ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

থেমে গেল নন্দিত কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আখতারের জীবন স্পন্দন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

থেমে গেল নন্দিত কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আখতারের জীবন স্পন্দন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে/আরে লাল লাল নীল নীল বাতি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে...। শ্রোতার হৃদয় জয় করা এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আখতার। মঙ্গলবার চিরতরে থেমে গেছে নন্দিত সেই কণ্ঠস্বরটি। শেষ হলো সুর আশ্রিত জীবনের পরিভ্রমণ। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ে এদিন বিকেলে তিনি রাজধানীর চামেলীবাগের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি .... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। গানের পাখিখ্যাত এই শিল্পী রেখে গেছেন জীবনসঙ্গী লোকসঙ্গীত শিল্পী আকরামুল ইসলাম এবং দুই ছেলে-মেয়ে সোহান ইবনে আকরাম কমল ও হুমাইরা চৌধুরী সাজিয়া। শাম্মী আখতারের পারিবারিক সূত্র জানায়, মরদেহের অবস্থা ভাল না হওয়ায় তাকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে না। আজ বুধবার বাদ জোহর রাজধানীর চামেলীবাগের আমিনবাগ জামে মসজিদে জানাজা শেষে শাহজাহানপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হবে তাকে। শাম্মী আখতারের স্বামী সংগীতশিল্পী আকরামুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, পাঁচ বছর ধরে ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছিলেন শাম্মী আখতার। তার ক্যান্সার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়ে। তবে চিকিৎসায় কোন ত্রুটি ছিল না। এ অবস্থায় জীবনের দিনগুলোয় শাম্মী আখতার বাসাতেই ছিলেন। আজ (মঙ্গলবার) দুপুরে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে হৃদস্পন্দন না পাওয়ায় বাসাবোর হেলথ এইড হাসপাতালে নেয়ার পথে বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শাম্মী আখতারের মৃত্যুতে সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার চামেলীবাগের বাসায় ছুটে আসেন সঙ্গীত ভুবনের মানুষেরা। শাম্মী আখতারকে শেষবারের মতো দেখতে আসেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পী খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, রোমানা ইসলাম, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি তপন মাহমুদ, গীতিকার কবির বকুল প্রমুখ। খুরশীদ আলম বলেন, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের যে কয়েকজন শিল্পী তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন শাম্মী আখতার তার অন্যতম। তিনি উচ্চমানের শিল্পী ছিলেন, তবে তার মধ্যে কোন গর্ববোধ ছিল না। তিনি সবাইকে যার যার প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করতেন। রফিকুল আলম বলেন, শিল্পী তো অনেকেই আছেন, কিন্তু শাম্মী আখতারের মতো গুণী শিল্পী সৃষ্টি হওয়া কঠিন। তপন মাহমুদ বলেন, তিনি শিল্পী হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তার শিল্পীত্বের চেয়ে তিনি বড় ভাল মানুষ ছিলেন। তার অকাল প্রয়াণে সঙ্গীত ভুবনে অসামান্য শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন গুণী সংগীতশিল্পী শাম্মী আখতার। এই কণ্ঠশিল্পীর চিকিৎসা সহায়তায় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্যক্তিগত তহবিল থেকে প্রদান করেছিলেন পাঁচ লাখ টাকা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গায়িকার উন্নত চিকিৎসার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শরীরের অক্ষমতায় জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে বিছানায় শুয়ে বা হুইল চেয়ারে। সুমধুর কণ্ঠস্বরের এই শিল্পী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঠিকমতো কথাও বলতে পারতেন না। মোহময় কণ্ঠের এই গায়িকা গানে গানে বিনোদিত করেছেন দেশের আপামর শ্রোতাকে। ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’, ‘আমি যেমন আছি তেমন রব বউ হবো না রে’, ‘ভালোবাসলেও সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’ এমন অনেক গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে শাম্মী আখতারে মায়াবি কণ্ঠের জাদুতে।। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর অন্তরালে চলে যান শ্রোতানন্দিত এই শিল্পী। শাম্মী আখতার নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হলেও এই কণ্ঠশিল্পীর প্রকৃত নামটি ছিল শামীমা আক্তার। তিনি ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের উৎসাহে শাম্মীর সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় মাত্র ছয় বছর বয়সে, হাতেখড়ি ওস্তাদ গৌরবাবুর কাছে। বাবার বদলির কারণে দেশের কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেয়ার সুযোগ পান তিনি। তিনি ১৯৭০ সালে খুলনা বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হন। সেখানে আধুনিক গানের পাশাপাশি নজরুলসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস আয়োজিত লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে খুলনার আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। এটাই ছিল ঢাকায় তার প্রথম সঙ্গীত পরিবেশনা। এরপর তিনি বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। পেশাদার শিল্পী হিসেবে শাম্মী আখতারের সঙ্গীত জীবনের সূচনা বেতারে গান গেয়ে। বেতারে গাওয়া তার প্রথম গানটি ছিল নজরুলসঙ্গীত। স্বদেশের প্রতি ভালবাসার প্রকাশে গেয়েছিলেন ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’। সত্তরের দশক পেরিয়ে আশির এই শিল্পী সম্পৃক্ত হন চলচ্চিত্রের গানে। ১৯৮০ সালে অশিক্ষিত ছবিতে গান গেয়ে প্লে ব্যাকে অভিষেক হয় এই শিল্পীর। আর চলচ্চিত্রের অভিষেক হওয়া সেই গানটিই তাকে এনে পৌঁছে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তার শিখরে। রাজধানীর রঙ্গিন জীবনের কথা সেই গানের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’। আজিজুর রহমান পরিচালিত একই চলচ্চিত্রে তার গাওয়া ‘আমি যেমন আছি তেমন রব বউ হব না রে...’ গানটিও পেয়েছে দারুণ শ্রোতাপ্রিয়তা । এছাড়াও এ শিল্পী চলচ্চিত্রে প্রায় তিনশ গান গেয়েছেন। তার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পাওয়া উল্লেখযোগ্য অন্য গানগুলো হলো ‘বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না’, ‘মনে বড় আশা ছিল তোমাকে শুনাবো গান’, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও’, ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’, ‘এই রাত ডাকে এই চাঁদ ডাকে’, ‘আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া বুঝে না’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী/ খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি’, ‘আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোল আনা’ ইত্যাদি। জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ চলচ্চিত্রে ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’ গানটি গেয়ে ২০১০ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন শাম্মী আখতার। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের গানের পাখি নামে শাম্মী আখতার বিগত পাঁচ বছরের বেশি সময় ভুগেছেন মরণবাধি ক্যান্সারে। সেই অসুস্থ শরীরেও সুরের ভুবনের এই বাসিন্দা মাঝে মাঝে গান গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। অসুস্থতার মাঝেও বিশেষ বিশেষ অনুরোধে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গান গেয়েছেন। গান গেয়ে মানুষের ভালবাসা পাওয়ার মধ্যেই নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে ফিরেছেন এই শিল্পী।
×