ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৌলভীবাজারের শেরপুরে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা

প্রকাশিত: ০১:২৮, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

মৌলভীবাজারের শেরপুরে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা

নিজস্ব সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার ॥ প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শুরু হয়েছে। ৩ দিন ব্যাপী মেলায় হাওর ও নদীতে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা দেশীয় প্রজাতির তরতাজা মাছ কিনতে বিভিন্ন স্থান থেকে সৌখিন ক্রেতারা ভীর জমান। তারা কিনে নিয়ে যান মেলা থেকে পচন্দের মাছ। এ অঞ্চলের মানুষ অধীর আগ্রহে থাকেন কখন বছর ঘুরে শুরু হবে মাছের মেলা। এ জন্য আগে থেকেই অনেকেই প্রস্তুত থাকেন মেলা থেকে পচন্দের মাছ কিনতে। শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীরে প্রায় দুইশত বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে মাছের মেলা। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাছের মেলাটি শুরু হলে এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে শুরু হয়েছে তিনদিন ব্যাপী এই মেলা। মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের সীমানা ঘেষে জেলার শেরপুর এলাকায় বসে মাছের মেলা। এটি যদিও মাছের মেলা নামে পরিচিত তথাপি মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থালী সামগ্রী, খেলনা সামগ্রী সহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের দোকান স্থান পায়। মেলায় মাছের মূল্য ২ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মূলের মাছ উঠেছে। বর্তমানে এই মাছের মেলা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মিলনমেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশাল এলাকা জুড়ে মেলার আয়োজন। কয়েক শতাধিক মাছের দোকান। নানা জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছ আর মাছ। আর্কষণীয় ঢংয়ে দোকানীদের পসরা। মেলা আসা মাছগুলো আকার ও আয়তনে বড় আর ওজনে বেশি হওয়ায় তা দেখতে ও কিনতে কৌতুহলী মানুষের ঢল। শুক্রবার রাত থেকেই শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই মাছের মেলা। চলবে রবিবার বিকেল পর্যন্ত। মেলায় আসা নানা বয়সী লোকজন নিজেদের মুঠোফোনে মাছের সাথে তুলছেন সেলফি। একসাথে এসকল অদেখা নানা জাতের বড় বড় মাছ দেখে সবাই আনন্দিত। উৎসব মুখর পরিবেশে চলছে কেনা বেচা। ঐতিহ্যবাহী এ মাছের মেলার আয়োজকরা জানান এবছর মেলায় প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ উঠেছে। অন্য বছরের চাইতে এবছর স্থানীয় নদী ও হাওরগুলোর মাছ বেশি। তার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা জানালেন গেল বছর দফায় দফায় বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় মাছের উৎপাদন হয়েছে বেশি। বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হলেও মাছের জন্য তা ছিল অনুকূল। মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি মো: ওলিউর রহমান ও আড়তদাররা জানালেন মেলায় ১ম দিন মধ্যরাত পর্যন্ত ১০-১২ কোটি টাকার মাছ ক্রয় বিক্রয় হয়েছে। তাদের প্রত্যাশা শেষ দিন পর্যন্ত অন্ত ১৫-২০ কোটি টাকার মাছ এখানে ক্রয় বিক্রয় হবে। শুক্রবার রাতে দেখা গেল মাছের মেলায় মানুষের স্রেত। কুশিয়ারা নদীর তীরজুড়ে মাছের কয়েকশত দোকান। এই আয়োজনই জানান দিচ্ছিল মেলা উপলক্ষে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার। এটি সিলেট বিভাগের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। মেলায় উঠেছে নানা জাতের বিশাল মাছ। এমন অদেখা বড় মাছ দেখতে আর কিনতে দর্শক ক্রেতার কমতি নেই। দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মাছের এমন সমারোহে যেন ফিরে এসেছে মাছের সেই হারানো সোনালী অতীত। মেলায় এক সাথে বড় আকারের এত মাছ দেখে নতুন আগুন্তুকরা আশ্চর্য হচ্ছেন। তাই বাড়তি কৌতুহল নিবারণে তারা পুরো মাছের মেলা ঘুরে দেখছেন। মূলত ওখানে একরাত আর দু’দিনই ধুম পড়ে মাছ কেনা বেছার। জানা যায় পৌষ সংক্রান্তিকে ঘিরে আয়োজন হয়েছিল এ মাছের মেলার। প্রায় দুই শ’ বছর পূর্বে মৌলভীবাজারের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীর জুড়ে শুরু হয়েছিলো এই মাছের মেলা। ঐতিহ্যের ঠানে যা এখনো স্থানীয়রা তা ধরে রেখেছেন। তাই প্রতিবছরই মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের পাশে শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীরে এ মাছের মেলার আয়োজন করে স্থানীয়রা। মেলা চলে রাত দিন। স্থানীয়রা জানালেন মেলার নির্ধারিত