ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাকৃতিক দুর্যোগের বছর নাকি মন্দার বছর ২০১৮

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ১ জানুয়ারি ২০১৮

প্রাকৃতিক দুর্যোগের বছর নাকি মন্দার বছর ২০১৮

২০১৮ সালটি কেমন যাবে? স্বভাবতই এই প্রশ্নের দিকে রয়েছে পর্যবেক্ষকদের কৌতূহলী দৃষ্টি। ২০১৬ সালটি ছিল দেশে দেশে পপুলিস্টদের বিজয়ে শকওয়েভ সৃষ্টি ও বিশ্বায়নের বিরোধিতার বছর। সে তুলনায় ২০১৭ সালটি প্রশান্তির বছর হিসেবে কেটেছে। যদিও হৈ চৈ ও টালমাটাল যে কিছু হয়নি তা নয়। ২০১৮ সালে তিনটি ঘটনা আধুনিক যুগের রাষ্ট্র ও বাজারের মধ্যে ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাবে। প্রথমটি টেক কোম্পানিগুলোর ওপর আঘাত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এই আঘাত শুরু হলেও তা সবচেয়ে নাটকীয় রূপ নেবে আমেরিকায়। দ্বিতীয় শক্তি ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েন ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন তথা ম্যাকাবাদ এবং তৃতীয়ত চীনের ক্রমপ্রসারণ শক্তি ও অভিপ্রায় নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ থেকে এই দেশটির প্রতি পরিবর্তনশীল মনোভাব। এই তিনটি বিষয় রাষ্ট্র ও বাজারের মধ্যে ভারসাম্যের পরিবর্তনের নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে। তবে তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। মন্দের মন্দ হলে পরিণতিতে আরও নিয়ন্ত্রিত, রক্ষণাত্মক ও সংরক্ষণবাদী পুঁজিবাদের পুনরুত্থান ঘটতে পারে অথবা গড়ে উঠতে পারে ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক নতুন ব্যবস্থা। বিশ্ব অর্থনীতিতে সুবাতাস না মন্দা? ২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে সুবাতাসের ভাব দেখা দেবে। মহামন্দা শুরু হওয়ার ও তার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রায় এক দশক ধরে দুর্যোগ বিপর্যয় চলার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিসরে সূক্ষ্ম ও ভালবোধ করার পরিবেশ আসবে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ২.৭ শতাংশ। সমস্ত বৃহৎ শক্তি, উদীয়মান ও উন্নত অর্থনীতির দেশ সামনে এগোবে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটবে ২ শতাংশ কি অনুরূপ। ব্রাজিল ও রাশিয়া সর্বশেষ মন্দা থেকে বেরিয়ে আসবে। এশিয়ার এককালীন ব্যস্ত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় প্রবৃদ্ধি ঘটবে ৫ শতাংশ হারে। ভারতের হবে প্রায় ৮ শতাংশ আর চীনের ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তাহলে আর উদ্বেগের কোন কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু ইতিহাস বলে যে বিশ্ব অর্থনীতি প্রতি ৮ থেকে ১০ বছর পর পর মন্দায় চলে যায়। সর্বশেষ মন্দার আঘাত শেষ হয়েছে ২০০৯ সালে। সে হিসেবে ২০১৮ সালের দিক থেকে আরেক মন্দা শুরু হওয়ার কথা। ভূমিকম্পের বছর ২০১৮ এক নতুন গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বানী করেছেন যে এ বছর পৃথিবীতে একের পর এক ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে কারণটা খুব অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তাহলে পৃথিবীর আবর্তন বা ঘূর্ণন সামান্য হ্রাস পেয়েছে। ভূমিকম্পের নির্ভুল পুর্বাভাস দেয়া অসম্ভব হলেও অতীতের ভূকম্পন রেকর্ডগুলোর বিশেষ কতগুলো প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন। ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হবে বিষ্ণুব অঞ্চল। পৃথিবীর আবর্তন গতি শেষবারের মতো কমেছে ২০১১ সালে। ঐ সময় থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রভাগের এনার্জি যেসব এলাকা দিয়ে বেরিয়ে আসবে তার জন্য সময় লাগবে ৬ থেকে ৭ বছর এবং তখনই ভূমিকম্পের ব্যাপকতা বাড়ার কথা। বেক্সিট টেরেসা মে’র পতন ঘটাবে? বেক্সিট নিয়ে এ বছর ব্রিটেন খুবই ব্যস্ততা ও চাপের মধ্যে থাকবে। কারণ ২০১৯ সালের মধ্যেই ইইউ থেকে ব্রিটেনকে বেেিয় আসতে হবে। তবে ব্রেক্সিট নিয়ে বিভাজন এবং পার্লামেন্টে যৌন হয়রানি কেলেঙ্কারী নিয়ে হৈ চৈ ঘনীভূত হয়ে এমন এক প্রবল শক্তিতে পরিণত হবে যা টেরেসা মে সরকারের পতন ঘঠাতে পারে। সেক্ষেত্রে শ্রমিক দলে নেতা জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং ইইউর সঙ্গে ব্রেক্সিট আলোচনা শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন বছর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ২০১৮ সালটা কঠিন, সঙ্কটময় ও দুর্লভ বছর হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ত ক্ষমতায় থাকবেন। তবে তার আমেরিকা ফার্স্ট’ কর্মসূচী ব্যর্থ হবে। রিপাবলিকান দল ও কংগ্রেসে তীব্র মতভেদের কারণে তার বেশিরভাগ এজেন্ডা স্থবিরতায় অটকে থাকবে। তার প্রশাসন একের পর এক ভুল ও কেলেঙ্কারী করে চরবে। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া এই সরকার কাজের কাজ কিছু করতে পারবে না। দলের অভ্যন্তরে কোন্দল ও আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে ঝগড়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বছরের প্রথম কয়েকটা মাস রিপাবলিকানদের কর সংস্কার প্রস্তাব পাশ করতেই কেটে যাবে এবং সম্ভবত এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে ট্রাম্প সাফল্য পাবেন। অন্যান্য উদ্যোগ আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখে উত্তরোত্তর মার খাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে খুব সম্ভব পরিবর্তন ঘটবে। এ বছরের নবেম্বরে মধ্যমেয়াদী নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের জয়ী হবার সম্ভাবনা কম। তারপরও চূড়ান্ত কিছু বলা যায় না। ট্রাম্পের উল্টোপাল্টা কার্যকলাপে তার জনপ্রিয়তায় ধস নামলে প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হতেও পারে। আর সেক্ষেত্রে ট্রাম্পের অভিশংসন হবে। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের যোগসূত্রের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত এ বছরও চলবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ২.২ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির হার হবে ২ শতাংশ। জাতি ও বর্ণগত ইস্যু নিয়ে মার্কিন সমাজে বিভাজন অব্যাহত থাকবে। সবকিছু মিলে ২০১৮ সালে আমেরিকা তেমন ভাল অবস্থায় থাকবে না। চীন আমেরিকাকে ছুঁয়ে ফেলবে চীন ও ইতোমধ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও জনসংখ্যার দেশে পরিণত হয়েছে। আইএমএফের হিসাবে চীনের জিডিপি ২০১৪ সালেই আমেরিকার জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৮ সালে তা আমেরিকার চেয়ে আরও এক চতুর্থাংশ বড় হবে। কিন্তু চীন যেহেতু পিপিপির ভিত্তিতে পণ্য ও সার্ভিস লেনদেন করে বাজারের বিনিময়ের হারের ভিত্তিতে নয় তাই আনুষ্ঠানিকভাবে চীনকে বৃহত্তম অর্থনীতি বলার উপায় নেই। তবে ২০১৮ সালে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন অর্থনীতিকে ছুয়ে ফেলবে। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের প্রবল প্রতিপত্তি দেখা দেবে। তার নেতৃত্বে চীনা সমাজ ও অর্থনীতিতে নতুন দফা পরিবর্তন আসবে। তবে সেটা কি ধরনের এখনও স্পষ্ট নয়। অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ব আগের মতোই অটুট থাকবে। চলতি বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৮ শতাংশে নেমে আসবে। প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া মানেই যে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়া তা সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়। বরং অন্যান্য সূচকের ভিত্তিতে বলা যায় যে চীনের অর্থনীতি বহুলাংশে টেকসই অবস্থায় আছে। দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার এ বছর থাকবে ১.৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে চীনের নয়া সিল্করোড ডিজিটাল মাত্রা লাভ করবে। অর্থাৎ সিল্করোড বরাবর ৬০টিরও বেশি দেশ স্বদেশজাত স্যাটেলাইট নেভিগেশন ব্যবস্থার আওতায় আসবে। এই ব্যবস্থাটি এখনও নির্ভুলতায় জিপিএসের পিছনে পড়ে থাকলেও অতি দ্রুত একে ধরে ফেলবে। পাদপ্রদীপের আলোয় রাশিয়া ২০১৮ সালে রাশিয়া পাদপ্রদীপের আলোয় আসবে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হিসেবে। মার্চে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চতুর্থ মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবেন ভøাদিমির পুতিন যদিও ভোটারের উপস্থিতি হবে কম। রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর সরকারের বজ্র নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিরোধীদলের কণ্ঠ স্তব্ধই থাকবে। পাশ্চাত্যের অবরোধ, তেলের মূল্যহ্রাস প্রভৃতির কারণে রাশিয়া নিজের অর্থনীতিকে অন্যান্য উপায়ে শক্তিশালী করার দিকে নজর দেবে। এ বছর নতুন সরকারের দায়িত্ব হবে অর্থনীতির সংস্কার সাধন। ২০১৪-১৬ সালের মন্দা কাটিয়ে উঠলেও অর্থনীতির ইন্ধন হিসাবে এতদিন তেলভিত্তিক যে পুরাতন মডেলটি কাজ করছিল সেটির শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসায় ব্যাপক সংস্কার ছাড়া রাশিয়াকে বছরের পর বছর মন্থর প্রবৃদ্ধির পথে চলতে হবে। এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে দেড় শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে ৪ শতাংশ হারে। পুতিনকে চ্যালেঞ্জ করার আপাতত কেউ নেই। তবে জনমোহিনী নেতা আলেক্সি নাভালনির নেতৃত্বে পুতিনবিরোধী শক্তিগুলো সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যদিও সে চেষ্টা কতদূর সফল হবে বলা মুশকিল। বিশ্বকাপ ফুটবল রাশিয়াকে তার বৈশ্বিক ভাবমূর্তি নতুন করে নির্ধারণের সুযোগ এনে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্বকাপ নির্ঝঞ্ঝাটে ও সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারলে অর্থনীতিতেও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। ভারতে মোদির প্রতাপ বাড়বে নতুন বছরটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রবল প্রতাপে রাজত্ব চালাবেন। তাঁর বিজেপির নেতৃত্বাধীন মধ্য ডান শাসক কোয়ালিশন মৌলিক সংস্কারের উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাবে। এতে সাফল্যের মাত্রা রকমফের হবে। তারপরও ২০১৮ সালে ভারত হবে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৮ শতাংশ হারে। মুদ্রাস্ফীতির হার হবে ৪.৩ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রথম মেয়াদের এটাই শেষ বছর। আগামী বছরের প্রথমদিকে সাধারণ নির্বাচনেও মোদির জয় প্রায় অবধারিত বলে মনে করা যায়। এমনিতেই লোকসভা এবং ১৮টি রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আছে দলটি। তার ওপর ২০১৮ সালের শেষ দিকে বিজেপি পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদ রাজ্যসভার নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেলে মোদি ইচ্ছামতো আইনকানুন করতে পারবেন। ২০১৮ সালে দুটি বিষয় মোদির বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে যদিও তেমন সম্ভাবনা বেশ দূরের। একটা হলো, মোদির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। অন্যটি হিন্দুরাজ কায়েমে বদ্ধপরিকর দলের দক্ষিণপন্থী অংশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। মোদির অর্থনৈতিক সংস্কার কাজে দিচ্ছে এটা যদি ২০১৮ সালে প্রমাণিত হতে না পারে তাহলে তার জনসমর্থনের প্রধান ভিত্তি ব্যবসায় সম্প্রসার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করতে পারে। আর তার দলের হিন্দুয়ানীকরণ কর্মসূচী মুসলমান সম্প্রদায় ও বামপন্থীদের ওপর যেভাবে আঘাত হানছে তা এক পর্যায়ে শাসক দলের ওপর বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে। পাকিস্তানে ফের ক্ষমতায় আসবে পিএমএল ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পাকিস্তনে নির্বাচন। অনেক অঘটন ও বিপর্যয় সত্ত্বেও শাসক দল মুসলিম লীগ (পিএমএল -নেওয়াজ এই নির্বাচনেও জয়ী হয়ে আবার ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় অসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশটির অর্থনৈতিক গতিপথ যথেষ্ট সুষ্ঠু। অবকাঠামো বিনিয়োগ ভাল। