ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয়ে প্রযুক্তির ছোঁয়া-পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপন

প্রকাশিত: ০০:২২, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয়ে প্রযুক্তির ছোঁয়া-পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপন

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাঁপ কমাতে তথা ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয়ে বরিশালের তিন উপজেলার কৃষকরা গত বোরো মৌসুমে পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপন করে অধিক ফসল উৎপাদন করছেন। ফলে চলতি মৌসুমে কৃষকরা আধুনিক পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ওপর ঝুঁকে পরেছেন। আধুনিক পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধি; সেচের পানির ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধি; কম্পোষ্ট উৎপাদন ও ব্যবহার করে মাটি উর্বরতা বৃদ্ধি করা; কৃষকের জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পল্লী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানন্নোয়নে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (পউএ) বগুড়া কর্তৃক “পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির সস্প্রসারণ ও বিস্তার এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি শীর্ষক প্রায়োগীক গবেষণা” প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল সদর, উজিরপুর ও বাবুগঞ্জ উপজেলায় গত বোরো মৌসুমে পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরা অধিক লাভবান হয়েছেন। সরেজমিনে বরিশাল সদর উপাজেলার এয়ারপোর্ট থানার রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের সোলনা এলাকার ব্লক ঘুরে চাষীদের সাথে আলাপ করে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে সফলতার কথা শোনা গেছে। বর্তমানে পানি সাশ্রয়ী প্রকল্পের আওতায় কৃষকরা অল্প বয়সের ধানের চারা মেশিন দিয়ে জমিতে রোপনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। গত মৌসুমের তুলনায় এবছর প্রযুক্তিটি ব্যাপকভাবে সস্প্রসারিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষীরা। প্রকল্পের আওতাধীন কৃষক আজাহার বেপারী, আলমগীর হোসেন, বেলাল মিয়াসহ একাধিক চাষীরা জানান, গত বছর এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা প্রতি ২০ শতক জমিতে ৩২ মণ করে ধান উৎপাদন করেছেন। অতীতে প্রচলিত পদ্ধতিতে তারা পেয়েছেন ২০ মন ধান। প্রযুক্তিগুলি লাগসই এবং যুগউপোযোগী। যা ব্যবহার করে শুধু অধিক ফলনই নয়, উৎপাদন খরচও অনেক কমে গেছে। প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও উদ্বুদ্ধকরনে কৃষকের জমিতে প্রদর্শনী স্থাপনের পাশাপাশি ফার্মারস ফিল্ড স্কুল (প্রশিক্ষণ), মাঠ দিবস, উদ্বুদ্ধকরন ভ্রমন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যা এখনও চলমান রয়েছে। তিনি আরও জানান, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। একইভাবে গ্রাম অঞ্চলে শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে বেকার শিক্ষিত যুবক শ্রম সাধ্য কৃষি কাজ ছেড়ে পরিবহন, শিল্প কারখানাসহ অন্যান্য পেশায় স্থানান্তর হওয়ায় কৃষি শ্রমিকের সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সার্বিক এ প্রেক্ষাপটে কৃষির উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে কৃষিকে যান্ত্রিক কৃষিতে রুপান্তরের কোন বিকল্প নেই। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে সারাদেশে কম পানিতে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভম হচ্ছে এবং খামার যান্ত্রিকীকরনের ফলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে কৃষকেরা আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হচ্ছেন। সূত্রমতে, গত বোরো মৌসুমে প্রকল্প এলাকায় এডব্লিউডি (অল্টারনেট ওয়েট এন্ড ড্রায়িং) অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে ভিজানো এবং শুকানো পদ্ধতিতে জমিতে সেচ প্রদান, রেইজড বেড/বেড-নালা পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং এসআরআই (সিস্টেম অফ রাইচ ইন্টেনশিফিকেশন) পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তিগুলি ব্যবহার করে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ফলন বৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৩০% এবং পানি সাশ্রয় হয়েছে গড়ে ৪০%। পানি সাশ্রয়ী এ আধুনিক প্রযুক্তিগুলি সমস্ত বাংলাদেশের আবাদী জমিতে বাস্তবায়িত হলে দেশ ও জাতি আর্থিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন চাষীরা। প্রকল্পের বরিশাল বিভাগের দায়িত্বরত তথ্য সংগ্রহকারী কর্মকর্তা (পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বগুড়া) মোঃ জাহিদুর রহমান কৃষকদের সকল প্রযুক্তির বিষয়ে অবহিত করে থাকেন। চলতি বোরো মৌসুমে বরিশাল জেলায় ৩০ একর জমিতে বাইসট্রান্স প্লান্টার যন্ত্রের সাহয্যে অল্প বয়সী বীজ রোপন করা হয়েছে। বরিশাল সদর উপজেলার কৃষক আজাহার বেপারী, বাবুগঞ্জের তোফাজ্জেল হোসেন, উজিরপুরের রফিকুর রহমান ও জগলু লস্কর জানান, তারা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে অধিক লাভবান হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৩১টি জেলার অন্তর্গত ১১৫টি সাইটে (উপ-প্রকল্প এলাকা) এবং সাতটি মাদার ট্রায়েল এলাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০টি জেলার অন্তর্গত ২০০টি সাইটে উপ-প্রকল্প এলাকায় বাস্তবায়িত হবে। আধুনিক পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করাই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পটি আধুনিক পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি যথা-এডাব্লিউডি (অল্টারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রায়িং) অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে ভিজানো এবং শুকানো পদ্ধতিতে জমিতে সেচ প্রদান, রেইজড বেড (বেড-নালা পদ্ধতিতে চাষাবাদ) পদ্ধতিতে চাষাবাদ, এসআরআই (সিস্টেম অফ রাইচ ইন্টেনশিফিকেশন/কম বয়সী চারা রোপন) পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপন এবং ট্রাইকো-কম্পোস্ট উৎপাদন এবং ব্যবহার প্রযুক্তিসমুহ উপ-প্রকল্প এলাকা ও মাদার ট্রায়েল গুলিতে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাঁপ কমাতে তথা ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয়ে গত বোরো মৌসুমে কৃষকরা পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি এসআরআই (সিস্টেম অফ রাইচ ইন্টেনশিফিকেশন) পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপন করে অধিক ফসল উৎপাদন করছেন। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকরা বিশেষ পদ্ধতিতে ১৫-২০ দিন বয়সের চারা তৈরী করে তা যান্ত্রিকভাবে রোপন করেছেন। কৃষকরা জানান, গত মৌসুমে অল্প বয়সী চারা রোপনে প্রতি গোছায় কুশির সংখ্যা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় দ্বিগুন হয়েছে এবং সে অনুপাতে শীষের সংখ্যাও অধিক হয়েছে। পাশাপাশি পানির পরিমানও প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেক কম লেগেছে। তাছাড়া এডব্লিউডি (অল্টারনেট ওয়েট এন্ড ড্রায়িং) অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে ভিজানো এবং শুকানো পদ্ধতিতে জমিতে সেচ প্রদান করায় প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে সেচ সংখ্যা ও পানির পরিমান অনেক কম লেগেছে। বেড-নালা পদ্ধতিতে সরিষা, গম, ধান চাষে দেখা গেছে, প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ফলন ২০ থেকে ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক এই পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি সমুহ এবং যান্ত্রিকীকরন বাণিজ্যিকভাবে বাস্তবায়নে কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা তৈরী হয়েছেন। যারা নিজেরা যান্ত্রিকভাবে রোপন উপযোগী চারা তৈরী করছেন এবং কৃষকের জমিতে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের সাহায্যে চারা রোপন করে দিচ্ছেন। এতে করে কৃষকরা সাশ্রয়ী মূল্যে জমিতে চারা রোপন করে অধিক ফসল উৎপাদন করছেন। একইসাথে উদ্যোক্তারাও নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বছরব্যাপী ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ অপরিহার্য। মোট ব্যবহৃত পানির ৯৭ ভাগ সেচ কার্যে ব্যবহার হয়। ভূগর্ভস্থ পানির তুলনায় উপরিভাগের পানি সেচের জন্য অধিক উপযোগী হলেও শুস্ক মৌসুমে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপতা/পর্যাপ্ততা না থাকায় দেশের ৭৮ ভাগ সেচ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। তাই সেচ কার্য পরিচালনায় প্রতিবছর গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রচলিত সেচ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় তিন থেকে চার হাজার লিটার সেচ পানি প্রয়োজন। অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের ক্রমাগত নিমণগামিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের সংমিশ্রন। মাটির জৈব উৎপাদান ও পুষ্ঠিমান কমে যাওয়ার পাশাপাশি মাটি হারাচ্ছে তার গুণগতমান। এ সকল সমস্যাসমুহ মোকাবেলায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, মাটির গুণগত মান রক্ষা, ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, উৎপাদন ব্যয় কমাতে রেইজড বেড প্রযুক্তি পদ্ধতিতে ফসল চাষে ৪২ ভাগ সেচ পানি সাশ্রয় হয়। ধানের ফলন ২০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধিসহ ১৮ থেকে ২০ ভাগ ইউরিয়া সার কম লাগে। একবার বেড তৈরী করা হলে স্থায়ী বেডে বিনা চাষে পরবর্তী অনেকদিন ধরে ফসল ফলানো যায়। সর্বোপরি দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালনে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চার বছর মেয়াদী (এপ্রিল ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯) পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিস্তার এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’’ শীর্ষক প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্পটি ধান, দানা জাতীয় শষ্য এবং বিভিন্ন সবজি উৎপাদনে সেচের পানি, উৎপাদন উপকরণ ও জ্বালনী সাশ্রয়ী পরিবেশ বান্ধব রেইজড বেড, এসআরআই, এডব্লিউডি এবং ট্রাইকো কম্পোস্ট প্রযুক্তির বহুল প্রচলন, জনপ্রিয়করণ ও মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
×