ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে

গণমাধ্যমে নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা সত্ত্বেও দেশে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এটি একটি উদ্বেগজনক খবর বৈকি। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট জিডিপির ২ ভাগ। আরও যা দুঃখজনক তা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ড্রাইভারদের তেমন শাস্তি হয় না। ক্ষতিপূরণ আদায়ও ততোধিক দুরূহ। সর্বোপরি দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, ওভারলোডিং-ওভারটেকিং, চালকদের বিরামহীন গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অনুসরণ না করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অযান্ত্রিক- অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল, সর্বোপরি ঝুঁকিপূর্ণ ও বাঁকবহুল সড়ক যোগাযোগ। অবশ্য আশার কথাও শুনিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বছর ওয়ারিভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে আসছে। মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীত হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ক্রমশ। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ন্ত্রণ, মাদকাসক্ত চালক নিয়োগ বন্ধ ও লাইসেন্স বাতিল, মোবাইলকোর্টের কার্যক্রম বৃদ্ধি, জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি হাইওয়ে প্যাট্রল পুলিশের নিয়মিত নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশও রয়েছে। জেল-জরিমানার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রথম সড়ক পরিবহন আইনে যানবাহন চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে ন্যূনতম ৮ম শ্রেণী এবং সহকারীর যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী পাস। পেশাদার চালকের ক্ষেত্রে বয়সও বেঁধে দেয়া হয়েছে, ২১ বছর। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রণীত এই আইনে তিন রকম শাস্তি দেয়া যাবে দ-বিধির অধীনে। নরহত্যা (উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে) হলে ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হবে। যাতে শাস্তি মৃত্যুদ-। আর খুন নয় এমন ঘটনায় ৩০৪ ধারা অনুযায়ী সাজা দেয়া যাবে যাবজ্জীবন। আর শুধু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য হলো ৩০৪ (খ) এর জন্য তিন বছরের কারাদ-। এর ফলে শেষ পর্যন্ত যানবাহন মালিক ও চালকদের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। দেশের নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতাসহ সুশীল সমাজের দাবি ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। সে ক্ষেত্রে তা যাবজ্জীবন না হোক, অন্তত ১৪, ১০ অথবা নিদেনপক্ষে ৭ বছরের জেল-জরিমানাসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা ছিল বাঞ্ছনীয়। তদুপরি বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার অপরাধ হবে জামিন ও আপোসযোগ্য। তার মানে হলো গণদাবিকে উপেক্ষা করে পরিবহন মালিক ও চালক-হেলপারদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে সরকার। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’- সংগঠনের তথ্যমতে, দেশে প্রতি হাজার যানবাহনে নিহতের সংখ্যা বছরে ১৬৯ জন। অথচ অত্যধিক যানবাহনের দেশ জাপানে এই মৃত্যুর হার মাত্র দুজন। শুধু ট্রাফিক আইনকানুন কঠোরভাবে মানার কারণেই জাপানে দুর্ঘটনার হার অবিশ্বাস্যভাবে কম। এর বিপরীতে বাংলাদেশে বিরাজ করছে এক নৈরাজ্যজনক অবস্থা। এখানে সারাদেশে তো বলাইবাহুল্য, এমনকি রাজধানীতেও প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চলে ট্রাফিক আইন ভাঙ্গার প্রতিযোগিতা। সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৭ম। কোন কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। সে অবস্থায় এ রকম একটি দুর্বল আইন হলে চালকরা যে আরও বেপরোয়া হবে এবং বাড়বে সড়ক দুর্ঘটনা, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সত্য বটে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে কেবল ড্রাইভার দায়ী নয়। বরং ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ভুল সিগন্যাল, মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন, অসতর্ক যাত্রী ও পথচারী, সড়কের পাশে হাটাবাজার, সড়কের যথেচ্ছ ব্যবহার ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। প্রশিক্ষিত-স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন চালকেরও অভাব প্রকট। বিআরটিএসহ ট্রাফিক বিভাগের অব্যবস্থা, ঘুষ-দুর্নীতিও এর জন্য দায়ী অনেকাংশে। সভ্য ও উন্নত হতে হলে এসব বাধাই আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে পর্যায়ক্রমে। তবু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যেহেতু চালককে প্রাথমিকভাবে দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, সেহেতু শাস্তির বিধান একটু বেশি রাখা হলে সে সতর্ক ও সাবধান হতে পারে। আর সতর্ক ও সাবধান হলে সড়ক দুর্ঘটনার হার এমনিতেই কমে আসবে।
×