ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জমজমাট কেনাকাটা

ছুটির দিনে বাণিজ্যমেলায় উপচেপড়া ভিড়, যেন জনসমুদ্র

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

ছুটির দিনে বাণিজ্যমেলায় উপচেপড়া ভিড়, যেন জনসমুদ্র

ওয়াজেদ হীরা ॥ মানুষ আর মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ কিংবা তরুণ-তরুণী কে নেই সেই মানুষের ভিড়ে। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। আর একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে এ যেন এক জনসমুদ্র। ছুটির দিন শুক্রবার ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার চিত্র এটি। সব পথই যেন মিলেছিল মেলা প্রাঙ্গণে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত মানুষের ভিড়ে বাণিজ্যমেলা হয়ে ওঠে সব শ্রেণী-পেশা মানুষের মিলনস্থল। দর্শনার্থীদের এ ভিড় সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও। অতিরিক্ত দর্শনার্থীর কারণে আশপাশের রাস্তাগুলোতেও সৃষ্টি হয় যানজট। হাজারো মানুষের উপস্থিতিই যেন বলে দেয় মেলা বাঙালীর এক ঐতিহ্য। মেলার সময় বাড়ানো না হলে সামনে আর মাত্র একটি শুক্রবার পাওয়া যাবে। তাই তৃতীয় শুক্রবারের চাপটা একটু বেশি থাকবে সে হিসেবে সকাল সকালই বিভিন্ন স্টল প্যাভিলিয়নের কর্মীরা চলে আসেন। আর সকালে ভিড় একটু কম থাকতে পারে সে আশায় ছুটে আসেন দর্শনার্থীরাও। অন্যান্য ছুটির দিন দুপুরের পর বেশি চাপ থাকলেও এদিন দুপুরের আগেই চাপ বাড়তে থাকে। মাঝে নামাজের সময় লোকজন একটু হালকা মনে হলেও দুপুরের পর আবার মানুষের যাতায়াত শুরু হয়। বিকেলের মধ্যেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় মেলার মাঠ। তখনো বাইরের বিভিন্ন কাউন্টারের সামনে টিকেট কিনতে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। আর ভিতরে অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপে হাটতেও কষ্ট হয়েছে। যান্ত্রিক নগরবাসীকে এক স্থান থেকে সংসারের যাবতীয় পণ্য কেনার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে এই বাণিজ্যমেলা। সবগুলো স্টলেই মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড় লেগেছিল। কেনাকাটা কিংবা পণ্যের তথ্য নেয়া দুটোই চলেছে সমান তালে। কি নেই সেই কেনাকাটার তালিকায়! শাড়ি থেকে চুড়ি কিংবা থালাবাসন থেকে ঘরের চেয়ার টেবিল সবকিছুই মিলছে মেলায়। এমন ভিড়ের মধ্যেই সেলফি নিতে ভুলেনি তরুণ-তরুণীরা। জুয়েলারি ও সাজসজ্জার বিভিন্ন স্টলে বিক্রয়কর্মীদের ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে মেলায় এসেছেন ইরিন আক্তার। তিনি বলেন, বাবা চাকরি করার কারণে অন্যদিন সবার সময় হয় না। আর সবাই না আসলে মেলার মজাটাও পাওয়া যায় না। ছোট্ট শিশু কোলে নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল বাবা আবু তাহেরের। বেসরকারী চাকুরে অন্যদিন স্ত্রী সন্তানদের তেমন সময় দিতে পারেন না। তাইতো ছুটির দিন ভরসা। ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল জানালেও পরিবারের সবাইকে নিয়ে মেলায় আসতে পেরেও বেশ খুশি তিনি। বিভিন্ন মধ্যবয়সী নারীরা এদিন বিভিন্ন শুকনো খাবারেও যে ছাড় দিচ্ছে তা লুফে নিয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন কোকারিজ ও প্লাস্টিকের পণ্য ও স্টল প্যাভিলিয়নেও ভিড় ছিল নারীদের। বিভিন্ন বিস্কুট, নুডলস, জুস তাদের একাধিক পণ্য একত্রিত করে ছাড়ে বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর ক্রেতারা মেলায় একটু কমে কিনতে পেরে আর প্রয়োজনীয় হওয়ার কারণে ক্রেতাদেরও বেশি ঝোঁক ছিল। এদিকে, তরুণরা ব্লেজারের গোল্ডেন অফারের পিছনে ছুটেছেন। কটি কোর্ট, মুজিব কোর্ট, মোদি কোর্ট সুলভে বাহারি ডিজাইন পাওয়ার জন্য স্টলগুলোতে প্রচুর ভিড় লক্ষ করা গেছে। মেলায় ব্লেজার কেনা শাহাদত জানালেন, ১১শ’ টাকায় ব্লেজার কিনেছেন তিনি। যা বাইরে কিনতে গেলে দুই হাজার টাকা লাগতো বলে মনে করেন তিনি। মেলায় এক হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্লেজার পাওয়া যাচ্ছে। তবে দুই হাজারের মধ্যে ব্লেজারের চাহিদাই বেশি। লাল, মেরুন, গোলাপি, টিয়া, নেভি ব্লু প্রভৃতি রঙের তৈরি মেয়েদের ব্লেজারও পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। তরুণীরা ছুটেছেন বাহারি কাপড় আর সাজসজ্জা জুয়েলারি কিনতে। প্রতিটি জুয়েলারির স্টলে কমপক্ষে ১০ জন বিক্রয় প্রতিনিধি থাকলেও ক্রেতা সামলাতে পারেনি তারা। ‘এটা নয়, ওটা দিন’ ‘গলার মালা দিন’ ইত্যাদি শব্দে স্টল মুখরিত। ক্রেতারাও বাহারি ডিজাইনের গলার সেট, হাতের পাথরের চুড়ি, কানের দুল ইত্যাদি কিনেছেন। বিদেশী বিভিন্ন পারফিউম কিনতেও দেখা গেছে। এছাড়াও তরুণীরা জুতার স্টলগুলোতেও ছুটেছেন পছন্দসই জুতা কিনতে। সুমি আক্তার বান্ধবীদের সঙ্গে মেলায় এসেছেন। সব বন্ধু একই ধরনের জামা কিনেছেন। জানালেন একই রং আর ডিজাইন হলে ঘুরাঘুরিতে মজা পাওয়া যায়। পণ্য কিনেও সন্তুষ্টি তাদের। বাচ্চাদের জন্য তাদের মা-বাবা ছুটেছেন খেলনার স্টলগুলোতে। বিক্রেতা আব্দুল আজিজ জানালেন, খেলনা বিক্রি বেশ জমজমাট। ফার্নিচারের প্যাভিলিয়নে গিয়ে অর্ডার করলে বাসায় মালামাল পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও থাকছে। একই সাথে ছাড়তো আছেই। বিভিন্ন ফার্নিচারেও ক্রেতারা মূলত বিভিণœ ডিজাইন দেখে বুকিং দিয়ে যেতে দেখা যায়। পণ্য ভেদে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিকের পণ্যে থাকছে নানা ছাড়। তাই গৃহিণীরা সেখানেও ছুটেছেন। মেলায় অবস্থিত কৃত্রিম সুন্দরবনের সামনে সেলফি তুলেছেন আগত দর্শনার্থীরা। এক দর্শনার্থী জানালেন, শুধু ঘোরাঘুরি করব, আর কিছু ছবি তুলব না তা হয় নাকি। মেলায় প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়নে নানা ধরনের বিস্কুট ও বেভারেজ পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বাণিজ্যমেলায় প্রাণের অংশগ্রহণ। এদিকে মেলায় সৌখিন দর্শনার্থীরা ভিড় করেছেন বাসাবাড়ির সাজসজ্জায় ব্যবহার হওয়া সৌখিন সামগ্রীর দোকানে। বিভিন্ন রকমের হাতে তৈরি পণ্য কিনছেন তারা। ফুলদানি ও শোপিসগুলো ক্রেতাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে বলে জানান হ্যান্ডিক্র্যাফট বিক্রেতা। বাণিজ্যমেলায় গৃহিণীদের প্রথম পছন্দ থাকে গৃহস্থালি পণ্য। বিভিন্ন স্টলে রয়েছে এ পণ্যেরও সমাহার। হটপট, রাইস কুকার, ফ্রাইপ্যান, কড়াই, পেশার কুকার, চুলাসহ রয়েছে ৫০০টির বেশি গৃহস্থালি পণ্য। নারীদের ভিড়ে এসব স্টলে প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য ছিল পুরুষদের। ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার বা তারই বেশি টাকায় বিক্রি এসব পণ্য কিনতে নারীদের সরব উপস্থিতি ছিল স্টলগুলোতে। কিছু স্টল আবার প্যাকেজের মাধ্যমে বিক্রি করেছেন এসব পণ্য। বিভিন্ন ফুলের বাগান, শিশু পার্ক কিংবা সুন্দরবন সব জায়গায় মানুষের পদচারণা। ইলেকট্রনিক্স পণ্যগুলোতে ডিসকাউন্ট দেয়া হচ্ছে। মেলা থেকে অনেকেই মোবাইল ফোন কিনছেন। বিদেশী প্যাভিলিয়নের এদিন প্রচুর ভিড় লক্ষ করা গেছে। বিদেশের পণ্যের সাথে পরিচয় আর কোন কোন পণ্য কিনেও নিয়েছেন ক্রেতারা। পণ্যের পাশাপাশি বিদেশী মশলা আর ফল বিক্রি করতেও দেখা গেছে। ক্রেতাদেও বেশ আগ্রহ ছিল এর প্রতি। থাই প্যাভিলিয়নে লংডাম, রামবুটাম, পারসিমনি, ড্রাগন, ডুরিয়ানসহ বিভিন্ন ফল পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি আছে আম, তেঁতুলও। তবে দাম একটু বেশি। ইচ্ছা করলে সাধারণের পক্ষে তা কেনা সম্ভব নয়। কোনো ফলের কেজি ৭০০ টাকার নিচে মিলছে না। বিদেশী প্যাভিলিয়নে জুতার বেশ চাহিদা ছিল। আবার বিদেশী প্যাভিলিয়নে কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে দেশী পণ্যেরও পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করতে দেখা গেছে। ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের মতো বিদেশী প্যাভিলিয়নে বিক্রি হচ্ছে দেশী আর চীন থেকে আমদানি করা পণ্য। এসব প্যাভিলিয়নে প্রসাধনসামগ্রী, জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগ, আচার, চকোলেট, শাল, এনার্জি ড্রিংক, জুস, মশলা, চাদর, থ্রিপিস, প্লাস্টিক ও সিরামিকস পণ্যসহ নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসে বিশ্রাম নিতেও দেখা যায়। মেলায় আসলে কেউ তেমন একটা খেতে চান না তবে এদিন খাবারের স্টলগুলোতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। মেলা আয়োজকরা জানিয়েছেন এদিন প্রায় লাখের মতো লোকের সমাগম হয়েছে মেলায়। আগামী বাকি যে কটি ছুটির দিন আছে একই ধরনের দর্শনার্থীর উপস্থিতি থাকবে আশা ইপিবির। একাধিক টিকেট বুথে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত ছুটির দিনগুলোর চেয়ে অনেক ছাড়িয়ে গেছে এদিন। তবে সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যা বলতে পারেনি কেউ। ১০০টি সিসিটিভির মাধ্যমে পুরো মেলা তদারকি করা হয়। আর নিরাপত্তার জন্য র‌্যাব-পুলিশ-আনসারতো আছেই। তবুও এদিন পুশিকেও হিমশিম খেতে হয়েছে দর্শনার্থী সামলাতে। মেলায় বিভিন্ন অভিযোগ ও তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য মেলায় প্রয়োজনীয় ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োজিত আছেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ক্রেতাদের পণ্য ও সেবার সাথে পরিচিত করতে বাংলাদেশ ছাড়াও বাণিজ্য মেলায় ১৭টি দেশ অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রিয়জনদের সাথে একটু কেনাকাটা আর বিনোদনমূলক সময়ের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা পার করে সময়।
×