ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মনোয়ার হোসেন

ইতিবাচক রূপে সংস্কৃতি অঙ্গন

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ১ জানুয়ারি ২০১৮

ইতিবাচক রূপে সংস্কৃতি অঙ্গন

মৌলবাদের প্রচ্ছন্ন হুঙ্কারকে উপেক্ষা করে বছরের শুরু থেকেই শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চায় ছিল বেগবান গতিধারা। সহজাতভাবেই সংস্কৃতির শুভ চেতনার কাছে পরাজিত হয়েছে অশুভ শক্তির অভিপ্রায়। কণ্ঠশিল্পীর গানের সুরে, বাঁশরিয়ার সুরেলা শব্দধ্বনিতে, বাচিকশিল্পীর কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে, লোকগানের সহজিয়া সুরে মজেছে নাগরিক মন। অপতৎপরতাকে পাশ কাটিয়ে শহরে বয়েছে প্রশান্তির সুবাতাস। বছরজুড়ে আর্ট গ্যালারিগুলোয় শোভা পেয়েছে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি কিংবা ভাস্করের গড়া ভাস্কর্যসহ বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার তিন মঞ্চ ও বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মঞ্চে অসংখ্য নাট্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে নাটককেন্দ্রিক বেশ কিছু উৎসব। বিদায়ী বছরে সংস্কৃতি ভুবনে নগরবাসীর অন্তর ও মননে দাগ কেটেছে তেমন কিছু বিশেষ আয়োজন নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন। এছাড়া ঢাকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চার বাইরে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুণ্যভূমিখ্যাত সিলেট শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব। মানবিকতার সাধনার আহ্বানে অনুষ্ঠিত উৎসবটির কথাও উঠে এসেছে এ লেখায়। লোকগানের সুরে বর্ণিল ঢাকা : নবেম্বরের ৯ থেকে ১১ তারিখ বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব। এ গানের আসরটি ছিল যেন দেশ-বিদেশের লোকসঙ্গীত শিল্পীদের মন মাতানোর গল্প। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১টা অবধি লোকজ সুরের ধারায় ¯œাত হয়েছেন শহরের শ্রোতাকুল। অনবদ্য সব পরিবেশনায় সিক্ত হয়েছে হাজার থেকে লক্ষ গানপ্রেমীর অন্তর। লোকজ বাংলার বাউল গান থেকে শোনা গেছে সাম্বা নাচের ছন্দময় ব্রাজিলিয়ান লোকগানের সুর। ভারতের অসমিয়া সুরের সঙ্গে মন রাঙিয়েছে তিব্বতের পাহাড় ও ঝরনার শব্দধ্বনিময় লোকসঙ্গীতের সুর। শেকড়সন্ধানী সুরসুধায় ঝলমল করেছে নগর। আপন সংস্কৃতির শেকড়ের গান শোনানো এ আয়োজনে শামিল হয়েছে দশ দেশের ১৪০ জন লোকগানের শিল্পী। ১৬টি পরিবেশনায় সাজানো ছিল তিনদিনের উৎসব। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ বৈচিত্র্যময় পরবেশনায় অংশ নিয়েছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, মালি, ইরান ও ব্রাজিলের শিল্পী। এই আট দেশের শিল্পীদের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতে সুর তুলেছে জাপান ও ফ্রান্সের যন্ত্রীরা। এসব শিল্পীদের মাঝে শ্রোতাদের আনন্দে-উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে ভারতের পাঞ্জাবের দুই বোনের লোকগানের দল নুরান সিস্টার্স, তিব্বতের শিল্পী তেনজিন চোয়েগাল, যন্ত্রসঙ্গীতনির্ভর নেপালের লোকগানের দল কুটুম্বা, ইরানের গানের দল রাস্তাক ও আফ্রিকার দেশ মালির গ্র্যামিজয়ী গানের দল তিনারিওয়েন। দেশের শিল্পীদের মধ্যে শ্রোতাদের হৃদয়ে কড়া নেমেছেন আরিফ দেওয়ান, শাহজাহান মুন্সী ও ফকির শাহাবুদ্দিন। মেরিল নিবেদিত উৎসবটির আয়োজন করে সান কমিউনিকেশন্স। ঢাকা লিট ফেস্ট : ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে শান্তির বারতা ছড়িয়ে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনদিনের ঢাকা লিট ফেস্ট। মুক্তচিন্তার প্রকাশে খুন হওয়া লেখক বা ব্লগারদের প্রতিবাদী চরিত্রকেই যেন ধারণ করেছে এ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। যাত্রিক আয়োজিত এ সম্মেলনের এক অধিবেশনে আরব বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী প্রভাবশালী সিরীয় কবি এ্যাডোনিস বলেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে নয়, সমাজ গড়ে উঠবে মানবিকতার আশ্রয়ে। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, চিন্তক ও গবেষকের প্রাণবন্ত কথনে আলোড়িত হয়েছে সাহিত্যের উদ্্যাপনের উৎসব ঢাকা লিট ফেস্ট। সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের মেলবন্ধন ঘটে সম্মেলনে সবুজ আঙিনায় আবৃত বাংলা একাডেমির নানা প্রান্তে হয়ে উঠেছিল সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। বিষয়ভিত্তিক অধিবেশনের আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছে বলপূর্বক মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি। ১৬ থেকে ১৮ নবেম্বর পর্যন্ত চলমান উৎসবে সম্পৃক্ত হয়েছেন বিশ্বের ২৪ দেশের দুই শতাধিক শিল্পী-সাহিত্যিক। অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯০টির বেশি অধিবেশন। দেশের সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে এবং বিশ্বসাহিত্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্তির প্রত্যাশায় শেষ হয় এ উৎসব। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ সাহিত্য উৎসব ছড়িয়েছে ভাষার সীমানা পেরুনো আন্তর্জাতিক আবহ। আলোচনা কিংবা পরিশেনাসহ নানাভাবে এ উৎসবে শ্রোতা-দর্শককে আলোড়িত করেছেন ম্যান বুকারজয়ী নাইজেরিয়ার কবি বেন ওক্রি, অস্কারজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইন্টন, ভারতের লেক জেরি পিন্টো, যুক্তরাজ্যের ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল প্রমুখ। বাংলাদেশ কবি-সাহিত্যকদের মধ্যে আলো ছড়িয়েছেন হেলাল হাফিজ, হেলাল হাফিজ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক প্রমুখ। সিলেটে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব : রাজধানীকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চর্চা ও আয়োজনের সেই বৃত্ত ভেঙে মানবিক সাধনার আহ্বানে সিলেটে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব। নিসর্গের মায়াবিস্তারী শহরটির আবুল মাল আবুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় দশদিনের এ উৎসব। কমপ্লেক্সের পাঁচটি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে নাচ-গান, কবিতার পরিবেশনা এবং নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। বিশাল আয়োজনটির অন্তর্ভুক্ত ছিল কারুশিল্প মেলা ও স্থাপত্য প্রদর্শনী। আর দশদিন ধরে উৎসবের রাধারমণ দত্ত বেদিতে দিনভর ছবি এঁকেছেন দেশের নবীন-প্রবীণ ও প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীরা। একটি উৎসবের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনদিনের সাহিত্য সম্মেলন। বাংলাদেশ ও ভারতের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়েছে এ সম্মেলন। আর এমন বৈভবময় শিল্প-সাহিত্যের আলিঙ্গনে সিলেটের বাইরে পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার দর্শক-শ্রোতারা জড়ো হয়েছিলেন এ উৎসবে। দশদিনের বহুমাত্রিক এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, খায়রুল আনাম শাকিল, শামা রহমান, কুদ্দুস বয়াতী, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, রোকেয়া সুলতানা, শহিদ কবির, মুহাম্মদ সামাদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হরিশংকর জালদাস, আনিসুল হকসহ দেশের ৩৮৩ জন সঙ্গীতশিল্পী-নৃত্যশিল্পী, চিত্রকর, নাট্যশিল্পী এবং কবি ও লেখক। গান শুনিয়েছেন ভারতের কণ্ঠশল্পী হৈমন্তী শুক্লা, শ্রীকান্ত আচার্য, মনোময় ভট্টাচার্য, জয়তী চক্রবর্তী ও পার্বতী বাউল। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে উৎসর্গকৃত এ উৎসবের আয়োজন করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। কঞ্জুস নাটকের ৭০০তম মঞ্চায়ন ১৫ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে ইতিহাস গড়ে কঞ্জুস নাটকের ৭০০তম মঞ্চায়ন হলো। তুমুলভাবে দর্শকনন্দিত নাটকটি নির্মিত হয়েছে ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরের কাহিনী অবলম্বনে। ১৯৮৭ সালে লোকনাট্য দলের এই প্রযোজনাটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়। কঞ্জুসের রূপান্তরকারী তারিক আনাম খান ও নিদের্শক লিয়াকত আলী লাকী। প্রযোজনাটিতে মেলে ধরা হয়েছে পুরানো ঢাকার বাসিন্দাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবন ও সংস্কৃতি। উর্দু ও বাংলা ভাষার মিশ্রণে বিশেষ ভাষায় কথা বলে এই জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনধারার আবহ তৈরি করার জন্য এ নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে পুরানো দিনের জনপ্রিয় সব হিন্দি গান। নাটকটির ৭০০তম মঞ্চায়নে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেনÑ স্বদেশ রঞ্জন দাসগুপ্ত, জিয়াউদ্দিন শিপন, রুবেল শংকর, আজিজুর রহমান সুজন, আবু বকর বকশী, মাসউদ সুমন, ইশিতা চাকি, জুলফিকার আলী বাবু, খাদিজা মোস্তারী মাহিন, প্রিয়াংকা বিশ্বাস ও শাহরিয়ার কামাল।
×