স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের কোনো দল ‘একলা চল’ নীতিতে চললে সেটি আত্মঘাতী হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে দলের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে ঘোষিত ২১ দফার কর্মসূচীকে এগিয়ে নিতে ও ৩ মার্চ শনিবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তবে মেননের কাছে সাংবাদিকদের বেশিরভাগ প্রশ্নই ছিল মন্ত্রিসভায় রদবদল ও বিমান মন্ত্রী হিসেবে সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে। তবে বেশিরভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন প্রবীণ এই বাম নেতা।
বুধবার মন্ত্রিসভায় চার মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর বদল করা হয়। এর মধ্যে তিন জনই শরিক দল অথবা বিরোধী দলের। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক মেননকে বিমান মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সমাজকল্যাণে পাঠানো। তিনি এই সিদ্ধান্তকে বিমান থেকে মাটিতে নামার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এই অবস্থায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির কাছে জানতে চাওয়া হয়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ঐক্য ভেঙে যাওয়ার কোন আশঙ্কা আছে কি না। জবাবে মেনন বলেন, আন্দোলন ও নির্বাচন জোট হিসেবে একসাথেই করতে চাই। আমি মনে করি চৌদ্দ দলের ঐক্য অব্যাহত থাকবে এবং চৌদ্দদলের ঐক্যকে সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। একলা চল নীতিতে বিজয় আনা সম্ভব না’-এমন মন্তব্য করে মেনন বলেন, আমি বলব ঐক্যটাকে সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। আমিও যদি এখন একলা চলতে চাই সেটাও আত্মঘাতী হবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে মন্ত্রিসভায় রদবদলকে কীভাবে দেখছেন-এমন প্রশ্নে মেনন বলেন, নির্বাচন যখন আসে তখন নানাবিধ ইকোয়েশন (সমীকরণ) আসে। এই পরিবর্তন একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক হিসাব নিকাশ থেকে। সবকিছু হিসাবের মধ্যে হয়ত হয়েছে।
বিমানমন্ত্রী হিসেবে সফল ॥ গত চার বছর ধরে বিমান মন্ত্রী হিসেবে সব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করে ওই মন্ত্রণালয়কে লাভজনক অবস্থানে রাখতে পেরেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন মেনন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়াকে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দখছেন সাবেক বিমানমন্ত্রী। বলেন, এখানে আরো বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, এই মন্ত্রণালয়ে এসে আমি একদম সাধারণ মানুষ, দলিত, সংখ্যালঘুসহ সকল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করতে পারব। আমি মনে করি এই মন্ত্রণালয়েও আমার জন্য অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ আসবে। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে আমি আনন্দিত। আশা করি এখানেও সফলভাবে কাজ করতে পারব।
বিমান মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে মেনন বলেন, ‘কিছু সমস্যার সমাধান করা যায়নি। এটার কারণ ছিল আমাদের বিমানবন্দরের অবকাঠামোর কারণে। তবে রাত একটার দিকে কেউ আমাকে ফোন করে বলেনি, আপনার বিমান আটকে আছে। এ মন্ত্রণালয়ে চার বছরের দায়িত্ব পালনে আমি তৃপ্ত বলে মনে করি।
আমি দাবি করি যে, এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ বিমান পর পর তিন বছর মুনাফা করেছে। এছাড়া শিডিউল বিপর্যয় এড়িয়ে ৭৫ শতাংশ বিমান শিডিউল অনুযায়ী চলাচল করছে। ৭৬ দশতিক ৪ শতাংশ রিজিওনাল পার্কিং ব্যবস্থা করা হয়েছে।
২০১০ সালে দেশে পর্যটন নীতিমালা করা হয় জানিয়ে এই মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী বলেন, এর মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটনখাত একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক কোটি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পার্টির সাধারণ ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরো সদস্য বিমল বিশ্বাস, আনিসুর রহমান মল্লিক, নুরুল হাসান, মাহমুদুল হাসান মানিক, সুশান্ত দাস, নুর আহমদ বকুল, হাজেরা সুলতানা এমপি, কামরূল আহসান প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এবছরটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ বছরেই জাতীয় নির্বাচন হতে চলেছে। এবছরই নির্ধারিত হবে যে ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নের ধারায় দেশ এগিয়েছে তা অব্যাহত থাকবে, নাকি বিএনপি-জামাত জোট শাসনের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ জঙ্গিবাদের পুনরুত্থানে দেশ আবার পিছিয়ে যাবে অন্ধকারের পথে।