ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অংশুমান ভৌমিক;###;পদাতিক নাট্য সংসদের ‘গুনজান বিবির পালা’

নাটকের দল টিকে থাকার অন্তরঙ্গ ধারাভাষ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

নাটকের দল টিকে থাকার অন্তরঙ্গ ধারাভাষ্য

‘গুনজান বিবির পালা’। পদাতিক নাট্য সংসদের (টিএসসি) নতুন নাটকের চতুর্থ অভিনয় হলো পশ্চিমবঙ্গের নদীয়াতে। চাকদহ নাট্যজনের প্রথম নাটকের মেলার শেষ রজনীতে। ১৭ জানুয়ারির কনকনে শীতের সন্ধ্যায় চাকদহের সম্প্রীতি মঞ্চে আসা শ’পাঁচেক লোক চোখ জুলজুল করে হই হই করে হেসে গড়াগড়ি দিয়ে ১০০ মিনিটের এই পালা দেখলেন। ‘নাটক’ বলতে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যে সাহেবি ধাঁচকে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ লোক চেনে তার উল্টোমুখে ছুটে অনেকটা ফাঁকা জমির দখল নিল সায়িক সিদ্দিকীর এই সৃষ্টি। ‘পালা’র মধ্যে গ্রামবাংলার নাড়ির টান থাকলেও ‘গুনজান বিবি’ নামটা অনেকের জানা নেই। পালাকারের মাথায় সেটা ছিল বিলক্ষণ। তাই নাটকের শুরুতেই বাঁশি-কাঁসি-ঢোল-করতাল-হারমোনিয়ামে ঝড় তুলে ‘সাত ভাই চম্পা জাগো জাগো রে’ শুনিয়ে দিলেন। খুব একচোট নেচে নিলেন অভিনেতারা। এতে ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকর যুগলবন্দীতে এই গানখানা যখন জন্মেছিল তখনও বাংলার আকাশে কাঁটাতার বসেনি। সব বাঙালী কান পেতে শুনেছিল। রূপকথার জগত থেকে ছিটকে যাবার মন-কেমন-করা ইশারা থাকলেও পৌঁছে গিয়েছিল ঠাকুরমার ঝুলি ভরা গল্পের রাতে। আবহমান বাংলার এই ধরতাই পেতেই গুনজান বিবির পালার দর্শক টানটান হয়ে বসলেন। গল্প গড়াল আদ্যিকালে। এক যে ছিল দীঘল রাজা, তার ছিল ছয় রানী। রাজারানীর কোন সন্তান হয়নি। কেন হয়নি? তা নিয়ে কতক কাওয়ালির মেজাজে ছেলে গায়েনদের সঙ্গে মেয়ে গায়েনদের লেগে গেল ধুন্ধুমার! আদি রসিকতাও হলো একপ্রস্ত। জমে গেল নাটক। মৈমনসিংয়ের জবানের মিঠা আন্দাজ ফুটল বয়াতিদের জবানে। চালু রেওয়াজ মাফিক সেকেলে গল্পে একেলে রসের ভিয়েন চড়ালেন নবীন পালাকার। হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে ঢুকে পড়ে ‘আবুর বাপ’-এর খোঁজে হুলুস্থুল বাধাল এক কন্যে। শুনিয়ে দিল জুয়াখেলায় ওস্তাদির জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত যে আবুর বাপকে ইনভাইট করেছে সেই আবুর বাপ মেলায় গিয়ে আর ফিরছে না। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চাকদহ বাজারের মেলায় এনে অডিটরিয়ামের আলো জ্বেলে কাতারে কাতারে ‘আবুর বাপ’ দেখিয়ে দিল এক ফচকে ছোড়া। আইডি প্যারেডের ধাঁচে ‘পাক্কা আমডার লাহান’ আবুর বাপের খোঁজ চলল এর ওপর তার ওপর আলো ফেলে। দর্শকরা দেদার মজা লুটলেন। পদাতিকের এই দলের অনেকেই খেটেখুটে পালাগানের কারিকুরি দিব্যি রপ্ত করে নিয়েছেন। জেন্ডার রিভার্সালের জায়গাগুলোতে তাঁদের পরিমিতিবোধ তো দেখবার মতো। সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা নিজে তো চুটিয়ে অভিনয় করেছেন, পাশাপাশি