ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রহিম শেখ

প্রবৃদ্ধিতে নজির ॥ ব্যাংক নিয়ে অস্বস্তি

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১ জানুয়ারি ২০১৮

প্রবৃদ্ধিতে নজির ॥ ব্যাংক নিয়ে অস্বস্তি

দারিদ্র্য মোচন, প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, এডিপি বাস্তবায়ন, রেমিটেন্স আর রফতানি আয়ের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে অনেক স্বস্তির খবর দিয়েছে। কিন্তু চাল ও পেঁয়াজের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে খানিকটা চাপ অনুভব করেছে অর্থনীতি। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এই দুই খাদ্যপণ্যের প্রভাবে ভোক্তাদের মধ্যে ছিল ভোগান্তি। পাশাপাশি লাগামহীনভাবে বেড়েছে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম। যার ফলে আমদানি পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। বছরের মাঝা মাঝি সময়ে রোহিঙ্গাদের আকস্মিক আগমণের কারণে দেশের অর্থনীতিতে আরও একটু চাপ বাড়ে। যদিও তা সামলে উঠেছে সরকার। এদিকে গত বছরজুড়ে আলোচনায় থাকা ব্যাংকিং খাত মালিকানা বদলের সুফল পায়নি এখনও। বেড়েছে খেলাপি ঋণ। তবে চাপের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে উন্নয়নের জোয়ারে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুু প্রকল্পের কাজ। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখছে সরকার। সেই লক্ষ্যে সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে চলছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর বেশিরভাগ ইতিবাচক অবস্থায় থাকায় সন্তুষ্টি নিয়েই বছর শেষ করার কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উন্নতির সঙ্গে অপ্রাপ্তিও আছে খানিকটা। অবকাঠামো দুর্বলতা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। শিল্প-কারখানায় ছিল গ্যাস-বিদ্যুত সঙ্কট। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, যে কোন মূল্যে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সবকিছুর ওপর তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন ২০১৮ সালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকা জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত বছর ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করেছে। চূড়ান্ত হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে প্রাথমিক হিসাবে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছিল। অর্থাৎ প্রাক্কলিত প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। পরপর দুই বছর ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির অর্জনের নজিরও সাম্প্রতিক বিশ্বে বিরল। বাংলাদেশ ছাড়া কেবল কম্বোডিয়া আর ইথিওপিয়ার এই অর্জন রয়েছে। অন্যদিকে সাময়িক হিসাব থেকে ৮ ডলার বেড়ে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪৫ ডলার। বর্তমানে জিডিপির আকার ২৪৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে স্বাধীনতার পর ৩৮ বছর লেগেছিল। আর বর্তমান সরকারের আট বছরে জিডিপিতে যোগ হয়েছে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা গত ৫ বছরে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি। প্রতিবছর দেশে ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের অভাব আছে, সেটা স্বীকার করি। তবে এটা সাময়িক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ চিত্র পাল্টে যাবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের ১৪শ’ প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে বড় বড় অবকাঠামো সৃষ্টির প্রকল্প রয়েছে। আর অবকাঠামো হলো শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি। ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজও দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। কাজ শেষ হলে কেবল এসব অঞ্চলে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশের এমন উন্নয়ন দেখে গত বছর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপাল সিরিসেনা, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বাংলাদেশে এসে এসব অগ্রগতির প্রশংসা করে গেছেন। এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোন নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এছাড়া চলতি বছর এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের (এপিজি) কো-চেয়ার এবং স্টিয়ারিং গ্রুপের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। যা অর্থপাচার রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি সাফল্য-ব্যর্থতা বিশ্লেণে অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল। সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা ধরে রেখে ৭ শতাংশ অতিক্রম। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখাও আরেকটি সাফল্য। রিজার্ভ, রফতানি আয়, রেমিটেন্স, রাজস্ব আদায়সহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও ভাল। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারাকে ব্যর্থতা হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন তিনি। দুই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে : এক বছর আগে যে পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ টাকা, তা কয়েকদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। মাত্র ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫ গুণ। শুধু পেঁয়াজ নয়, চালের দামও বেড়েছে আকাশচুম্বী। গত বছর ৩৪ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হয়েছে চাল। পেঁয়াজ ও চাল যেমন ভোক্তার নাভিশ্বাস তুলেছে, তেমনি অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যও ছিল লাগামহীন উর্ধগতিতে। এর ফলে গত বছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৮৬ শতাংশ। অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এ হার ছিল ৫.