ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠের জাদুকর

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১ জানুয়ারি ২০১৮

হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠের জাদুকর

২০১৭ সাল আমাদের যেমনি কিছু দিয়েছে তেমনি কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে এই বছরটি তার নামের সঙ্গে নিয়ে গেছে অনেক কালজয়ী মানুষের নাম। এর মধ্যে যদি প্রাণের অমিয় সুধা সঙ্গীতের মানুষের কথা উল্লেখ করি তবে, তা হবে রীতিমতো ঘোরতর বিষাদ পর্ব! এ বছর আমরা এমনি কিছু সুদ্ধ সঙ্গীত অনুরাগীকে হারিয়েছি, যাদের অভাব আমরা কখনই পূরণ করতে পারব না। সুধীন দাশ (৩০ এপ্রিল ১৯৩০-২৭ জুন ২০১৭) সুরের ভুবনে এই মানুষটির অবদান অসামান্য। তিনি ছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গীতজ্ঞ এবং সঙ্গীত গবেষক। বিশেষ করে নজরুল সঙ্গীতে তার অবদান অনন্য। নজরুল সঙ্গীতের আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের বাণী ও সুর অনুসারে স্বরলিপি গ্রন্থ লেখা ছিল তার অনন্যকৃতি। সুধীন দাশ এ পর্যন্ত নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে ১৬টি ও নজরুল একাডেমি থেকে ৫টিসহ ২১টি খ-ে নজরুলের গানের স্বরলিপি গ্রন্থ বের করেছে। লালনগীতির ক্ষেত্রেও তার অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তিনিই প্রথম লালনগীতির স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সুধীন দাশের জন্ম কুমিল্লার তাল পুকুর এলাকায়। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি বিক্রমপুরে। আবদুল জব্বার (৭ নবেম্বর ১৯৩৮-৩০ আগস্ট ২০১৭) ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা যোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অসংখ্য গানে কণ্ঠ দেন। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়া যুদ্ধের সময় তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলদেশের স্বাধীতাযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। পেয়েছেন ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’সহ অনেক পুরস্কার। কাজী আরিফ (৪ সেপ্টেম্বও ১৯৫২-২৯ এপ্রিল ২০১৭) মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী আরিফ পেশায় ছিলেন স্থাপতি। কিন্তু তাঁর ধ্যান-জ্ঞান যা বলি সবই ছিল কবিতায়। যে কারণে স্থাপতির পরিচয় ছাপিয়ে একসময় তিনি হয়ে উঠলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আবৃত্তিশিল্পী। কাজী আরিফের জন্ম ১৯৫২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, রাজবাড়ী সদর উপজেলার কাজীকান্দা গ্রামে। লাকী আখন্দ (৭ জুন ১৯৫৬-২১ এপ্রিল ২০১৭) ‘এই নীলমণি হার, এই স্বার্ণালি দিনে’ ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না’ ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ এমন সব চমৎকার গানের কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ। ১৯৫৬ সালের ৭ জুন ঢাকার পাতলা খান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৫ বছর বয়সেই বাবার থেকে সঙ্গীত বিষয়ে হাতেখড়ি নেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৮৭ সালে ছোট ভাই শিল্পী হ্যাপী আখান্দের অকাল মৃত্যুর পর সুরের ভুবন থেকে অনেকটা নিভৃতে চলে যান লাকী আখন্দ। প্রিয় ভাইকে হারিয়ে দীর্ঘ প্রায় এগারো বছর পর ১৯৯৮ সালে ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ এ্যালবামের মাধ্যমে আবারও গানের ভুবনে ফিরে আসেন লাকী আখন্দ। তাঁর সুরারোপ করা প্রতিটি গানের কথার সুরের যে প্রভাব, তা যে কাউকেই সহজে মুগ্ধ করত। সুর ও সঙ্গীতায়োজনের নান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। সফট্-মেলোডি, মেলো-রক, হার্ড-রক মোটামুুটি যাই চেষ্টা করেছেন তাতেই নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। সব ছপিয়ে গত ২১ এপ্রিল ২০১৭ ইহলোক ছেড়ে চলেযান সঙ্গীতের এই নিভৃতচারী মানুষটি। বারী সিদ্দিকী (১৫ নবেম্বর ১৯৪৫-১৪ নবেম্বর ২০১৭) শুদ্ধ সঙ্গীত অনুরাগী। গ্রামীণ লোকসঙ্গীত ও আধ্যাত্মিক ধারার গান যার কণ্ঠ হয়ে পৌঁচ্ছেছে আমাদের কর্ণকুহরে, শেষে হৃদমাঝার পর্যন্ত! একাধারে