ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রহমান

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ১ জানুয়ারি ২০১৮

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত

আরও একটি বছর ক্যালেন্ডারের খাতা থেকে বিদায় নিচ্ছে। আর কতটা দিন পরে আসছে নতুন বছর। তবে ২০১৭ সাল আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেও বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো আমাদের মনে দাস কাটে। অনেক কারণে ২০১৭ স্মরণীয়। যদি হিসেব করে দেখা যায় এ বছর কোন বিষয়গুওলো সবচেয়ে আলোচিত ছিল তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তালিকায় যোগ করতে হবে। দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলে প্রায় প্রতি ঋতুতেই এবার একটি করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে বলা চলে। বলা যেতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা ছিল এবার। এর রূপগুলোও বিধ্বংসী। বছর বিদায়ের প্রাক্কালে একটু পেছন ফিরে দেখলে এসব ঘটনা স্মরণে আসে বার বার। এ কারণে যে ক্ষত মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে তা যেন সহজে মোছার নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এবার যেন সব এক সঙ্গে ধরা দিয়েছিল। ছয়টি প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে এবার মানুষ অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে ফসলের ভয়ানক ক্ষতিক পাশাপাশি মানুষ বাস্তহারা হয়েছে। ভারি এবং রেকর্ড বৃষ্টিপাত, হাওড়ে অকালে আকস্মিক বন্যা, পাহাড়ধসের মতো ঘটনা এবং ঘূর্ণিঝড় মোরার ভয়াবহ আঘাত ঘুর্ণিঝড় মোরা আঘাত এবং বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ এবার মোকাবেলা করতে হয়েছে। বলতে গেলে সারা বছর এবার বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা গেছে। দুই ধরনের রেকর্ডের তালিকায় স্থান পেয়েছে এই বৃষ্টিপাত। চার দশকে মধ্যে এবারের এপ্রিলের বৃষ্টিপাত সবচেয়ে বেশি ছিল। আবার তিন ঘণ্টার বৃষ্টিপাতের এবার রেকর্ড হয়েছে। দুই দশকের মধ্যে গত ২ আগস্টে ৩ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১২১ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতের প্রভাবে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা ছিল অতীতে যে কোন সময়ে চেয়ে বড় একটি দুর্যোগ। জুন, জুলাই, আগস্টের কয়েক দফা ভারি বৃষ্টিপাতে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট জেলা কয়েকবার পানির নিচে তলিয়ে যায়। হাওড়ের অকাল বন্যায় ১১ লাখ ৩৪ হাজার পরিবার ক্ষতির শিকার হয়। পানিতে তলিয়ে যায় ৭৫ ভাগ ফসল। পাহাড়ধসে মৃতের সংখ্যা রেকর্ড অতিক্রম করে ১৬০ জনে দাঁড়ায়। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরাও’ কম যায় না। ৮ জনের প্রাণ নিয়ে তবেই ক্ষান্ত। উপকূল করে দেয় ল-ভ-। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ঘটে গেছে দুই দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। সরকারী হিসেবে বলা হয়েছে ৩৩ জেলায় ৭০ লাখ বন্যার ক্ষতির শিকার হয়েছে। বিশেষজ্ঞেদের অভিমত ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও অবস্থানের কারণেই বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে এখানে। আবহমানকাল থেকেই প্রাকৃতিক বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। প্রতিবছর যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয় তা বিশ্বের কোথাও হয় না। তিন প্রধান নদী নিম্ন অববাহিকায় অবস্থানের ফলে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থানের কারণেই এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। বন্যা প্লাবন, জলোচ্ছ্বাস, ঝড়-ঝঞ্ঝা সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বহুকাল থেকেই মানুষ পরিচিত। কিন্তু ২০১৭ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণ মানুষের কাছে আরও একবার স্মরণ করে দিয়েছে এর হাত থেকে সহজেই মুক্তি নেই। জীবন সংগ্রামে প্রাকৃতি দুর্যোগ অবিচ্ছেদ্য অংশ আগামীতে বার বার ফিরে ফিরে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। আর এর প্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগ। সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যা কমলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছেই। বিশেষজ্ঞদের হিসেবে দেখা গেছে, আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পর পর বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলেও বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছর পরপরই হানা দিচ্ছে। ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফটের তালিকায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে বড় ধরনের ২৫৪টি দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। তারা বলছেন, বন্যা এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রতিবছরই আঘাত হানে। তবে বন্যা একদিকে যেমন আশীর্বাদ অন্যদিকে অভিশাপও। প্রতিটি বন্যার পর মাটির উর্বরতা ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ে। প্রতিবছর গড়ে দেশে ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ১৮ শতাংশ ভূখন্ড বন্যায় ডুবে যায়। ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখ- বন্যার প্রকোপে পড়ে। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে তিন প্রধান নদী দিয়ে প্রতিবছর ৮ লাখ ৪৪ হাজার কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। এটি বার্ষিক মোট প্রবাহের ৯৫ শতাংশ। বৃষ্টির কারণে দেশে অভ্যন্তরে ১ লাখ ৮৭ হাজার কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয়। দেশে প্রতি বছর তিন ধরনের বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মৌসুমি বন্যা, আকস্মিক বন্যা, জোয়ার-ভাটার বন্যা। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলে অনিয়মিত ও আকস্মিক জলোচ্ছ্বাসের শিকার হচ্ছে। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড কো-অপারেশনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় দেশের ৬০ শতাংশ জমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ ৬ মিটার উঁচু। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বৃষ্টি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আবার এর উল্টোদিক রয়েছে। কোন কোন বছরে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত হচ্ছে না বললেই চলে। উত্তরাঞ্চল যেমন বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রতি বছর আবার শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই মরুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে যায়। হাওড়ে প্রতি বছর আগে অকাল বন্যা। পাহাড়ে ধ্বংসের ঘটনা প্রতিবার ঘটছে। কিন্তু ২০১৭ সালে যেন এসবের আধিক্যএকটু বেশিই ছিল।
×