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫.৫ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি ৩.৮ শতাংশ থাকবে। তবে সন্ত্রাস ও অন্যান্য কারণে ব্যবসায়ের পরিবেশ আগের মতোই কঠিন থেকে যাবে। সংস্কার এগোবে মন্থর গতিতে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর গতিশীলতা পাবে এবং অর্থনীতিতে অনুকূল প্রভাব ফেলবে। জাপান সামরিক শক্তি বাড়াবে ২০১৮ সালটি জাপানের একঘরে অবস্থার অবসান ঘটিয়ে আধুনিকায়নের পথে যাত্রা শুরুর দেড়শতম বার্ষিকী হিসেবে পালিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বে শাসক কোয়ালিশন চীন ও উত্তর কোরিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য জাপানের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির দিকে আরও বেশি করে নজর দেবে। একটি স্বাভাবিক সামরিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য জাপান তার সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করবে। তার জন্য আবে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। স্বাভাবিক জিডিপি বাড়ছে। মজুরিও বাড়তে শুরু করেছে। তবে জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ১ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ থাকবে। কোরিয়া যুদ্ধের আশঙ্কা ৫০:৫০ ২০১৮ সালে উত্তর কোরিয়া ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ লাগি লাগি ভাবটা চলবে এবং মাঝে মাঝে তীব্রতা বাড়বে। যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকবে ৫০:৫০ ভাগ। উত্তর কোরিয়া আমেরিকার মূল ভূখ-ে আঘাত হানতে সক্ষম আইসিবিএম বানিয়েছে। সে এই অস্ত্রের পরীক্ষা চালাবে প্রশান্ত মহাসাগরের এমন কোথাও যা থেকে অস্ত্রের পাল্লা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে যে সেটি সানফ্রানসিসকো বা লস এ্যাঞ্জেলেস এ পড়তে পারে কিনা। এ অবস্থায় নিজের বিপন্ন হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আমেরিকার দিক থেকে উত্তর কোরিয়ায় পরমাণু হামলা চালানো বিচিত্র নয়। তবে উত্তর কোরিয়াও নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা কইবে না। ফলে কোরিয়া উপদ্বীপে রক্তের বন্যা বয়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে দুঃস্বপ্ন থেকে যাবে ২০১৮ সালে ইসলামিক স্টেট (আইএস) কে ধ্বংসের লক্ষ্য অর্জিত হবে। ইউফ্রেটিস উপত্যকা এবং সিরিয়া ইরাক সীমান্তে আইএসয়ের শেষ ঘাঁটিগুলোতে চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় সংস্থার প্রধান আবু বকর আল বাগদাদী খুব সম্ভব নিহত হবেন। কিন্তু আইএস ধ্বংস হলেও মধ্যপ্রাচ্য দুঃস্বপ্নের অবসান মোটেও হবে না। কারণ এরপর অন্তর্নিহিত উত্তেজনাগুলো আরও স্পষ্ট রূপ ধারণ করবে। আইএসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে শরিক পক্ষগুলো পুরনো শত্রুতা ও ইস্যু নিয়ে ফের সংঘাতে লিপ্ত হবে। সিরিয়ায় বাসার সরকারের অবস্থান শক্ত হবে এবং তাতে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন থাকবে। অন্যদিকে ইরাকের আল আবাদি সরকারের নিয়ন্ত্রণ অধিকাংশ এলাকায় প্রসারিত হবে এবং আমেরিকা ও ইরান স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সেই সরকারকে সমর্থন দেবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের এ তল্লাটে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিগ্রহ ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন যেসব শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছে সেগুলোকে বাগে আনা যাবে না। আর পুরনো শক্তিগুলো যেমন কুর্দি মিলিশিয়া, হিজবুল্লাহ ও আল কায়েদার শক্তি আরও বাড়বে। ইরাকে শিয়া-কুর্দী নতুন লড়াইয়ের ঝুঁকি দেখা দেবে। তেমনি ঝুকি দেখা দেবে। সিরিয়া সরকার ও তার মিত্রদের সঙ্গে সিরিয়ার কুর্দীদের সংঘাতের। ওদিকে এক ধরনের ট্রান্সন্যাশনাল শিয়া বৈদেশিক বাহিনীতে পরিণত হওয়া হিজবুল্লাহ ২০১৮ সালে ইসরাইলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইরান-মার্কিন বৈরিতা বাড়বে সামগ্রিকভাবে ইরানীদের ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য ইরান বিরোধী নীতির কারণে ২০১৮ সালে ইরানী সরকার ও জনগণের মধ্যে মার্কিন বিরোধিতা প্রবল রূপ ধারণ করবে ইরান ও আমেরিকা এমন একটা সংঘাতের পথে আছে। তবে সেটা কতদূর যেতে পারে সেটাই প্রশ্ন। পরমাণু চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর বাড়াবে। তাতে চুক্তিটা শেষ অবধি ভেস্তেও যেতে পারে। এমনকি দুদেশকে যুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এমন যুদ্ধ যে অনিবার্য তা নয়, তবে ইরাকের ক্ষেত্রে যেভাবে করেছিল ইরানের বেলায় আমেরিকা তেমন হামলা করবে না একথা হলফ করে বলা যায় না। দেশটিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদারীকরণে সতর্ক যাত্রা অব্যাহত থাকবে। সংস্কারের সুফল তেলের দরপতন সমস্যাকে কাটিয়ে উঠবে। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫.৭ শতাংশ। তবে মুদ্রাস্ফীতির হার হবে সাড়ে ১৩ শতাংশ। সৌদিতে আরও পরিবর্তন ঐতিহ্য ভেঙ্গে গোঁড়া রক্ষণশীল সৌদি আরবে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে সেই ধারা ২০১৮ সালেও অব্যাহত থাকবে। পরিবর্তনের নায়ক যুবরাজ, মোহাম্মদ বিন সালমানের নেয়া পদক্ষেপগুলো সামাজিক, রাজনেকি ও অর্থনৈতিক জীবনে প্রবল নাড়া দিয়েছে। আরও অনেক পরিবর্তনের যে উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী তার আছে তাতে অর্থায়নের জন্য এ বছর রাষ্ট্র মালিকানাধীন তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার কথা। এ বছরের জুন মাস থেকে সৌদি মেয়েরা গাড়ি চালাতে পারবে। সত্তরের দশক থেকে সিনেমা দেখার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তাও তুলে নেয়া হবে। আরও অনেক পরিবর্তন আসবে। এসব পরিবর্তনে ধর্মীয় নেতাদের একটি মহল যেমন ক্ষুব্ধ, রাজ পরিবারের অনেকে আবার যুবরাজের উত্থানে বিরক্ত। এ অবস্থায় কেউ কেউ মনে করেন যে, আরেক প্রাসাদ অভ্যুত্থানে বাদশাহ ও যুবরাজ ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। ইইউর সমস্যা ও সম্ভাবনা ২০১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হবে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক মনোভাব নিয়ে। কেননা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইউরোপ আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। অভিবাসন ও অন্যান্য সঙ্কটের স্মৃতি দূরে সরে যাবে। কিন্তু তারপরও ইউরোপের গভীরতর কিছু সমস্যা ও সঙ্কট থেকে যাবে। তার মধ্যে এই মুহূর্তে প্রধান সঙ্কট হচ্ছে কাতালান সমস্যা। ব্রেক্সিটের কারণে ইইউর বাজেটে এক হাজার থেকে ১২০০ কোটি ডলারের বাজেট ঘাটতি হবে। মহকাশ অভিযানের বছর ২০১৮ সাল হবে মহাকাশ অভিযানের বছর। নাসার মানবহীন নভোযান ইনসাইটের ২০১৮ সালের ২৬ নবেম্বর মঙ্গলগ্রহে নামার কথা। এই অবতরণের মধ্য দিয়ে এক চাঞ্চল্যকর মহাকাশ যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে। তার ঢের আগে বছরের প্রথমদিকে চাঁদে রোবোটিক ল্যান্ডার নামানোর জন্য গুগল আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হবে। রোবোটিক