৪৩ শতাংশ। পয়েন্ট টু পয়েন্ট (বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা) ভিত্তিতে এ হিসাব করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৫.৫৭ শতাংশ। আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৮৯ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬.১২ শতাংশ। এ হিসাবে তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫.৮৬ শতাংশে। মূলত চাল, মাংস, শাকসবজি, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে পরিধেয় বস্ত্রাদি, জ্বালানি, আলো, বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা ও পরিবহন খরচ মাসভিত্তিতে বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অতিবৃষ্টির জন্য খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বিঘিœত হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির হার প্রান্তিক হিসাবে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৫.৮৬ শতাংশ রয়েছে, যা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অনুযায়ীই রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬.২১ শতাংশ। শহরে এই হার ৫.৯৫ শতাংশ। লাগামহীন বেড়েছে ডলারের দাম : রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার পরও চলতি বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) নিরাপদ মান অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ থাকলেই তাকে নিরাপদ মাত্রার ধরা হয়। বাংলাদেশে বছরে গড়ে আমদানি ব্যয় হয় ৩৫০ কোটি ডলার। এ হিসাবে বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে নয় মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তারপরও বছরজুড়েই ডলার বাজার ছিল অস্থির। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের দাম কমেছে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। বছরের শেষ সময়ে এসে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১৩ ডিসেম্বর ছিল ৮২ টাকা ৬০ পয়সা, যা বছরের ১২ ডিসেম্বর ছিল ৭৮ দশমিক ৮৫ টাকা। বেসরকারী ব্যাংকের হিসাবে টাকার মান আরও বেশি হারে কমেছে। তারা এখন ৮৩ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে। এগিয়ে চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুুর কাজ : পদ্মা বহুমুখী সেতুুর প্রকল্পের ৪৯ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি স্প্যান বসানো হয়েছে। খুব শিগগিরই আরও দুটি স্প্যান বসবে। এরপর পর্যায়ক্রমে মোট ৪১টি স্প্যান বসবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু ও নদী শাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। তবে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে না এলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদারেরা। সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়নের হার বেড়েছে : চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে নবেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ২০ দশমিক ১১ শতাংশ এবং ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা প্রত্যাশার চেয়ে ভাল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ সময় সর্বমোট ব্যয় হয় ২৩ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। আইএমইডির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে ব্যয়কৃত ৩২ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকার মধ্যে জিওবি তহবিল থেকে ১৭ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়, যার বাস্তবায়ন হার ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া, প্রকল্প সহায়তা থেকে ১৩ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যেখানে বাস্তবায়ন হার শতকরা ২২ দশমিক ৫৯ ভাগ। অবশিষ্ট এক হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়, যার বাস্তবায়ন হার ২০ দশমিক ০১ শতাংশ। আইএমইডি সচিব মোঃ মফিজুল ইসলাম জানান, চলতি অর্থবছরের শুরুতেই উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিষয়ে মনিটরিংয়ের ওপর অনেক সক্রিয় ছিল। এই মনিটরিং কৌশলের আওতায় সকল উন্নয়ন স্কিমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি মনে করেন, ৫ মাসে বন্যা ও অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও এডিপি বাস্তবায়নের হার ২০ দশমিক ১১ শতাংশ ‘ভালো’। তিনি বলেন, চলতি বছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার শতভাগ অর্জিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি একদিকে যেমন সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্বস্তি দিয়েছে, অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এনবিআরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যোগ্য কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে হয়রানি রোধে ব্যবস্থা নেয়া, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিদের কর আদায়ে সম্পৃক্ত করা এবং রাজস্ব আদায়ে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। বিনিয়োগ বেড়েছে : অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল ৪৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৪৯ কোটি ডলার। