ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সেবা বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা

প্রকাশিত: ২২:১২, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সেবা বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা

কবির হোসেন, কেশবপুর ॥ তহমিনা বেগম কেশবপুর পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টারে এসেছেন তাঁর নয় মাস বয়সী ছেলের জন্ম নিবন্ধনের সনদপত্র নিতে। আসার সাথে সাথে কাজ করে দেয়া হয়েছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সদনপত্র পেয়ে তিনি বেজায় খুশি। কেশবপুর পৌরসভার মধ্যকুল গ্রামে তহমিনা বেগমের বাড়ি। স্বামী তাহের খা একজন দিনমজুর। জমি জায়গা নেই। মাত্র সাত কাঠা জমিতে তিন ভাইয়ের ভিটাবাড়ি। হাসিমাখা মুখে তহমিনা বেগম জানালেন, এর আগেও তিনি মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেট পৌর ডিজিটাল সেন্টার থেকেই নিয়েছেন। শুধু তহমিনা বেগম নয় কেশবপুরের সকল মানুষই এখন জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেটসহ নানামুখী ইন্টারনেট সেবা নিচ্ছেন ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা ডিজিটাল সেন্টার থেকে। মানুষের জীবন যাপনে আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছে ইন্টারনেট। গোটা দুনিয়া চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রামের অজপাড়া গায়ের মানুষ বিশ্বের যাবতীয় খবর যেমন ঘরে বসে জানতে পারছেন তেমনি দোরগোড়ায় হাতের কাছেই পাচ্ছেন প্রয়োজনীয় সেবা সমূহ। কল্পনাইও যা আশা করিনি সেটাই আজ হাতের নাগালে পেয়ে গেছে মানুষ। কম্পিউটার বা একটি স্মার্ট ফোনেই যে কোনো সময় প্রয়োজনীয় কাজটি মূহুর্তেই সেরে ফেলছেন ম্যাজিকের মতো। গ্রামের মানুষের মধ্যে যাদের কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন নেই তারা নিজ নিজ ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে প্রয়োজন মতো কাজটি সেরে নিতে পারছেন অনায়াসে। পায়ে হেটে অথবা গরুর গাড়িতে চড়ে এখন আর উপজেলা বা জেলা শহরে যেতে হয় না সরকারি অফিসে জরুরি কাজের জন্য। একজন সংবাদকর্মীকে এখন আর পোষ্ট অফিসে গিয়ে খামের ভেতর সংবাদ পাঠাতে হয়না। ফ্যাক্সে নিউজ পাঠানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয় না। আবার সংবাদটি প্রকাশের জন্য সাতদিন ধরে অপেক্ষায়ও থাকতে হয়না। গ্রামের একজন কৃষককে জমির পর্চা নিতে মাসের পর মাস ভূমি অফিসে হাটা লাগে না। কৃষকদের ফসলের সমস্যা নিয়ে কৃষি অফিসে বার বার যেতে হয় না। ইন্টারনেট সব কিছুই যেন পানির মতো সহজ করে দিয়েছে। চোখের পলকেই সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে ইন্টারনেট নামক যাদুকরী সেবাটি। সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারে থাকা প্রিয়জনের সাথে ভিডিও কলের মাধ্যমে যেন পাশাপাশি বসেই কথা বলছেন মানুষ। ইন্টারনেটের সুবাদে প্রত্যন্ত একালার অফিসে কর্মকর্তা কর্মচারীর কাজ মনিটরিং করা হচ্ছে এখন রাজধানী থেকেই। আরার রিপোর্ট আদান প্রদান সহজ ও স্বল্প সময়ে করা হয় ইন্টারনেটের কল্যানে। আবার মানুষ নানা রকম সমস্যার প্রতিবাদ ও ন্যায় সংগত আলোচনা করতে পারছেন অবাদে ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমে। সারা দেশের মধ্যে প্রথম ইন্টারনেট ভিত্তিক ডিজিটাল সেবা শুরু হয় যশোর জেলায়। যশোরের অধীন কেশবপুর উপজেলার অবস্থান যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরার সমান দূরত্বে। এই অবস্থানের কারনে কেশবপুর উপজেলা আলাদা গুরুত্ব বহন করে আসছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ঐতিহ্যের দিক দিয়েই কেশবপুর দেশের ভেতর তার নিজস্ব অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে। ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট ব্যবহারেও পিছিয়ে নেই কেশবপুর। পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে ১৩ টি ডিজিটাল সেন্টারে ইন্টারনেট সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারন মানুষ এ সেন্টার থেকে প্রয়োজনীয় কাজ করছেন। ইউনিয়ন পরিষদের সরকারি ইন্টারনেট ভিত্তিক ডিজিটাল সেন্টার সাধারন মানুষের বহুমুখী নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে। কেশবপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে জনসাধারন সরকারি বিভিন্ন ফরম পূরন করতে পারছেন। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারছেন। গ্রাম থেকে অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন, বিদ্যুত বিল, জমির পর্চার আবেদন, নাগরিক সনদ, ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডের তালিকা করতে পারছেন। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন ও মানবাধিকার, পর্যটন, অকৃষি উদ্যোগ, জীবন জীবিকা ভিত্তিক তথ্যভান্ডার, জাতীয় ই-তথ্যকোষ প্রদান করা হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার থেকে। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইন ই-তথ্যকোষের ভার্সনে নানা রকম সেবাও প্রদান করে থাকে ডিজিটাল সেন্টার। মোবাইল ব্যাংকিং, ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজি শিক্ষা, কম্পিউটার প্রশিক্ষন, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইমেইল, চাকুরির তথ্য, কম্পোজ, ভিসার আবেদন ও ট্রাকিং, দেশে-বিদেশে ভিডিওতে কন্ফারেন্সিং, সচেতনতা মূলক ভিডিও শো প্রদর্শন, ফোন কল, ফ্লেক্সিলোড, প্রিন্টিং, স্ক্যানিং, ফটোকপি, লেমিনেটিংসহ বিভিন্ন প্রকার বানিজ্যিক ইন্টারনেট সেবাও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে দেয়া হয়। কেশবপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আলা জানান, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার সরকারের খুবই ভাল একটি পদক্ষেপ। সাধারন মানুষ দোরগোড়ায় সেবা পাচ্ছে। তবে ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি জানান ডিসেম্বর-১৭ মাসে তার সেন্টার থেকে ৭শ’২৯ জন বিভিন্ন সেবা নিয়েছেন। কেশবপুর সদর ইউনিয়ন ভেঙ্গে নির্মিত পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টারে বিগত বছরের জানুয়ারি মাসে অনলাইনে বিদ্যুতের মিটারের আবেদন করেছেন ১৫ জন, কম্পিউটার কম্পোজ ১০ জন, ই-মেইল ২০ জন, ডাটা এন্ট্রি (বেসরকারি) ২০ জন, ভিসা চেকিং ৪ জন, ছাত্রছাত্রীদের ডাটাবেজ তৈরি ২ জন, ইন্টারনেট ব্রাউজিং ১৫ জন, স্ক্যানিং ১০ জন, অনলাইনে জমির পর্চার আবেদন ১৩ জন, প্রিন্ট ১৮ জন, অনলাইনে চাকুরির আবেদন ৫ জন, কম্পিউটার প্রশিক্ষন ৫ জন, মোবাইলের রিংটোন ডাউনলোড ১ জন, আউটসোর্সিং ১ জন, প্রত্যায়ন প্রস্তুতকরন ১ জন, পরিচয়পত্র তৈরি ২ জন, ভিসার আবেদন ৩ জন, বিদ্যুত বিল ২ জন, মোবাইল ব্যাংকিং ২ জন, পাসপোর্টের আকেদন ২ জন, পাসপোর্টের ফি জমা ২ জন, ডিপিএস এ্যাকাউন্ট খোলা ১ জন, বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মী রেজিট্রেশন ১ জন, ভিডিও এডিটিং ১ জন ও ফটোকপি করেছেন ১ জন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টার থেকে সেবা গ্রহন করে একশ’৫৬ জন। বছর শেষে ডিসেম্বর মাসে এর সংখ্যা বেড়ে ইন্টারনেট সেবা নিয়েছেন ২শ’২৩ জন। পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম বলেন, পৌরসভার যাবতীয় কাজ এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হয়। সেকারনে ঝামেলা হয় না। এতে দূর্নীতির সুযোগও থাকে না। গ্রামের সাধারন মানুষের পাশাপাশি কেশবপুর উপজেলার সকল অফিস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার শেখ আবু শাহীন বললেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে কর্মকর্তা কর্মচারীর দৈনিক হাজিরা নেয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক ও হাসপাতালের সকল রিপোর্ট অনলাইনে প্রেরন করা হচ্ছে। ই-মেইল ও ভিডিও কন্ফারেন্সের মাধ্যমে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত তথ্যের আদান প্রদান হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে অনলাইনে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের রেজিট্রেশন করা হয়। তাছাড়া শিশুদের পুষ্টি সংক্রান্ত ও অসংক্রামক রোগ বিষয়ক তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করা হয়। ইন্টানেটের কারনে খুব দ্রুত রিপোর্ট ও তথ্য আদান প্রদান সহজ হয়েছে। উপজেলা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সহকারি প্রোগ্রামার আব্দুস সামাদ জানান, উপজেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও নির্দেশনায় আইসিটি সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষন দেয়া হয়। ডিজিটাল সেন্টারের টেকনিশিয়ান শরিফ আলম রাজু জানান, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও কেশবপুরের বিভিন্ন ইউনিয়নে মোট ১৩টি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। প্রতিদিন এসব সেন্টারের কার্যক্রম তদারকি করে অনলাইনে আপডেট করা হয়। এসব সেন্টার থেকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকার উপরে আয় হয়। প্রতি মাসে প্রায় ১৫ থেকে ১৭শ’ লোক সেবা গ্রহন করছেন। গত নবেম্বর মাসে মোট আয় হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার ৬শ’৪২ টাকা।
×