ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:২২, ১ জানুয়ারি ২০১৮

পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ

সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনা করা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল যে দেশটি, এখন অনেক কিছুতে তার চেয়ে এগিয়ে আছে সে। গত ৪৬ বছরের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ১ হাজার ৫৩৮ ডলার। সেখানে পাকিস্তানের তা ১ হাজার ৪৭০ ডলার। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৬ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলো পাল্টেছে। ক্রমে শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। স্বাধীনতার সময় জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল প্রায় ৫৯ শতাংশ। আর শিল্পের অবদান ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ২৯ শতাংশ। জিডিপির তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে। সেবা খাতের অবদান শীর্ষে। স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২০ শতাংশের বেশি। এত বছর পরও বাংলাদেশের রফতানি খাত এক পণ্যনির্ভর। পাটের বদলে তৈরি পোশাক এসেছে। তবে রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য খুব বেশি আনা সম্ভব হয়নি। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, রফতানিতে তৈরি পোশাকের অবদান বাড়লেও পোশাক কারখানার পরিবেশ পাকিস্তান, ভারতের চেয়ে ভাল নয় বাংলাদেশের। এই অবস্থা থেকে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, রাষ্ট্রের সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েও এগিয়েছে বাংলাদেশ। মূলত এসব সম্ভব হয়েছে ২০০৯ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগেই বাংলাদেশকে আরেকটি বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ১৯৭০ সালে এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। দেশটির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় অভিযোগ করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে গমের বাম্পার ফলন হলেও সামান্য পরিমাণও দেয়নি পূর্ব পাকিস্তানকে পাশাপাশি এক টুকরো কাপড়ও পাঠানো হয়নি। এ রকম দৈন্যদশা থেকে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব সূচকে অনেক অগ্রগতি হয়েছে দেশটির। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ॥ গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৬ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের অবস্থা বুরুন্ডি, সার্বিয়া কিংবা বুরকিনাফাসো এর মত রাষ্ট্র থেকেও খারাপ। শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ১৬৩টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪১তম। বাংলাদেশের ৮৩তম। বাংলাদেশ তাহলে কতধাপ এগিয়ে থাকল? শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ভারত থেকে ৫৮ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উপরে আছে কেবল ভুটান (১৩তম) এবং নেপাল (৭৮)। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৯৭ এবং পাকিস্তানের ১৫৩তম। আইইপি এর গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের নতুন একটি প্রবণতায় দেখা গেছে, শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর অবস্থা ক্রমশ ভালর দিকে গেছে, অন্যদিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোর পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে গেছে। বাংলাদেশের পাওনা ॥ পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা অর্থের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একাত্তরে যুদ্ধকালে সম্পদের সমবণ্টনের হিসাবে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৪৩২ কোটি মার্কিন ডলারের অর্ধেক ২১৬ কোটি মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে আছে একাত্তরে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ২০০ মিলিয়ন ডলার। এ অঙ্কই বর্তমান হিসাবে বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৮ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে এ পাওনার বিষয়ে বারবার পাকিস্তানের কাছে দাবি উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সাড়া মেলেনি। শুধু টাকার এ অঙ্ক নয়, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত তিন ইস্যুর বিষয়েই কোন প্রতিশ্রুতি মেলেনি। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম দাবি গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, দ্বিতীয় দাবি ক্ষতিপূরণ এবং তৃতীয় দাবি এদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের ফেরত নেয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় অখণ্ড পাকিস্তানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে সম্পদের আইনী অংশীদার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মনে করে, ১৯৭১ সালের আগে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ ওই সম্পদের ৫৬ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনায় ৫৪ শতাংশ এবং সমতার নীতি অনুসরণ করলে ৫০ শতাংশের দাবিদার বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা, ভোলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় গোর্কি নামের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। নষ্ট হয় শত কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তখন কোন সহায়তা দেয়নি পূর্ব-পাকিস্তানকে। ঘূর্ণিঝড়ের পর পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য আসে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বিদেশী মুদ্রা তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকার শাখায় রক্ষিত ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বৈদেশিক মুদ্রাগুলো স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের লাহোর শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এ অর্থ সরাসরি ফিরিয়ে দিতে পাকিস্তানের কাছে দীর্ঘদিন ধরে জোর দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে বারবারই দেশটি প্রমাণ করেছে তারা ’৭১ সালের ঘটনার জন্য মোটেই অনুতপ্ত নয়। যদিও পাকিস্তানের প্রগতিশীল ধারার অনেকেই মনে করেন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র বিষয়টিকে কোন ভাবেই অন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখে না। তাছাড়া তারা গণহত্যাকেও স্বীকার করতে চায় না। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজে বারবার বাঁধা দিয়েছে পাকিস্তান। তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসির প্রতিবাদ জানিয়েছে। লবিস্ট পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিল যুদ্ধপরাধীদের বাঁচানোর জন্য। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক লড়াইও চলে। উত্তপ্ত হয় বিশ্ব তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি। তবুও বিচার থেমে থাকেনি। নস্যাত হয়েছে সকল ষড়যন্ত্র। বিচার হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধপরাধীদের। এখন বিচারকাজ চলামান। এরমধ্যে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সহ বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণী পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বরতা ও গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত বেঁচে থাকা প্রায় সহস্র পাকিস্তানী সেনার বিচারের দাবি জানায়। এ বিষয়েও নীরব পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের নানামুখী অপতৎপরতার মধ্যে সব দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এগিয়ে যাবেই।
×