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৯৫৩টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন হয়েছে। বছর এই ছয় মাসে ৮৬৫টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন হয়েছে। তবে চলতি বছর বিনিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ১৪৩ কোটি ৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা; যা বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়েছিল ৫৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এই অনুসারে দেশের মধ্যে প্রথম ছয় মাসে বিনিয়োগ প্রস্তাব কমেছে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। রফতানিতে প্রবৃদ্ধি : চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) দেশের পণ্য রফতানি আয় হয়েছে এক হাজার ৪৫৬ কোটি ২৯ লাখ মার্কিন ডলার, যা আলোচিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৪৪৫ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। যা অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের একই সময়ে এ আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, গত বছরের (জুলাই-নবেম্বর) প্রান্তিকে বরাবরের মতো তৈরি পোশাক খাত থেকে সর্বোচ্চ রফতানি আয় হয়েছে। নিট ও ওভেন মিলিয়ে এ আয়ের পরিমাণ এক হাজার ১৯৬ কোটি ডলার, যা পাঁচ মাসের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। আর বছরের এ সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয় আসে নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্ট এ দুটি মাধ্যম থেকে। এর মধ্যে নিটওয়্যার থেকে জুলাই-নবেম্বরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৮২ কোটি ২১ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৬২৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ আয় বেশি হয়েছে। আর বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেশি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বছরের একই সময়ে নিটওয়্যার থেকে রফতানি আয় হয়েছিল ৫৬৩ কোটি ২৭ লাখ ডলার। আর ওভেন গার্মেন্ট থেকে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৮০ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৭১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ তৈরি পোশাক খাতের দুটি মাধ্যমের মধ্যে নিটওয়্যার থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি আয় হলেও ওভেন গার্মেন্টের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম হয়েছে। রেমিটেন্সে ইতিবাচক ধারা : ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যায় প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। তখন বলা হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘ অস্থিরতা ও তেলের দর পড়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। এতে তারা দেশে কম পরিমাণের অর্থ পাঠাচ্ছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন যাবত টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কম থাকায় প্রবাসীরা আগের মতো অর্থ পাঠাচ্ছেন না। তাছাড়া ব্যাংকের তুলনায় খোলা বাজারে ডলারের মূল্য বেশি থাকায় হু-ির মাধ্যমে অর্থ পাঠিয়েছেন। তবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের হিসেবে দেখা যায়, রেমিটেন্স প্রবাহে উর্ধগতি। এই সময়ে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ৫৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৫২০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। সে হিসেবে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে ৫৬ কোটি ডলার বা প্রায় ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ও আগস্টে ১৪১ কোটি ৮৫ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে। তবে সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স কমে দাঁড়ায় মাত্র ৮৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। তবে অক্টোবরে রেমিটেন্স বেড়ে হয় ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর নবেম্বরে তা আরও বেড়ে হয়েছে ১২১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। সিঙ্গেল ডিজিটের পথে ব্যাংক ঋণের সুদহার : বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। সেই বাধা ক্রমেই শিথিল হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঋণের সুদহার ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’ নামিয়ে আনার দাবি এবং বিদেশী ঋণ সহজলভ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো সুদহার কমাতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবর শেষে ঋণ ও আমানত উভয় ক্ষেত্রেই সুদহার কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে আমানতের চেয়ে ঋণের সুদ তুলনামূলক কম কমেছে। এ সময়ে দেশের ৫৭টি ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ সময়ে আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যা আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। আমানতের পাশাপাশি ঋণের সুদ কমায় অক্টোবরে গড় স্প্রেড কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। তবে এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে গড় স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে অবস্থান করলেও বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড এখনও ৬ শতাংশীয় পয়েন্টর ওপরে রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে গলার কাঁটা খেলাপী ঋণ : রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে (নিয়মিত) বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ সুযোগ নেন দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। এর আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। তারপরও বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। যা বিতরণ হওয়া ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত বছরের জুন শেষে এ খাতে খেলাপী ঋণ ছিল প্রায় ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। মোট খেলাপী বা শ্রেণীকৃত ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। খেলাপী ঋণের ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের। এ ছাড়া ৪০টি বেসরকারী ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। বিদেশী ৯ ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা।
×