ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আগামীতে সমৃদ্ধ দেশ ॥ জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

আগামীতে সমৃদ্ধ দেশ ॥ জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয় এ বিষয়ে সচেতন হয়ে দেশবাসীকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমরা উন্নয়নের যে মহাসড়কে যাত্রা শুরু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে আর পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে সকল বাধা দূর করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তাই আসুন, দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম পাবে সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সরকারের চতুর্থ বর্ষ পূর্তি দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী এ বছরেরই শেষদিকে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করবে। আগামী নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সকল দল অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করার পাশাপাশি দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন কোন মহল আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করতে পারে। দেশবাসীকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ অশান্তি চায় না। নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনের নামে জনগণের জানমালের ক্ষতি করবে- এটা আর এদেশের জনগণ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। এই কমিশন ইতোমধ্যে দুইটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ে কিছু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। আমি আশা করি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সকল দল আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবেন। দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আপনারাই সকল ক্ষমতার মালিক। কাজেই লক্ষ্য আপনাদেরই ঠিক করতে হবে- আপনারা কী চান। আপনারা কি দেশকে সামনে এগিয়ে যাওয়া দেখতে চান, না বাংলাদেশ আবার পিছনের দিকে চলুক তাই দেখতে চান। একবার ভাবুন তো মাত্র ১০ বছর আগে দেশের অবস্থানটা কোথায় ছিল? আপনারা কি চান না আপনার সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্বাবলম্বী হোক? আপনারা কি চান না প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে যাক। আপনারা কি চান না প্রতিটি গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হোক। মানুষ দু’বেলা পেট পুরে খেতে পাক। শান্তিতে জীবনযাপন করুক। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আমরা আর দরিদ্র হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই। এসব যদি আপনাদের চাওয়া হয়, তাহলে আমরা সব সময়ই আপনাদের পাশে আছি। কারণ, আমরাই লক্ষ্য স্থির করেছি যে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করব। তিনি বলেন, শুধু লক্ষ্য স্থির করেই কিন্তু আমরা বসে নেই। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় কর্মসূচী প্রণয়ন করে সেগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। আমরা অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই না; তবে অতীতকে ভুলেও যাব না। অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে, ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাব। আমরা উন্নয়নের যে মহাসড়কে যাত্রা শুরু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে আর পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে সকল বাধা দূর করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করে। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের গত চার বছর মেয়াদে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন, সফলতা ও অগ্রগতির বিস্তারিত তথ্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। একইসঙ্গে মেয়াদের বাকি এক বছরে তাঁর সরকার কী কী কাজকে প্রাধান্য দেবেন, দেশকে আরও এগিয়ে নিতে তাঁর সরকারের গৃহীত পরিকল্পনার কথাও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার বিচারের ভার দেশবাসীর ওপরই ছেড়ে দেন। সফলতা ও ব্যর্থতার বিচারের ভার দেশবাসীর ॥ প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে আরও বলেন, ২০১৪ সালে আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আজকের এই দিনে আমি তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলাম। চতুর্থ বছরপূর্তিতে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হাজির হয়েছি। আমার উপর যে বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলেন, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি আপনাদের মর্যাদা রক্ষা করার। কতটুকু সফল বা ব্যর্থ হয়েছি সে বিচার আপনারাই করবেন। নির্বাচন বানচালের নামে ভয়াল সন্ত্রাস ॥ আন্দোলন ও নির্বাচন বানচালের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাসের চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াত জোট সারাদেশে নির্মম সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়েছিল। নির্বাচনের দিন ৫৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করে প্রিসাইডিং অফিসারসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। ২০১৩ থেকে ২০১৫-এই তিন বছরে বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীদের হাতে প্রায় ৫০০ নিরীহ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গাড়ি, ২৯টি রেলগাড়ি ও ৯টি লঞ্চ পোড়ানো হয়। ৭০টি সরকারী অফিস ও স্থাপনা ভাংচুর এবং ৬টি ভূমি অফিসে আগুন দেয়া হয়। মসজিদে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় পবিত্র কোরআন শরীফ। তাদের জিঘাংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি রাস্তার গাছ এবং নিরীহ গবাদিপশু। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত ২১ বছর এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ বছর- এই ২৮ বছর বাংলাদেশের জনগণ বঞ্চিত থেকেছে। যারা ক্ষমতা দখল করেছে তারা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত ছিল। জনগণের কল্যাণে তারা কোন ভূমিকা রাখেনি। বরং আমরা জনকল্যাণে যেসব কাজ হাতে নিয়েছিলাম তারা তা বন্ধ করে দেয়। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আশু করণীয়, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, গ্রহণ করেছি দশ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। সরকারের ধারাবাহিকতার কারণেই দেশের এতো উন্নতি-অগ্রগতি ॥ প্রধানমন্ত্রী টানা ৯ বছর ধরে তাঁর সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতির চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পেরেছি বলেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছি। ৯ বছর একটানা জনসেবার সুযোগ পেয়েছি বলেই বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছি। জনগণ এর সুফল ভোগ করছেন। মধ্যম আয়ের মর্যাদার পথে বাংলাদেশ ॥ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পেয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৫ সালের ৫৪৩ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপি’র আকার ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। ৯ বছরে ২৬ হাজার প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত ৯ বছরে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। ১ হাজার ৪৫৮টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। ৩৬৫টি কলেজ সরকারীকরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম স্থাপন করেছি। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শতভাগ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাবে ॥ সরকারের ৯ বছরে বিদ্যুত খাতের প্রভূত উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই ৯ বছরে ১১৯টি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষ এখন বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছেন। ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের মাধ্যমে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনা হবে। সফলতার সঙ্গে জঙ্গীবাদ দমন করেছি ॥ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের রায়ও কার্যকর হয়েছে। বিডিআর হত্যার বিচার হয়েছে। আমরা সফলতার সঙ্গে জঙ্গীবাদ দমন করেছি। জনসচেতনতা সৃষ্টি করে এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
×