স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের এক দুদিন আগে থেকেই জমে উঠে ইমিটেশন, খেলনা, কাপড়,জুতা,গৃহস্তালীর প্রয়োজনীয় নানা জিনিষপত্রের দোকান। আর বাদ যায়নি মুড়ি মুড়কি আর মন্ডা মিঠাইসহ কতকি মুখরোচক খাবার দাবারে আয়োজন। মাছের মেলাটি এখন এ অঞ্চলের আনন্দ উৎসবের অন্যতম খোরাক। তাছাড়া অস্থায়ী গাড়ি পার্কিংয়ের স্টল বেশ ভালো আয় হয় তরুণদের। মেলাস্থল শেরপুর হলো মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার একেবারেই শেষভাগে। পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলা উত্তরে কুশিয়ারা নদী। নদী পাড় পেরুলেই সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা। হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার এই তিনটি জেলার মোহনা হলো শেরপুর। মৎস্য ব্যবসায়ী আর স্থানীয়দের জোর দাবি এটিই দেশের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা। যদিও মেলাটি এ অঞ্চলে মাছের মেলা নামে পরিচিত। তারপরও মাছ ছাড়া বিভিন্ন দ্রব্যের কয়েক হাজার দোকান বসে কুশিয়ারা নদীর তীর জুড়ে। মেলায় মাছ ছাড়া বেত-বাঁশ, কাঠ, লোহা ও মাটির তৈরি নানা রকম পণ্য,শিশুদের খেলনা, সবজি-আনাজ অনেক ধরনের লোকজ পণ্য,ফার্নিচার, কৃষি পণ্য, গৃহস্থালী সামগ্রী, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকানসহ থাকে গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা রং ঢং আর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহ্রসাধীক দোকান বসে। মেলায় উঠেছে সিলেটের কুশিয়ারা, সুরমা ও মনু নদী,হাকালুকি,কাওয়াদিঘি, হাইল ও টাঙগুয়ার হাওর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা বাঘ, রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, বোয়াল, গজার, কারফু, ঘাসকাপ, সিলভার, আইড়সহ নানা জাতের দেশীয় প্রজাতির বিশাল বিশাল মাছ নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন। মেলা ঘুরে দেখা গেল মাছ বিক্রেতা মো: সাইদুল ইসলাম প্রায় ৬৫ কেজি ওজনের একটি আইড় মাছের দাম হাঁকছেন ১লক্ষ ২০হাজার টাকা আর ক্রেতারা দর করছেন ৭৫ হাজার টাকা। সাইদুল জানালেন তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, মাছটি যমুনা নদীর, মেলায় বিক্রির জন্য তিনি নিয়ে এসেছেন। বিক্রেতা মো: ইমরান মিয়া প্রায় ২৫ কেজি ওজনের কাতলা মাছের দাম চাইছেন ৫৫ হাজার টাকা আর ক্রেতারা দাম বলছেন ২৫ হাজার টাকা। ১৫ কেজি ওজনের কার্প (কারফু) মাছের দাম হাঁকছেন ৪৫ হাজার টাকা। বিক্রেতা খোকন মিয়া ও আলী হোসেন ৩০ কেজির বোয়াল ও ৪২ কেজি বাঘ মাছ দাম চাইছেন ৮৫ ও ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু ৪৫-৩০ হাজার টাকার উপরে উঠছেন না ক্রেতারা। মাছ বিক্রেতা সুনামগঞ্জের শামসুদ্দিন বললেন ৩-৪ বছর থেকে তিনি মেলায় মাছ বিক্রি করছেন। নানা কারণে স্থানীয় নদী ও হাওরে আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। তবে এবছর আগের চাইতে মাছের যোগান ভালো। তারা মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে নানা জাতের মাছ সংগ্রহ করেন। মেলায় মাছ কিনতে আসা মৌলভীবাজারের কদমহাটার সৈয়দ আল নাহিয়ান ও সিকরাইলের মোজাহিদ আলী খান, শেরপুরের মো: নাছির আহমদ, কুলাউড়ার বিপুল বিশ^াস, অলক দেব, শাকিল আহমদ, ডা: সজল কানু, সিলেটের জলালাবাদ এলাকার মো: ফরিদ বেগ, উপশহরের ইলিয়াছ মিয়াসহ অনেকেই জানান বাজারে প্রচুর মাছ উঠলেও বিক্রেতারা দাম চাইছেন বেশি। তবে অন্যবছরের চাইতে এবছর দাম তুলনামূলক কম। তারা জানালেন একসাথে পচন্দের বড় আকারের এতো মাছ পেয়ে খুশি। কারণ এ মেলায় স্থানীয় হাওর ও নদীর মাছ থাকায় অনেক বড় মাছই থাকে জীবিত আর ফরমালিন মুক্ত। পুক্ত এ মাছ গুলো খেতেও সুস্বাদু। স্থানীয়রা জানান মেলা উপলক্ষে প্রবাসী অধ্যুষিত এ অঞ্চলের শেরপুর, নবিগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ আশেপাশের সৌখিন অনেক প্রবাসীরা মেলার জন্য দেশে আসেন। তাছাড়া মেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাসিন্দাদের আতœীয় স্বজনরাও আসেন তাদের বাড়িতে। নানা স্বাদের মাছ আর নানা জাতের পিঠা তৈরীতে উৎসবের আমেজে জমে উঠে পুরো এ অঞ্চল। জেলা প্রশাসন কার্যালয় সুত্রে জানা যায় এবছর মাছের মেলাতে যাতে কোন ধরনের অশ্লিতা না হয় সে জন্য তারা পদক্ষেপ নিয়েছেন। রয়েছে পুলিশি টহল। তাই গত বছরের মত এবছর মাছের মেলাতে জুয়া,পুতুল,অশ্লিল নৃত্য ও যাত্রা না থাকায় খুশি পুরো জেলাবাসি। মেলায় আগত দর্শক ও ক্রেতারা এ জন্য পুলিশ প্রশাসন ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন তাদের এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগের কারণে গেল বছর থেকে মাছের মেলা তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে।
×