ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

বিট কয়েন ॥ ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার ডিজিটাল গোল্ড হয়ে ওঠা

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১ জানুয়ারি ২০১৮

বিট কয়েন ॥ ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার ডিজিটাল গোল্ড হয়ে ওঠা

একসময় অস্তিত্ব টের পাওয়া না গেলেও ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডিজিটাল কারেন্সি বিটকয়েন। নাম পরিচয় গোপন রেখে সরাসরি গ্রাহক থেকে গ্রাহকের কাছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল এ মুদ্রার লেনদেন হয়। আর এ কারণেই একে বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। বিটকয়েন নামের এই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ভবিষ্যত প্রজন্মের মুদ্রা হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন প্রযুক্তিবিদরা। তবে মুদ্রা ব্যবস্থায় লেনদেনের এ গোপনীয়তা সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন, সাইবার ক্রাইমে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৭ সাল ছিল এই বিটকয়েনের উত্থানের বছর। এ বছরের শুরুর দিকে বিট কয়েনের দাম ছিল ১ হাজার ডলারের মতো। তারপর এর দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে গত নবেম্বর থেকে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে থাকে এর দাম। বাড়তে বাড়তে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিটকয়েনের দাম ২০ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছায়। চারদিকে হুলুস্থল পড়ে যায় এই ভার্চুয়াল মুদ্রা নিয়ে। দেশে দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারকরাও নড়ে চড়ে বসেন। এক বছরে একটি ডিজিটাল মুদ্রার ১,৫৫০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধিতে সবাই হতবাক হয়ে যান। কয়েন বিশারদরা একে ‘ডিজিটাল গোল্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ফান্ড ম্যানেজাররা ছোটেন এই ডিজিটাল গোল্ডের পেছনে। কারণ শুরুর দিকে এক বিটকয়েনের মূল্য ছিল মাত্র ২৫ সেন্ট। ২৫ সেন্টের একটি ভার্চুয়াল মুদ্রার মূল্যমান মাত্র কয়েক বছরেই ২০ হাজার ডলারে পৌঁছাবে তা কেউ কোনদিন ভাবতেই পারেনি। ডিজিটাল ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে বিটকয়েনের অবস্থান শীর্ষে থাকলেও এরইমধ্যে বাজারে এসেছে ইথেরিয়াম, বিটকয়েন ক্যাশ, রিপল, ড্যাশ, লাইটকয়েন, মোনেরো, জিক্যাশ, ড্যাশ প্রভৃতি নামের অনেক ক্রিপ্টোকারেন্সি। বর্তমানে সারাবিশ্বে সর্বমোট ১ হাজার ৩৭৫টি ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। কিন্তু বিট কয়েনের মতো এত জনপ্রিয়তা আর কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি পায়নি। যদিও সব ডিজিটাল মুদ্রা নিয়েই সতর্ক বার্তা জারি হয়েছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে টাকা, ডলার, পাউন্ডের মতো ১৮০টি মুদ্রা চালু রয়েছে। তবে এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোও সতর্ক হয়ে উঠেন। তারা বিটকয়েনে বিনিয়োগের ব্যাপারে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। ডেনমার্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিটকয়েনকে এক ভয়াবহ জুয়া বলে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের প্রধান এন্ডরু বেইলিও বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা সরকার এ মুদ্রাকে অনুমোদন দেয়নি। তাই এর পেছনে বিনিয়োগ মোটেই নিরাপদ নয়।’ বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদের এই সতর্কতা অবশ্য কাজে দিয়েছে। ২২ ডিসেম্বর এসে বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে বিটকয়েনের। ২০ হাজার ডলার থেকে ১১ হাজার ডলারে নেমে আসে এই ভার্চুয়াল মুদ্রাটির মূল্যমান। তবে দু’দিন বাদেই আবার ঘুরেও দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত বছরের শেষে এসে ১৫ হাজার ডলারের কোটায় অবস্থান করে। যদিও মুদ্রাটির উৎস সম্পর্কে খুব কমই বোঝা যায় এবং ব্যবহারও খুবই সীমিত। তারপরও এই মুদ্রাটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে এত তোলপাড় অতীতে কোন মুদ্রার ক্ষেত্রে হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে এ বছর এই অদেখা মুদ্রা নিয়ে এতে মাতামাতি মুদ্রাটিকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপের দেশে দেশে এ মুদ্রা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এশিয়ায় এখনও অবৈধ এ মুদ্রার লেনদেন। এশিয়ায় বিটকয়েন অবৈধ রাশিয়া, ভারতের, চীন, বাংলাদেশ, সুইডেন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ আরও বেশকিছু দেশে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক সংস্থার কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এবং গ্রাহকের পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ থাকায় রয়েছে দরপতন এবং হ্যাকিংয়ের আশঙ্কা। তাই পশ্চিমা বিশ্বে বিটকয়েন কেনা সহজ হলেও এশিয়ায় এ ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনতে হয় গোপনে। বিটকয়েন এমন একটি মুদ্রা যা চোখেও দেখা যায় না, আবার হাতেও ধরা যায় না। তৃতীয় পক্ষ ছাড়াই লেনদেন হয় সরাসরি গ্রাহক থেকে গ্রাহকের কাছে, শুধুমাত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এ কারণেই ভার্চুয়াল এ মুদ্রার নাম হয়েছে বিটকয়েন। নতুন ইলেক্ট্র্রনিক ক্যাশ ব্যবস্থায় এ মুদ্রার লেনদেন হয় কম্পিউটার এবং স্মার্টফোনের মাধ্যমে। বিটকয়েন মুদ্রাব্যবস্থায় যুক্ত হতে হলে ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক ই-কারেন্সি লেনদেনের মাধ্যম কয়েনবেসে খুলতে হয় এ্যাকাউন্ট। এ্যাকাউন্ট খুলতে হলে সমাধান করতে হয় গাণিতিক কিছু সমস্যার। এ্যাকাউন্ট খোলার পর গ্রাহকের স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে সফটওয়্যার ইনস্টল করে নিলেই পরিচালনা করা যায় বিটকয়েন এ্যাকাউন্ট। ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ডে কয়েনবেসের মাধ্যমে লেনদেন করে বিটকয়েন কেনাবেচা করতে পারেন গ্রাহক। তাই তো ক্যাশলেস অর্থনীতির নতুন পথ প্রদর্শক এ মুদ্রাব্যবস্থাকে ভবিষ্যত প্রজন্মের মুদ্রা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রযুক্তিবিদরা। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেন, ‘দৃশ্যমান মুদ্রাব্যবস্থার চেয়ে ভার্চুয়াল মুদ্রাব্যবস্থা বেশ ভাল। এটার সঙ্গে অর্থ পাচার কিংবা সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই। ভবিষ্যতে এটি বড় বিনিয়োগের মাধ্যমও হতে পারে।’ বিল গেটস কিংবা প্রযুক্তিবিদরা এই মুদ্রার স্বপক্ষে কথা বললেও, এই ডিজিটাল মুদ্রা থেকে এক শ’ হাত দূরে থাকতে বলছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ, কিংবদন্তি ধনকুবের ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফে। তাদের কাছে বিটকয়েন নেহাতই মরিচিকা। এর থেকে মানুষকে সতর্ক করছেন বিভিন্ন দেশের আর্থিক নিয়ন্ত্রকরাও। তাদের মতে, মুনাফার লোভে এখানে সর্বস্বান্তও হতে পারেন কেউ। বিভিন্ন বেআইনী কাজে এর ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবারই। বেশ কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ। টাকা হারিয়েছেন লগ্নিকারীরা। শুধু বিটকয়েন একা নয়। এমন বহু ডিজিটাল মুদ্রার ফাঁদ পাতা রয়েছে নেটের ভুবনে। এত হুঁশিয়ারি এত সতর্কবার্তার পরও থেমে নেই বিট কয়েনের দাপট। ইন্টারনেটে ঢুঁ মারলেই এখন বিটকয়েনের বিজ্ঞাপন। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার হাতছানি। হাজার টাকা ঢাললে নাকি এক বছরেই তা কয়েক কোটি। অথচ জিনিসটা আদপে কী, তা-ই সবার কাছে স্পষ্ট নয় এখনও। এ মুদ্রার ঠিকুজি অজানা। যে কোন দিন কিন্তু তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে স্রেফ কর্পূরের মতো। মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা টেবিলে বসানো পুরনো কম্পিউটারে ইদানিং নেট খুলতেই চোখের সামনে চকচকে মুদ্রা। হালে আগাম লেনদেনে ১ বিটকয়েনের দাম ছাড়িয়েছিল ২০ হাজার ডলার এখন তা ১৫ হাজার ডলারের ধারে পাশে। রীতি মতো চোখ কপালে ওঠার মতো অঙ্ক? এক বছরে এই মুদ্রার দাম বেড়েছে ১৫শ’ ৫০ শতাংশ। চোখে-চিন্তায় ধাঁধা লেগে যাওয়ার মতোই বটে। আর হয়তো সেই কারণেই আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বিজ্ঞাপন ‘এখানে টাকা রাখুন’। অথচ এই মুদ্রার অনেক কিছুই এখনও স্পষ্ট নয়। ধোঁয়াশায় ভরা। এই কয়েন কোন দেশের নয়। কোন নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রক নেই। অনেকটা হাওয়ার ভিতে অট্টালিকার মতো। বাস্তবে বিটকয়েনের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তার উপস্থিতি এই মুহূর্তে যথেষ্ট চর্চিত বিষয়। বিটকয়েন কী : বিটকয়েন হলো অনলাইন লেনদেনে ব্যবহারের জন্য এক ধরনের মুদ্রা (ডিজিটাল কারেন্সি)। তা দিয়ে কেনাকাটা করা কিংবা টাকা মেটানো যাবে শুধু নেটেই। ১ টাকা মানে যেমন ১০০ পয়সা, তেমনই ১ বিটকয়েন মানে ১,০০০ মিলি-বিটকয়েন। আর ১ মিলি-বিটকয়েন= ১,০০,০০০ শাতোশি। এই মুদ্রার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, এতে লেনদেনকারীর পরিচয় গোপন থাকে। তার বদলে ব্যবহার হয় সঙ্কেতলিপি। অর্থাৎ, অন্য ডিজিটাল লেনদেনে যেমন বলা যায় যে, তা কার কাছ থেকে কার কাছে গেছে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। শুধু জানা যায় এক এ্যাকাউন্ট থেকে অন্যটিতে তার লেনদেন হয়েছে। তবে যদি এক্সচেঞ্জের লেনদেন (ট্রেডিং) করতে চান অথবা বিটকয়েন ভাঙিয়ে টাকা হাতে নিতে চান, তা হলে পরিচয় গোপন রাখা শক্ত। এটা ব্যবহার করা যায় মোবাইল, ট্যাবলেট ও কম্পিউটার মারফত। শুধু ইন্টারনেট থাকলেই হলো। বিশ্বেও বেশ কিছু নামী সংস্থা এবং ওয়েবসাইট বিটকয়েনের মাধ্যমে টাকা নেয়। দু’জনের হাতে এই মুদ্রা থাকলে, লেনদেন করা যায় নিজেদের মধ্যেও। কারিগর কে : এই মুদ্রার কারিগর হলেন শাতোশি নাকামোতো। ২০০৮ সালে তিনিই প্রথম তৈরি করেন এই মুদ্রার সফটওয়্যার। কিন্তু তিনি কি একজন মানুষ? নাকি একটি গোষ্ঠী? তিনি কোন দেশেরÑ এসব প্রশ্নের উত্তর গত আট বছর ধরে জানা যায়নি। অনেকের দাবি, নাকামোতোর জন্ম ১৯৭৫ সালের ৫ এপ্রিল। তিনি জাপানের মানুষ। আবার অনেকে মনে করেন, নাকামোতো কোন একজন ব্যক্তি নন। বরং মার্কিন মুলুক এবং ইউরোপের অনেকে মিলে তৈরি করেছেন বিটকয়েন। এতেই বুঝা যায়, এর উৎস কতখানি অচেনা। বিটকয়েন কেনাবেচা কী ভাবে : চাইলে বিটকয়েন কেনা যায় এক্সচেঞ্জ অথবা কোন ব্যক্তির কাছ থেকে। বিক্রিও হয় সেভাবেই। সাধারণত কেনার চেয়ে বিক্রি করা কঠিন। কারণ, যে কোন এক্সচেঞ্জ থেকে বিটকয়েন কেনা যতটা সহজ, বিক্রি ততটা নয়। এই মুদ্রা বিক্রি করতে হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হয় কেওয়াইসি, ব্যাংক এ্যাকাউন্টের তথ্য ইত্যাদি। তাতেও হ্যাকিংয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর আলাদা করে কাউকে বিক্রিও কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে বিটকয়েন লেনদেন করতে চাইলে বা ক্রয় করতে চাইলে এর জন্য প্রথমেই খুলতে হয় বিটকয়েন ওয়ালেট। যে কেউই তা খুলতে পারেন। এই ওয়ালেটে বিটকয়েন জমা থাকে। যা রাখা যায় অনলাইনে। কম্পিউটারে এবং নেট মাধ্যমে তৈরি ‘ভল্ট’ বা লকারে। লেনদেন করতে চাইলে ওই জমা বিটকয়েনই পাঠাতে হয়। কিন্তু এক বার বিটকয়েন চুরি গেলে, কোন পুলিশের ক্ষমতা নেই খুঁজে আনার। টাকার ক্ষেত্রে পাস বই দেখে বা নেট ব্যাংকিং করে বলা যায় যে আমার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে কিংবা তা থেকে কী লেনদেন