ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল বিভাগের রায়

মুন সিনেমা হলের মূল মালিককে ৯৯ কোটি টাকা দেয়ার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

মুন সিনেমা হলের মূল মালিককে ৯৯ কোটি টাকা দেয়ার নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হলের স্থানে গড়ে তোলা বর্তমান স্থাপনার মূল্য ৯৯ কোটি ২১ লাখ টাকা নির্ধারণ করে তা মূল মালিককে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। এই অর্থ তিন কিস্তিতে পরিশোধ করতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। প্রথম কিস্তিতে দুই মাসের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা, পরের দুই মাসের মধ্যে আরও ২৫ কোটি এবং বাকি টাকা আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে বলে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। মাহবুবে আলমই রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজ। আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল, সেগুলোকে আদালতে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এই সামরিক ফরমান দ্বারা সে সময় অন্যায়ভাবে যেই সমস্ত বাড়িঘর পরিত্যক্ত করা হয়েছিল সেগুলোকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই মামলার সঙ্গে সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগ একটি রায় দিয়েছিল যেটা মুন সিনেমা হল। যা সেই সময়ে তৎকালীন সরকার দখল করেছিল সেই দখলকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলো। এবং মুন সিনেমা হলকে তাদের ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে যেহেতু মুন সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। হলের জায়গা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেয়া হয়েছে। সেখানে যেহেতু অনেক দোকানপাট তৈরি হয়েছে, তারা দোকানদারি করছে। এসব বিষয়ে বিবেচনা করে আপীল বিভাগ জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, মুন সিনেমা ও এর জায়গার মূল্য নির্ধারণ করার জন্য। তিনি তার রিপোর্টে ৯৯ কোটি ২১ লাখ টাকা নির্ধারণ করেন। অন্যদিকে হল মালিকরা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। আজকের রায়ে হল মালিকদের ক্ষতিপূরণের দাবি অগ্রাহ্য হয়েছে এবং জামিলুর রেজার রিপোর্ট গৃহীত হয়েছে। সরকারকে বলা হয়েছে এই টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। প্রথম ধাপে ২৫ কোটি টাকা আদেশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে আরও দুই মাস পর ২৫ কোটি টাকা এবং জুলাই মাসের শেষ দিকে বাকি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। টাকা কে দেবে জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সেটিই নির্ধারণ করবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। টাকা সরকার দেবে না মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট দেবে। দেয়ার কথা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টেরই যেহেতু তারাই বেনিফিশিয়ারি। যদিও কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এত টাকা দিতে তারা অপারগ। এখন এটা সরকারী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আদালতের আদেশের পর ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডের মালিকপক্ষের আইনজীবী তৌফীক নেওয়াজ বলেন, আদালত কর্তৃক কোন বিষয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষিত হলে কোন সময়েই তা অতীত বিবেচনায় মার্জনা পেতে পারে না। সাংবিধানিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন কিস্তিতে ওই অর্থ ইটালিয়ান মার্বেলকে পরিশোধ করতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে এক সময়ে মুন সিনেমা হলের মালিক ছিল ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে ওই সম্পত্তি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ইটালিয়ান মার্বেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুল আলম এই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান একটি সামরিক ফরমান ঘোষণা করেন, যাতে বলা হয়, সরকার কোন সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলে আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। মুন সিনেমা হলের সম্পত্তিও এর আওতায় পড়ে যায়। ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস এরপর ২০০০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে, যেখানে সংবিধানের ওই পঞ্চম সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করা হয়। ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট যে ঐতিহাসিক রায় দেয়, তাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ সংবিধান-বহির্ভূত ও বেআইনী ঘোষণা করা হয়। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ২০১০ সালের দুই ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে এবং ৯০ দিনের মধ্যে মুন সিনেমা হল ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডকে ফেরত দিতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেয়। এরপর দীর্ঘদিনেও মালিকানা ফিরে না পেয়ে ২০১২ সালের দশ জানুয়ারি ইতালিয়ান মার্বেল কর্তৃপক্ষ তখনকার ভূমি সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দাখিল করে। সেই অভিযোগের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, ১৯৭২ সালে মুন সিনেমা হল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০১ সালে প্রতীকী মূল্য এক টাকা দরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তা হস্তান্তর করে ডেভেলপারদের কাছে। ডেভেলপাররা মূল সিনেমা হলটি ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণ করে এবং নিজেদের অংশ বর্তমান দোকান মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এ অবস্থায় মুন সিনেমা হল আগের অবস্থায় ফেরত দেয়ার কোন উপায় নেই জানিয়ে জমির মূল্য ও মুন সিনেমা হলের মূল কাঠামোর মূল্য ধরে এর মালিককে দেয়া যেতে পারে বলে আদালতে মত দেন এ্যাটর্নি জেনারেল। ওই শুনানির পরই আপীল বিভাগ সিনেমা হলের জমি, স্থাপনার মূল্য নির্ধারণের নির্দেশ দেয়।
×