ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফিল্যান্ডারকে বধের ইতিবাচক শপথ নিতে হবে ভারতকে

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

ফিল্যান্ডারকে বধের ইতিবাচক শপথ নিতে হবে ভারতকে

অনলাইন ডেস্ক ॥ কেপ টাউনের ঘাটতি সেঞ্চুরিয়নে মেটাতে পারবে কি না বিরাট কোহালির ভারত, তা সময় বলবে। কিন্তু সোনার সুযোগ হাতছাড়া করে প্রথম টেস্টে হারের পরে দেরি না করে সোমবার রাতেই জরুরি বৈঠকে বসে পড়ল দল। জরুরি বৈঠকের কারণ দু’টো। এক) ময়নাতদন্তে বসে পড়া এবং দুই) হারের যন্ত্রণা যাতে গ্রাস করে না ফেলে তার জন্য সকলে মিলে একত্রিত হয়ে ধাক্কা সামলে ভবিষ্যতের রাস্তাকে ঠিকঠাক করা। শাস্ত্রী যখন আগে টিম ডিরেক্টর ছিলেন, এমন সোনার সুযোগ হাতছাড়া করার ঘটনা ঘটেছে। সেটা ছিল ২০১৫ সালের গল। নিশ্চিত ভাবে জেতা টেস্ট প্রথমে চান্দিমলের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে কঠিন হয়ে ওঠে। তার পর রঙ্গনা হেরাথের বাঁ হাতি স্পিনের ছোবলে সে দিন নীল হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। এখানে ভার্নন ফিল্যান্ডারের সুইং বোলিংয়ে অসাড় হয়ে গেল দেহ। গলের সেই বিপর্যয়ের পরে মাঠ ছেড়েই যাননি বিরাট-রা। দেড় ঘণ্টা ধরে ড্রেসিংরুমে বসে আলোচনা করেন হার নিয়ে। শাস্ত্রী সে দিন বিরাটদের বলেছিলেন, এমন টেস্ট আর জীবনে কখনও হেরো না। যা পোস্টমর্টেম করার, এখানে বসেই করো। যাতে হোটেলে ফিরে আমরা মনের দিক থেকে নিশ্চিত থাকতে পারি যে, কোথায় ভুলত্রুটি হল। কেন জেতা টেস্ট ম্যাচ এ ভাবে হারলাম। গলের সঙ্গে নিউল্যান্ডসের তফাত হচ্ছে, ময়নাতদন্ত ড্রেসিংরুমে নয়, হোটেলে ফিরে করা হল। কিন্তু গলের মতোই সততা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হল যে, কোথায় কী ভুল হয়েছে। গলে দেখা গিয়েছিল, হেরাথকে বড্ড বেশি সম্মান দিয়ে ফেলেছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা। কম্পিউটার বিশ্লেষককে ডেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, হেরাথের বিরুদ্ধে স্কোরিং রেট কী রকম ছিল। সেটা মিলিয়ে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কার বাঁ হাতি স্পিনারের বিরুদ্ধে প্রচুর ডট বল খেলেছিলেন কোহালি-রা। তাতেই ঘাড়ে চেপে বসেছিলেন হেরাথ। একই রকম বিশ্লেষণ যদি ফিল্যান্ডারকে নিয়েও বেরিয়ে আসে, অবাক হওয়ার থাকবে না। ব্যাটসম্যানদের জন্য ‘করিডর অব আনসার্টিনিটি’ হচ্ছে অফস্টাম্প। এটা চব্বিশ ঘণ্টা আগে নিউল্যান্ডসের মাঠেই প্রথম আবিষ্কৃত হল, এমন নয়। ক্রিকেটের পুরাতন প্রস্তর যুগ থেকেই রয়েছে। বরাবরই ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে দুর্বল এবং নড়বড়ে জায়গা অফস্টাম্প। সেই কারণে ওই লাইন ধরেই আক্রমণ শানান পেসাররা। বিশেষ করে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে অফস্টাম্প থিওরি খাটবে কারণ ঐতিহাসিক ভাবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বেশির ভাগই কব্জির ব্যবহার বেশি করেন। স্পিন খেলতে বেশি অভ্যস্ত বিরাট কোহালি-রা অধিকাংশই অন সাইডে বেশি ভাল খেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা যে ফিল্যান্ডারের মতো সুইং বোলারকে দিয়ে অনিশ্চয়তার উপত্যকা ধরেই বোমাবর্ষণ করবে, এটা জানার জন্য গোয়েন্দা হওয়ার দরকার ছিল না। একদম সঠিক পরিকল্পনামাফিক অফস্টাম্প লাইনে একটানা বল করে গিয়েছেন ফিল্যান্ডার। ঘণ্টায় ১২৫ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করেন তিনি। মেরেকেটে মিডিয়াম পেসার বলা যেতে পারে। কিন্তু হাতে বিষাক্ত সুইং রয়েছে। মাপা আউটসুইং করিয়ে যাবেন। কখনওসখনও ভিতরে কাট করে ঢুকে আসবে ক্ষিপ্র অফকাটার। যে রকম কোহালির ক্ষেত্রে ঢুকে এসে তাঁর উইকেট নিয়ে গিয়েছিল। দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ তাঁর বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র। ভারতীয় পেসারদের মতো নয় যে, তিনটে ভাল বল করে তার পরেই একটা আলগা বলে পুরো চাপটাই হাল্কা করে দেবেন। ফিল্যান্ডার বরং নাগাড়ে এক জায়গায় বল ফেলে ব্যাটসম্যানের শ্বাসরুদ্ধ করে মারবেন। এ রকম বোলারকে খেলতে গেলে পাল্টা স্ট্র্যাটেজি কিছু করা দরকার ছিল। সেটা ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা করেননি। মনে করা হচ্ছে, গলের হেরাথের মতোই তাঁরা বড্ড বেশি কুঁকড়ে ছিলেন ফিল্যান্ডারের সামনে। কেপ টাউন টেস্টে দুই ইনিংসে ফিল্যান্ডারের ইকনমি রেট (ওভার প্রতি দেওয়া রানের হিসেব) যথাক্রমে ২.২৭ এবং ২.৬৮। সেখানে প্রথম ইনিংসে ভারতের সবচেয়ে সফল বোলার ভুবনেশ্বর কুমার দিয়েছিলেন ওভার প্রতি পাঁচ রান করে। বোঝাই যাচ্ছে, ভুবি প্রথম তিন ওভারে তিনটে উইকেট তোলার পরে এ বি ডিভিলিয়ার্স-রা যে ভাবে তাঁকে পাল্টা আক্রমণ করেছেন, সেই নীতি কোহালিরা নিতে পারেননি ফিল্যান্ডারের বিরুদ্ধে। সুইংকে ভোঁতা করার জন্য পুরনো অস্ত্র রয়েছে ব্যাটসম্যানদের। ক্রিজ ছেড়ে সামনে দাঁড়াও। যাতে সুইং করার আগেই সেটা খেলে দেওয়া যায়। তখন সুইং না পেয়ে বোলারের ছন্দ নষ্ট হতে বাধ্য। অস্ট্রেলিয়ায় শাস্ত্রীর পরামর্শে এই রণনীতি নিয়েই মিচেল জনসনকে নির্বিষ করে দিয়েছিলেন কোহালি। চারটি টেস্টে চারটি সেঞ্চুরি করা সেই সিরিজকে মডেল করা উচিত ছিল এখানেও। ফিল্যান্ডার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন দেখেও ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা তাঁকে পাল্টা চাপে ফেলতে পারেননি। ধরে নেওয়া হয়েছিল, এই কাজটা করতে পারেন শিখর ধবন। তিনি সহজাত আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। শুরুতে তাঁর স্ট্রোক-প্লে দিয়ে ধবন বোলারদের ছন্দ নষ্ট করে দিতে পারেন বলেই না কে এল রাহুলের মতো টেকনিকে পোক্ত ব্যাটসম্যানকে বসিয়ে তাঁকে দিয়ে ওপেন করানো হচ্ছে। কিন্তু তিনি নিউল্যান্ডসে দুই ইনিংসে ব্যর্থ তো হয়েইছেন, কোনও লড়াই-ই দেখাতে পারেননি। মনে করা হতো মুরলী বিজয় বা চেতেশ্বর পূজারার অফস্টাম্পের বাইরের বল খেলার মতো ভাল টেকনিক রয়েছে। কিন্তু তাঁরাও সেই সুনাম রাখতে ব্যর্থ। সুইং সামলাতে ক্রিজের বাইরের দাওয়াই-ও তাঁরা কাজে লাগাননি। পরের দিকে অশ্বিন এই থিওরি প্রয়োগ করে সফল হচ্ছিলেন। সেই কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি বেশ খানিক্ষণ টিকেছিলেন। স্লিপ থেকে ফ্যাফ ডুপ্লেসি প্রথম সেটা নজর করেন যে, অশ্বিন ক্রিজের অনেকটা বাইরে দাঁড়িয়ে ফিল্যান্ডারের সুইং খেলে দিচ্ছেন। নজর করামাত্র উইকেটকিপার কুইন্টন ডি’কক-কে তিনি উইকেটের কাছে এসে দাঁড়াতে বলেন। যে হেতু ফিল্যান্ডারের গতি কম, ডি’কক এই ঝুঁকি নিতে পারলেন। অশ্বিনকেও সঙ্গে সঙ্গে ক্রিজের মধ্যে ঢুকে পড়তে হল। না হলে তিনি স্টাম্প্ড হয়ে যেতেন। আর যে-ই না ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালেন, ফিল্যান্ডারের সুইংও ফিরে এল এবং ওভারের শুরুতেই অশ্বিন আউট। কারও কারও মনে হচ্ছে, ফিল্যান্ডারকে কতক্ষণ আর উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিপিং করতে পারবেন ডি’কক। নতুন বলে কি সেটা সম্ভব হবে? সুইংকে ভোঁতা করার জন্য ক্রিজের বাইরে দাঁড়ানোর টোটকা প্রয়োগ করা যেতেই পারে। আরও একটা ব্যাপারে মনে হয় না ভারতীয় শিবিরে কোনও দ্বিমত থাকবে। ফিল্যান্ডারের জীবনও কিছুটা কঠিন করে তুলতে হবে। তাতে দরকার হলে বুঝেশুনে ঝুঁকি নিতে হবে। হার্দিক পাণ্ড্য যে রণনীতি নিয়ে সফল হয়েছেন। গলের সেই টেস্ট হারের পরে হেরাথ-বধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আরও ইতিবাচক হওয়ার শপথ নিয়েছিল কোহালির ভারত। ফিল্যান্ডার রহস্য সমাধান করতে হলেও সম্ভবত একই পথে হাঁটতে হবে তাঁদের। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×