ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিকত্বসহ ১২ দাবিতে সোচ্চার রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

 নাগরিকত্বসহ ১২ দাবিতে সোচ্চার রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার এই সন্ধিক্ষণে ১২ দফা দাবিতে নতুন করে সোচ্চার হচ্ছে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো। সর্বশেষ তারা এক বিবৃতিতে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, নাগরিকত্ব প্রদান, হারানো জমির ওপর অধিকার, ন্যায়বিচারসহ দাবিগুলো নিশ্চিত না হলে তারা ফিরে যাবে না। বিবৃতিদাতারা জানায়, তাদের দাবিগুলো চূড়ান্ত আকারে বাংলাদেশ সরকার এবং শরণার্থী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে লিখিতভাবে তুলে ধরা হবে। বিশেষ করে নাগরিকত্বের বিষয়টি মিয়ানমার সরকার আগেভাগে স্পষ্টভাবে ঘোষণা না দিলে একজন রোহিঙ্গাও ফিরবে না বলে ঘোষণা দেয় রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতারা। এমতাবস্থায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে, দাবি পূরণ না করে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে শুক্রবার রোহিঙ্গারা টেকনাফ এবং উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, রোহিঙ্গা সংগঠন ও নেতাদের এ ধরনের বিবৃতির ফলে বাংলাদেশে আশ্রিতদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং ও প্রত্যাবাসনে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিতে পারে। অন্তত অর্ধডজন রোহিঙ্গা নেতা দাবি করে যে, বিবৃতিদাতা নেতৃবৃন্দ রাখাইন প্রদেশের ৪০টি গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বার্মিজ ভাষায় লেখা এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দাবি মানা না হলে কোন রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরে যাবে না। মিয়ানমার সরকারকে সর্বাগ্রে প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে হবে। যে জমি তারা ফেলে এসেছে তা ফিরিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। নিরীহ যেসব রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে। রাখাইনে সন্ত্রাসী হিসাবে রোহিঙ্গাদের যে সম্পূরক তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। ১২ দফা দাবির মধ্যে আরও রয়েছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে সংশ্লিষ্ট করা, বিতাড়িতদের রোহিঙ্গা পরিচয়ে স্বীকৃতি দেয়া, ক্ষতিপূরণসহ ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভিটেবাড়িতে পুনর্বাসন করা, উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে জাতিসংঘের অধীনে সেফ জোন ঘোষণা করা, অন্যান্য নাগরিকদের মতো সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করা, ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করা, রাখাইন প্রদেশে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান এবং সেখানে নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা আর ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা প্রদান করা। রোহিঙ্গাদের এ দাবি দাওয়া যে সংগঠনগুলো বিবৃতির মাধ্যমে তুলে ধরেছে সেসব সংগঠনগুলো হচ্ছে-আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে, ব্রিটিশ রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইউকে, বার্মিজ রোহিঙ্গা কমিউনিটি এন ডেনমার্ক, বার্মিজ রোহিঙ্গা এ্যাসোসিয়েশন জাপান, রোহিঙ্গা এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্জ ইন জাপান, বার্মিজ রোহিঙ্গা কমিউনিটি অস্ট্রেলিয়া, বার্মিজ রোহিঙ্গা এ্যাসোসিয়েশন ইন কুইন্সল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া, কানাডিয়ান বার্মিজ রোহিঙ্গা এ্যাসোসিয়েশন, ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল, মিয়ানমার এথনিক রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন ইন মালয়েশিয়া, রোহিঙ্গা আমেরিকান সোসাইটি, রোহিঙ্গা আরাকান রিফিউজি কমিটি, রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন জার্মানি, রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন সুইজারল্যান্ড, রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন ফিনল্যান্ড, রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন ইটালি, রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন সুইডেন, রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন নরওয়ে, রোহিঙ্গা সোসাইটি মালয়েশিয়া এবং রোহিঙ্গা সোসাইটি নেদারল্যান্ডস। মিয়ানমারের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম খবর দিয়েছে যে, আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যদের একটি সম্পূরক তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই সন্ত্রাসীদের দায়ী করা হচ্ছে গত ২৫ আগস্টে আরাকানে পুলিশ ও সেনা চেকপোস্টে হামলার জন্য। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছে যে, তারা কোন সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গার তালিকা প্রস্তুত করছে না। আরসার কিছু সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালিত হলেও কোন ধরনের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এদিকে, আরসা’র এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী দমনে অভিযানের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন সদস্য নিহত হয়নি। যারা মারা গেছে তারা সকলেই নিরীহ বেসামরিক রোহিঙ্গা। মিয়ানমার পুলিশের মুখপাত্র মাইয়ো থো সোয়ে বৃহস্পতিবার রয়টার্সকে জানিয়েছেন, রাখাইন প্রদেশের কোন গ্রামে এখন ক্লিয়ারেন্স অপারেশন চলছে না। তবে নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এখনও রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করছে কিনা সে তথ্য তাদের কাছে নেই। স্বদেশ ফিরে না যেতে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ ॥ দাবি পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে বিক্ষোভ করেছে রোহিঙ্গারা। শুক্রবার জুমার নামাজের পর উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ও পালংখালী ক্যাম্পে শত শত রোহিঙ্গা ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে ক্যাম্প অভ্যন্তরে এ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কিছু এনজিও এবং পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা নানাভাবে প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। চলছে উস্কানি এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির নানা তৎপরতা। একাধিক রোহিঙ্গা জানায়, মিয়ানমারে এখনও শান্তি ফিরে আসেনি। আমাদের দাবিও পূরণ হয়নি। আমরা কেন ফিরে যাব? ‘আঁরা ন-যাইয়ুম’ অর্থাৎ আমরা যাব না। নাগরিকত্ব না দিলে যাব না, যাব না স্লোগান দিয়ে হাতে ব্যানার নিয়ে তারা বিক্ষোভে অংশ নেয়। জিরো পয়েন্টের রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর চলছেই ॥ সাড়ে তিন মাস পর পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির শূন্যরেখার সাপমারাঝিরি ক্যাম্প পাঁচ দফায় ২ হাজার ২৪৯ জনকে উখিয়া ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে। গত অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের একাধিক দল সাপমারাঝিরিসহ নাইক্ষ্যংছড়ির বেশ কয়েকটি পয়েন্টে আশ্রয় নিয়েছিল। জিরো পয়েন্টের সাপমারাঝিরি, বাহিরমাঠ, বড়ছনখোলা ও তুমব্রু কোণারপাড়ার চারটি এলাকায় ওসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সরওয়ার কামাল বলেন, সাপমারাঝিরি থেকে ২ হাজার ২৪৯ জনকে সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ওই এলাকাটি রোহিঙ্গাশূন্য করা হয়েছে। এরপরও যদি ওই সীমান্তে কোন রোহিঙ্গা প্রবেশ করে বা সন্ধান মেলে তাহলে কাউকে আশ্রয় না দিয়ে উখিয়া ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ধারাবাহিকভাবে উপজেলার বড় ছনখোলা, বাহিরমাঠ এবং কোনারপাড়া থেকেও রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি ।
×