ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে সংরক্ষিত বনে অবৈধ কয়লার কারখানা

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

টাঙ্গাইলে সংরক্ষিত বনে অবৈধ কয়লার কারখানা

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ টাঙ্গাইলের সখীপুরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে অবৈধ করাতকলের পর এবার কমপক্ষে ২০টি অবৈধ কয়লা কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অবাধে শাল-গজারিসহ বনের বিভিন্ন কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানানো হচ্ছে। এতে সামাজিক বনায়ন উজাড়ের পাশাপাশি কালো ধোঁয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। জানা গেছে, সখীপুর উপজেলার তেঁতুলিয়াচালা গ্রামে পাঁচটি, কীর্তনখোলা গ্রামের ধুমখালী পাড়ায় ছয়টি এবং কালিয়ারপাড়া গ্রামে পাঁচটি কয়লার কারখানা দেখা গেছে। এলাকা তিনটি টাঙ্গাইল বন বিভাগের হাতিয়া রেঞ্জের কালিদাস বিট কার্যালয়ের আওতাধীন। এসব গ্রামে বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন ও শাল-গজারির বাগান রয়েছে। বন বিভাগের কালিদাস বিটের তেঁতুলিয়াচালা এলাকায় বনের পাশেই ছয়টি বড় চুলা করে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। চুলাগুলো মাটির তৈরি। কারখানার আশপাশে কাঠ স্তুপ করে রাখা আছে। কারখানার চারপাশে বন বিভাগের গাছপালা রয়েছে। এই কারখানায় চার-পাঁচজন শ্রমিক কাজ করে প্রতিদিন। কারখানাটির মালিক সখীপুর উপজেলার কালমেঘা গ্রামের সাকাওয়াত হোসেন সাকা। কারখানার শ্রমিক লাবু মিয়া বলেন, বনের কর্মকর্তা মাঝে মধ্যে ফোন দিয়ে সাকা ভাইকে দেখা করতে বলেন। সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করেই তাঁরা কয়লা পোড়ানোর কাজ করছেন। কারখানার অংশীদার গাইবান্ধা এলাকার রেজোয়ান বলেন, বন বিভাগের লোকজন, এলাকার লোকজন, কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই পুড়ানো ব্যাটারির এসিড দিয়ে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরী করা হচ্ছে। এসব কথা বলার সময় কাঠ পোড়ানোর চুলা থেকে ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছিল। জানা যায়, এসব কারখানায় সাধারণত কাঁচা কাঠ পোড়ানো হয়। যা থেকে ব্যাপক হারে ধোঁয়া নির্গমন হয়। সাকাওয়াত হোসেনের ওই কারখানা থেকে ১০০ গজের মধ্যে আবদুল করিমের বাড়ি। তিনি বলেন, ‘প্রচুর ধোঁয়ায় ও গন্ধে বাড়িতে টেকা যায় না। কাশতে কাশতে প্রাণ যায়। আমার মনে হয়, আর কিছুদিন ওই কারখানায় থাকলে রোগেশোকেই আমরা মারা যাব।’ পাশের কীর্তনখোলা গ্রামে শাহজাহান মিয়ার বাড়ির ভেতরে কয়লা কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। শাহজাহান বলেন, এই গ্রামে তাঁর মতো আরও অন্তত পাঁচটি বাড়িতে কয়লার কারখানা রয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, কারখানায় বনের কাঠ পোড়ানো হয় না। বন বিভাগের লোকজন মাঝে মধ্যে এসে বিষয়টি পরিদর্শন করে যান। শুধু কালিদাম বিটে নয় বাঁশতৈল, বহেড়াতলী রেঞ্জের অন্যান্য বিটেও একইভাবে কয়লা কারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে অত্র এলাকার হাজার বছরের ঐতিহ্য শাল-গজারি বাগান উজাড় হয়ে যাচ্ছে। তবে এলাকার বেশকয়েকজন জানান, এসব কারখানায় গজারি, আম, কাঁঠাল, আকাশমণি, মেহগনি গাছের কাঠ ও মোটা ডালপালা পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়। সেই কয়লা বস্তায় ভরে টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কামারদের কারখানায় ও হোটেলে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করা হয়। এক বস্তা কয়লা ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তেঁতুলিয়াচালা গ্রামে কয়লা কিনতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘কয়লা কারখানা না থাকলে কামারশিল্প চলবে কী করে? তা ছাড়া কয়লা কারখানা বানিয়ে কেউ কোটিপতি হয় না। এই পেশা থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলে।’ বন বিভাগের দাবি, এসব কারখানার বেশির ভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে। অস্থায়ী এসব কারখানায় বনের কাঠ পোড়ানো হয় না। ফলে এ নিয়ে তাদের তেমন কিছু করার নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) টাঙ্গাইল শাখার জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিরী বলেন, বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকলসহ বন ও পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো কারখানা গড়ে তোলা বেআইনি। অবৈধ কয়লা কারখানার ধোঁয়া পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কালো ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। বন বিভাগের কালিদাস বিটের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার জানামতে ওই কারখানাগুলোতে বনের কাঠ পোড়ানো হয় না। তবে পরিবেশ দুষন ও জনমানব গাছপালার ক্ষতির জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করব। বনের কাঠ পোড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বন আইনে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তবে তিনি এসব কারখানা থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা নেয়ার কথা অস্বীকার করেন। টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) সাজ্জাদুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে গাছ কেটে কয়লা উৎপাদন করার কোন বৈধতা কারও নেই। এ বিষয়ে বন বিভাগ আমাদের সবসময়ই পাশে পাবে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হোসাইন মুহম্মদ নিশাদ বলেন, আমি বিষয়টি জানি না। তবে অভিযোগের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×