ও তংপাড়া এলাকায় তাদের ভাষায় বাগী (সন্ত্রাসী) ঢুকেছে বলে জানিয়ে আলী হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা খবর দিয়েছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। শুক্রবার লুন্টিং ও সেনা বাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে বলে জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে, বুচিদং শীলঘাটার আলী হোসেন নামে এক দালালের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রোহিঙ্গা গ্রামে অভিযান চালায় কয়েক শ’ সেনা ও লুন্টিং বাহিনী। সন্ত্রাসীর খোঁজে তল্লাশি চালালেও কোন সন্ত্রাসীকে খুঁজে পায়নি দেশটির যৌথ বাহিনী। আটক রোহিঙ্গাদের তংপাড়ার স্কুল ঘরে জমায়েত করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শনিবার সকলকে ছেড়ে দেয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে ইয়াং হি লি ॥ রোহিঙ্গাদের মানবিক পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে কক্সবাজারের টেকনাফের পর রবিবার উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার দূত ইয়াং হি লি। এ সময় তিনি রোহিঙ্গাদের মুখে বর্বরতা ও নানা নির্যাতনের বর্ণনা শুনেন। রবিবার সকাল ৯টার দিকে তিনি উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছান এবং ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরে তিনি উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। দুপুরে কুতুপালং ক্যাম্পের আইওএম অফিসে বেশ ক’জন নারী পুরুষের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় রোহিঙ্গারা রাখাইনে তাদের ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার বিশেষ দূত ইয়াং হি লি কে কাছে পেয়ে রোহিঙ্গারা তাদের সব কষ্টের কথা জানান। রোহিঙ্গাদের মুখে অমানবিক নির্যাতনের কথা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন ইয়াং হি লি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শনিবার টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার বিশেষ দূত ইয়াং হি লি। এ সময় রোহিঙ্গারা তার কাছে বিভিন্ন দাবি পেশ করেন। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লির নেতৃত্বে অপর ৪ সদস্যসহ একটি প্রতিনিধি দল স্থানীয় নেচারপার্ক সংলগ্ন রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শন করেন। বর্তমানে স্রোতের মতো আসছে ইয়াবার চালান ॥ মিয়ানমার সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্ত উন্মুক্ত থাকার কারণে শুধু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশই নয়, প্রতিদিন দেশে ঢুকছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। প্রতিদিন কোন না কোন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে রোহিঙ্গা ও সীমান্ত এলাকার চিহ্নিত ইয়াবা সিন্ডিকেট।
×