ল্যান্ডারটি চাঁদের বুকে ৫শ’ মিটার পথ বিচরণ করে পৃথিবীতে ভিডিও চিত্র পাঠাবে এবং গোটা ব্যাপারটা পৃথিবী থেকে রিমোট কন্ট্রোল যোগে পরিচালিত হবে। ২০১৮ সাল শেষ হবার আগেই ক্যালিফোর্নিয়ার বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস এক্স’ দুজন নভোচারীকে চন্দ্র প্রদক্ষিণ করিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। স্পেসএক্স এ বছরের মে মাস থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএসতে নভোচারী আনা নেয়া শুরু করবে। এ বছরের প্রথমদিকে চীনের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র তিয়ানগং-১ পৃথিবীর দিকে নেমে এসে এর বায়ুম-লে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। বছরের শেষ দিকে চীন একটি ল্যান্ডার ও রোভারও পাঠাবে চাঁদের অন্ধকার দিকটিতে। আর সেটাই হবে সেখানে পাঠানো প্রথম কোন নভোযান। এ বছরের গ্রীষ্মে জাপানের কৃত্রিম উপগ্রহ হায়াবুসা-২ গ্রহাণু রাইয়াগুতে এবং নাসার ওসিরিস রেস্ক গ্রহাণু বেন্যুতে নেমে সেখানকার নমুনা সংগ্রহ করে আনবে। কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মাইলফলক বস্তুকণা একই সময়ে দুই স্থানে থাকতে এবং বিশাল দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে-কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই তত্বটি ভুতুরে মনে হলেও এর বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে। ২০১৮ সালে বিশ্ববাসী এ সম্পর্কে আরও অনেক নতুন কথা শুনতে ও তার প্রয়োগ দেখতে পারবে কম্পিউটারে। ফলে তখন কম্পিউটারের কম্পিউটিং শক্তি অনেক গুণ বেড়ে যাবে। ২০১৮ সাল হতে পারে গ্লোবাল কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের শুরু। আইনস্টাইন তত্ত্বের কঠিনতম পরীক্ষা ২০১৫ সালে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্ণীত হওয়ার মধ্য দিয়ে আইনস্টানের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সত্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আর ২০১৮ সালে তত্ত্বটি এযাবতকালের কঠিনতম পরীক্ষার সম্মুক্ষীণ হবে। কারণ আমদের নীহারিকার ব্ল্যাকহোল স্যাগিটারিয়াস-এর নিকটতম একটি নক্ষত্র এস-২ তার উপবৃত্তকার সার্কিটের নিকটতম অবস্থানে থাকবে বিধায় ব্ল্যাকহোলের ভরের সঙ্গে তার আপেক্ষিকতার তারতম্য যাচাই করা যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধির আরও প্রসার ২০১৮ সালে কৃত্রিম বুদ্ধির আরও প্রসার ঘটতে দেখা যাবে। মেশিন লার্নিং কোম্পানির সংখ্যা ব্যাপক পরিসরে বাড়বে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিকে নানা কাজে ব্যবহার করবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত সেক্স রোবোটও এ বছর বাজারে পাওয়া যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধির প্রসার আরেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যারও জন্ম দেবে। তাহলো বেকারত্ব। জিন চিকিৎসার সফল প্রয়োগ শুরু ২০১৮ সাল জিন ও কোষভিত্তিক চিকিৎসা তথা এ্যাডভাসন্ড মেডিসিনের সফল প্রয়োগ শুরুর বছর বলে গণ্য হবে যদিও এর পরিপূর্ণ সুফল পেতে আরও বহু বছর সময় লাগবে। এই চিকিৎসা মূলত ডিএন’র ওপর কাজ করে এমন এক ওষুধের নাম পার্টিসিরান যা এমাইলোইডোসিস পলিনিউ থেরাপি নামে একটি স্নায়ুবৈকল্য সারাতে সক্ষম। এর মধ্যে দিয়ে আরএনআই নামে সম্পূর্ণ এক নতুন শ্রেণীর মেডিসিনের আগমন ঘটল। এ বছর লাক্সটুরনা, কার্ট-টি নামের নতুন জিন থেরাপিও বের হতে যাচ্ছে যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে যুগান্তর আনবে। ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিন আগেই উদ্ভাবিত হলেও চলতি বছর হবে সেই ভ্যাকসিনের ব্যাপক পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বছর। তাছাড়া ক্যান্সার, আলঝেইমার রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি হবে।
×