ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় কিউবা

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ১ জানুয়ারি ২০১৮

নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় কিউবা

১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে কিউবা এই প্রথম এমন একজনের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে যার পদবী বা বংশনাম ক্যাস্ট্রো নয়। বিপ্লবের জনক ফিদেল ক্যাস্ট্রো ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেছিলেন। এরপর তার ভাই রাউল ক্যাস্ট্রো) দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। সেই রাউল ক্যাস্ট্রো ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল। ক্ষমতার এই উত্তরণের বিশাল প্রতীকী গুরুত্ব আছে। শ্মশ্রুম-িত, মুখে চুরুট ধরা ফিদেল ক্যাস্ট্রো ২০১৬ সালে মারা যান। এই কমিউনিস্ট বিপ্লবী দুনিয়াব্যাপী শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন। কমিউনিজমের সূতিকাগার সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশে এই মতাদর্শের পতন ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৯০ মাইলের মধ্যে অবস্থিত কিউবার তিনি ঠিকই কমিউনিজমকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। এটা তার এক অসাধারণ অর্জন ও সাফল্য। ফিদেলের অনুজ রাউল ক্যাস্ট্রোর বয়স এখন ৮৬ বছর। ফিদেলের তুলনায় তিনি নিষ্প্রভ সন্দেহ নেই। তবে তরুণ বিপ্লবী হিসেবে তিনি বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ফিদেলের গেরিলা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর জায়গায় যিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তাঁর সেই সংগ্রামের স্মৃতি থাকার কথা নয় এবং থাকবেও না। তিনি এক ভিন্ন দৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখার চেষ্টা করবেন। এভাবেই আগের প্রজন্ম ধীরে ধীরে দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হয়ে যাবেন। প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিদায় নিলেও রাউল কিউবার নেতৃস্থানীয় শক্তি কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান থেকে যাবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে এবং সেটা ২০২১ সাল পর্যন্ত। বিপ্লবের পর এই প্রথমবারের মত কমিউনিস্ট পার্টি নেতা নির্বাহী ক্ষমতা এবং সম্ভবত সেনাবাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব থেকেও বঞ্চিত হবেন। গত ৫৯ বছর ধরে কিউবার সিদ্ধান্ত নির্ধারক হিসেবে একজনই মাত্র ভূমিকা পালন করে এসেছিলেন। ২০১৮ সালের শুরু থেকে অন্তত কিছুকালের জন্য সেই সিদ্ধান্ত নির্ধারক থাকবেন দুজন। তাদেরকে বড় বড় যেসব প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হবে তার মধ্যে একটি হচ্ছে কিউবার কমান্ড অর্থনীতি থেকে উদার অর্থনীতিতে উত্তরণ ত্বরান্বিত করা হবে, মন্থর করা হবে, নাকি একেবারেই বদলে দেয়া হবে। বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, কিউবার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নির্ধারক ও প্রেসিডেন্ট হবেন ৫৭ বছর বয়স্ক মিগুয়েল দিয়াজ-কানেন যিনি বর্তমানে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু জানা নেই। আশির দশকে অর্থাৎ বিপ্লবের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়ে বয়োপ্রাপ্ত হওয়া এই মানুষটি স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তবে হাভানার এক বি্েশ্লষকের চোখে কিউবার মানদ-ে তিনি একজন উদারপন্থী। দিয়াজ-কানেল যে একজন উদারপন্থী তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ২০১৩ সালে। সে সময় একদল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের অতি জঘন্য ধরনের ব্লগ বন্ধ করে দেয়া হলে তিনি সেই ব্লগারদের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন। “এল মেজুনজে” নামের একটি সমকামী ক্লাবের পক্ষেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সে সময় এ ধরনের ভূমিকা নেয়া বেশ সাহসিকতার পরিচায়ক ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রকাশ পাওয়া এক ভিডিওতে দিয়াজ-কানেলের এই সহনশীল ভাবমূর্তিটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ভিডিওতে তাঁকে পার্টি কর্মীদের এক সমাবেশে কিউবা সরকারের সমালোচনাকারী মিডিয়া, শিল্পোদ্যোক্তা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর শাণিত কশাঘাত হানতে দেখা গিয়েছিল। দিয়াজ-কালের প্রেসিডেন্ট হওয়া যে অবধারিত এমনটা আবার অনেকে মনে করেন না। তাদের ধারণা, এই পদটা পার্টির ১৭ সদস্যের পলিটব্যুরোর সদস্য অপর অভিজ্ঞ তরুণদের যে কোন একজনের হাতে যেতে পারে। তবে যার হাতেই যাক না কেন, তাঁকে একটা সমস্যাসঙ্কুল দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে এই দেশটির সাহায্য সমর্থন কিউবার জন্য এক বিশাল আশীর্বাদ ছিল। সোভিয়েতের পতনে সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। কিউবার অর্থনীতি মন্দায় চলে যায়। কিউবাকে তখন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে ভেনিজুয়েলা। দেশটির ভর্তুকি দরে দেয়া তেল কিউবার অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে। কিউবার পর্যটনশিল্প, ওষুধশিল্প ও তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের মত বিকাশমান শিল্পগুলো অর্থনীতির ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট অর্থ যোগাতে পারেনি। সরকার আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে হ্যারিকেন ইরমার ছোবলে কিউবার পর্যটন শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিদ্যুত সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়। এতে উপর্যুপরি দ্বিতীয় বছরের মত অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। অর্ধেকসংখ্যক কিউবান নিদারুণ দুদর্শার মধ্যে রয়েছে। বিরোধী দল থাকলেও তা দুর্বল ও বিভক্ত এবং দমন নির্যাতনের শিকার। এমন পটভূতিতে কিউবার পরবর্তী নেতাদের পরিবর্তনের দিকে যেতে হবে। পরিবর্তন বা সংস্কার আনতে না পারলে একটা সময় আসবে যখন জনগণ বিরাজমান পরিস্থিতি আর মেনে নিতে চাইবে না। তখন সমাজের অভ্যন্তরে নতুন করে শুরু হবে টানপোড়েন ও অস্থিরতা।
×