২০০৮ সালের পর দেশ আবার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসেছে। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি পুনর্বাসিত হয়েছে। বিচার হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনী আর একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী মূল চক্রের। হেফাজতীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা গেছে। প্রতিরোধ করা গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামাত-শিবিরের নিষ্ঠুর তান্ডবের।
একইভাবে ২০১৪ এর নির্বাচনকে বানচাল করতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার তথাকথিত অবরোধ, আগুন, সন্ত্রাস, নারী-শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা, প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা, ভোটের দিন চারশ স্কুল অগ্নিসংযোগে ঘটনাবলীকে প্রতিরোধ করে পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিকে অব্যাহত রাখতে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশগ্রহণ করে এবং নির্বাচন পরবর্তীতেও সরকারে আছে। এসবই এ সময়কালে এদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের বড় অর্জন।
সরকারের উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ এর বৃত্ত পেরিয়ে ৭ দশকি ২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৬০০ ডলারের উপরে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫ এর ৪৫ ভাগ থেকে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। বাজেট আর বিদেশ নির্ভর নয়। নিজের অর্থায়নেই পদ্মাসেতু হচ্ছে। নতুন প্রজাতির বীজ, সার, সেচ ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত প্রয়োগে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রভূতভাবে। এখন বাংলাদেশের চাল উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় তিনকোটি পঞ্চাশ লক্ষ টনের কাছাকাছি। বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামের মানুষের ঘরে। ঘটেছে যোগাযোগের উন্নয়ন। বাংলাদেশের গ্রাম এখন পরিবর্তনের ধারায় উঠে আসছে। শিল্পক্ষেত্রে পোশাক শিল্প পৃথিবীর দ্বিতীয় স্থানে। এই শিল্প আশিভাগ নারীসহ প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। কিন্তু তিন দশকের বিরাষ্ট্র্রীয়করণ প্রক্রিয়া ও নয়াউদারনীতিক বাজার অর্থনীতিকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করায় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
লিখিত বক্তব্যে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানায় বিশাল সংখ্যক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, জালিয়াতি প্রভৃতি দুর্বৃত্তপনা এই ক্ষেত্রকে লুটেরার রাজত্বে পরিণত করেছে। ঋণ খেলাপীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচার অব্যাহত গতিতে চলছে। শিক্ষা বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, বৃহৎ বইয়ের বোঝা পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকরণ এসব ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্যগুলিকে ম্লান করে দিচ্ছে। বিশালসংখ্যক শিক্ষিত যুবক বেকার। সন্ত্রাস, মাদকাশক্তি, জঙ্গিবাদী ধ্যান ধারণার বিস্তার ঘটছে যুবকদের মধ্যে ব্যাপকহারে।
তাছাড়া দেশে অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, সম্পত্তি দখলের অসদ্দুশ্য এবং অন্যান্য কারণে ঘটছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। সমাজমানসেও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। বিএনপি-জামাত শাসনের দুর্নীতি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান কলংক থেকে মুক্ত হওয়া গেলেও, অর্থনীতি রাজনীতি প্রশাসনে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। গুম, হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানী, চাঁদাবাজী, দখলদারিত্ব মানুষের নিরাপত্তা করছে বিঘিœত। অপসংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার সমাজ মানসকে করছে বিকৃত।