মঞ্চের ওপর পাখির মতো চলাফেরা করার কায়দা শিখিয়েছেন তাঁর সহশিল্পীদের। পালাগানের নিশান ওড়ানো খোলা মঞ্চের পেছনে সার দিয়ে বসেছেন জুড়ির দল। গানের কথায় আর সুরে বাংলার মাটির গন্ধ উঠে এসেছে। দীঘল রাজা সপ্তম বার বিয়ে করছেন শুনে ছয় রানিতে মিলে ষড়যন্ত্র করেছেন রামপ্রসাদী পদাবলির সুরে। মাত হয়ে গেছেন নদীয়াবাসী। সায়িক সিদ্দিকীর চোখকান খোলা। সেকাল-একালের সাঁকো তৈরিতে তিনি মনোযোগী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাঁড়ির হাল বা রাত-বিরেতে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঁকিঝুঁকি কোনটাই নাটকের বাইরে থাকেনি। ফলে ঘণ্টাখানেক যে কীভাবে কাভার হয়ে গেল কেউ টের পায়নি। তার পরই হুট করে ‘আজকের মতো রিহার্সাল বন্ধ!’ বলে দর্শকদের চমকে দেয়া হলো। জানা গেল এতক্ষণ মহুয়া থিয়েটার বলে এক নাটকের দলের টেকনিক্যাল রিহার্সাল দেখছিলাম আমরা। দু’দিন বাদে শো। এদিকে প্রধান অভিনেত্রী মিডিয়াতে কাজ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলে কী করে শো হবে ভেবে পাচ্ছে না দল। দলের মাথা মনোরঞ্জন অধিকারী সব কিছু বাজি রেখে নাটক করছেন, গৃহিণীর কানের দুলও সরিয়ে ফেলতে তাঁর বাধছে না। তবুও কী শো হতে পারবে? এভাবে বাংলার এ্যামেচার থিয়েটারের ঘরের অনেক কথা বাইরে এনে ফেলেছে গুনজান বিবির পালা। সাত ভাই চম্পা আর পারুল বোনের গল্প হয়ে উঠেছে মহুয়া থিয়েটারের মতো শয়ে শয়ে নাটকের দল কত ঝুটঝামেলা সামলে টিকে রয়েছে তার অন্তরঙ্গ ধারাভাষ্য। নাটুয়াদের ঘরোয়া কোন্দলে কান পেতেছে এ পালা। গ্রামগঞ্জে জমিয়ে বসা প্রাকৃত মনোরঞ্জনের চোরাবালি চিনিয়েছে। যাঁরা ‘মঞ্চই আমার জান, মঞ্চই আমার প্রাণ’ গতের মিডিয়া ইন্টারভিউ দিয়ে আসলে মঞ্চনাটককে মই বানিয়ে টঙে উঠে সময়মতো মঞ্চ থেকে সরে পড়েন কিংবা যাঁরা সাধারণ দর্শকদের মন ভোলানোর জন্য মিডিয়া থেকে স্টার আমদানি করে থিয়েটার করেন- তাঁদের সবাইকে এক হাত নিয়েছেন পালাকার। কলমে রং তামাশা ভাল খোলে রঙ্গরসে কম পড়েনি। তবে শেষদিকে কোন কূলে কীভাবে তরী ভিড়বে ঠিক করতে না পারায় রূপকথার নটেগাছ মুড়োতে অসুবিধে হয়েছে। বার তিনেক ভয়েসওভারের ইস্তেমাল করে নীতিবাগীশের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছেন পালাকার। এতে করে নাটক শ্লথ থেকে শ্লথতর হয়েছে। তবে জমজমাট অভিনয়ে এসব ঘাটতি অনেকাংশে পুষিয়ে দিয়েছেন পদাতিকের কুশীলবরা। সম্প্রীতি মঞ্চের কারিগরি সীমাবদ্ধতাও তারা কাটিয়ে উঠেছেন। বুঝিয়েছেন দলগত অভিনয়ই নাটকের জানপ্রাণ। বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতির নানা আঙ্গিক থেকে বাছাই করে আনা নানা উপকরণের মাপা মিশেলে পালা গাওয়া হলে দর্শক, তা সে সাভারের হোক বা নদীয়ার, যে দু হাত তুলে শাবাশি দেবেন তার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন এই গুনজান বিবির পালা। একক অভিনয়ে ইতোমধ্যেই বাহাদুরি দেখিয়েছেন সায়িক সিদ্দিকী। নির্দেশক হিসেবে তাঁর আগামী গতিপথে আমাদের নজর রইল।
×