বংশী বাদক তিনি। তাঁর বাঁশির মোহনীয় সুরের ইন্দ্রজালে দিনের পর দিন আমরা মোহিত হয়েছি। ১৯৯৯ সালে নন্দিত কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় সিনেমা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ যখন বাংলার অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে ভাললাগা এবং ভালবাসার অনুভূতি জাগায় তখন বারী সিদ্দিকীর নাম সকলের কাছে স্পষ্ট হয়! তাঁর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৫ নবেম্বর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বুক বেয়ে আসা সোমশ্বরী নদীর অববাহিকায়। মাত্র বার বছর বয়সে সঙ্গীত সাধনায় নেমে পরেন এই সঙ্গীত অনুরাগী। ওস্তাদ গোপাল দত্ত, পান্নালাল ঘোষ দবির খানসহ বেশসংখ্যক সঙ্গীতজ্ঞের সরাসরি সান্নিধ্য পান এই গুণী মানুষটি। সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশির প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ প্রেম। সমানে দুটেতেই সাধনা চালিয়েছেন। গানের প্রতি গভীর প্রেমে হয়েছেন দীর্ঘদিনের পরবাসী। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পুনে গিয়ে থেকেছেন বেশ সময়। প-িত ভিজি কার্নাডের কাছে নিয়েছেন শাস্ত্রীয় তালিম। গত ২৪ নবেম্বের ২০১৭ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন গুণী এই মানুষটি। রাহিজা খানম ঝুনু (২১ জুন ১৯৪৩-২৬ নবেম্বর ২০১৭) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত নৃত্য শিল্পী ও নৃত্য শিক্ষক। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নৃত্য শিক্ষক এবং বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। নৃত্যকলায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একুশে পদকের মতো সর্বচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ১৯৪৩ সালের ২১ জুন বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার এক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন মুসলিম সামাজের সংস্কার ও রাষ্ট্রের বাধাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন নিজের পথে। ১৯৫৬ সালে রাহিজা খানম ঝুনু নৃত্যে তালিম নিতে বুলবুল ললিতাকলা একাডেমি-বাফায় ভর্তি হন। তিনি ছিলেন প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৬০ সালে বাফা থেকে পাস করে। পরবর্তীতে সেখানেই নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। গত ২৬ নবেম্বর ২০১৭ রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবী ছাড়েন এই শ্রদ্ধেয় মানুষটি। নায়করাজ রাজ্জাক (২৩ জানুয়ারি ১৯৪২-২১ আগস্ট ২০১৭) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা নায়করাজ রাজ্জাক। তাঁর জীবনের দীর্ঘ ৫৩ বছর চলচ্চিত্রের সঙ্গে কাটিয়েছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে তার মতো অভিনেতা ও জনপ্রিয় মানুষ দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি ছিলেন রুপালি পর্দার রাজা। তাঁকে ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পী এক রকম ভাবাই যায় না। অভিনীত প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্র এবং নিজের পরিচালিত ১৬টি সিনেমার মধ্য দিয়ে নায়করাজ্জাক দীর্ঘ ৭৫ বছরের জীবনকে ইতি জানান গত ২১ আগস্ট ২০১৭ সাল। মিহির নন্দী (১৪ ডিসেম্বও ১৯৪৫- ৬ মে ২০১৭) তিনি সুরের সাধক খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কণ্ঠযোদ্ধা। ১৯৭১ এর ভয়াবহ দিনগুলোতে কণ্ঠে তুলেছেন উদ্দীপনামূলক সুর। ঘুরেছেন ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ ও মুক্তি সংগ্রামীদের করেছেন উজ্জীবিত। দেশ মৃত্তিকার ঋণ শোধে করেছেন মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের খ-কালীন শিক্ষক ছিলেন। গত ৬ মে ২০১৭ সালে এই সঙ্গীতজ্ঞ ইহলোক ত্যাগ করেন। এদের ছাড়াও ২০১৭ সালে আমরা শিল্পের আরও কিছু গুণী মানুষদের হারিয়েছি। এদের মধ্যে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ কালাচাঁন দরবেশ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুব্রত সেনগুপ্ত, সবিতা চৌধুরী, মঞ্জর আহমেদের প্রয়াণ, আমাদের শিল্পীঙ্গনে অপূরণীয় শূন্যত সৃষ্টি করেছে।
×