করেছি। কিন্তু বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। বরং তার বদলে থাকে কত কয়েন ছিল আর কত আছে। ধরুন ‘ক’ ‘খ’-কে ১ বিটকয়েন পাঠাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে লেনদেন শেষ হলে ‘ক’ ব্যক্তির এ্যাকাউন্টে দেখাবে ১ বিটকয়েন কমেছে। আর ‘খ’-এর তা বেড়েছে। তা দেখেই বোঝা যাবে হাতবদল হয়েছে বিটকয়েন। তবে এ্যাকাউন্ট জানা গেলেও, এ ক্ষেত্রে লেনদেনকারীর পরিচয় জানা যায় না। ঝুঁকি কোথায় : ঝুঁকিটা হলো সব দেশের মুদ্রারই নিয়ন্ত্রক রয়েছে (যেমন আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক)। বিটকয়েনের সে রকম কোন নিয়ন্ত্রক নেই। কোন দেশের সরকার বা শীর্ষ ব্যাংক দ্বারাও স্বীকৃত নয় এই মুদ্রা। এখানেই তার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। কারণ, ব্যাংক থেকে কারও টাকা মার গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে পারেন তিনি। শেয়ার বাজারে গোলমাল দেখার জন্য রয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। কিন্তু বিটকয়েন কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। এবং তা স্বীকৃত না- হওয়ায়, কারও টাকা মার গেলে কারও কাছে যাওয়ার উপায় নেই। এক বার টাকা গেল, তা ফেরতের সম্ভাবনা প্রায় নেই। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রায় বেশি রিটার্নের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে টাকা তুলছে বলেও অভিযোগ আসছে। এ ধরনের সংস্থার দাবি, এটা ইনিশিয়াল কয়েন অফারিং (আইসিও)। অর্থাৎ, বাজারে শেয়ার নথিভুক্তির সময়ে যেমন তাতে টাকা ঢালা হয়, তেমনই এই মুদ্রা বাজারে আসার সময়ই কম দামে লগ্নি করা। সেখানেও কিন্তু একই সমস্যা। কারণ, যেখানে মুদ্রাটি স্বীকৃতই নয়, সেখানে আপনার টাকা মার গেলে অভিযোগ জানানোর জন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। উল্টো বেশি টাকা ঢেলে আয়কর বিভাগের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। বিটকয়েনের দাম বাড়ছে শুধুমাত্র এর যোগান কম বলে। এর কোন আর্থিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ, কোন সংস্থার শেয়ারে টাকা রাখা হলে তার ব্যবসার ধরন, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, আর্থিক হিসাব ইত্যাদি দেখা হয়। কিন্তু বিটকয়েনের ক্ষেত্রে সে রকম কিছুই নেই। তাই চাহিদা কমে গেলেই, তার দাম পড়বে। মার খাবেন লগ্নিকারীরা। শুরু কবে : বিটকয়েনের নাম প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০০৮ সালে শাতোশি নাকামোতোর লেখা একটি প্রবন্ধে। এরপর ২০০৯ সালে চালু হয় বিটকয়েন লেনদেন। তবে শুধুমাত্র বন্ধুদের মধ্যে ব্যবহারের জন্য (পিয়ার টু পিয়ার)। ২০১০ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু বিটকয়েনের দাম ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে পিজ্জা কিনতে এর ব্যবহার দিয়ে শুরু হয় লেনদেনও। তৈরি কী ভাবে : বিভিন্ন দেশের সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট বা কয়েন ছাপায়। কিন্তু নেটে ব্যবহার করা হয় বলে বিটকয়েন ছাপানোর কোন প্রশ্ন নেই। তবে এই মুদ্রা ‘মাইনিং’ করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত ১০ মিনিট) বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কম্পিউটার থেকে হওয়া বিটকয়েনের লেনদেন নিয়ে তৈরি হয় এক-একটি ব্লক। আর এই ব্লকগুলোর হিসেব যে ‘নেট-খাতায়’ (লেজার) লেখা থাকে, তাকেই বলে ‘ব্লক-চেন’। লেনদেনের যে কোন সময়ে ব্লক-চেনই বলে দেবে কোথা থেকে বিটকয়েন কোন এ্যাকাউন্টে গেছে। তা বদলানো হলেও, ধরা পড়বে সঙ্গে সঙ্গে। এভাবে লেনদেনের হিসেব রাখার পুরো প্রক্রিয়াকে বলে ‘মাইনিং’। আর যারা এই কাজ করেন, তাদের বলে ‘মাইনার’। এই সব মাইনার ২,১০,০০০ ব্লকের সমাধান খুঁজে পেলে তাদের বিটকয়েন ‘রিওয়ার্ড’ বা উপহার হিসেবে দেয়া হয়। এভাবেই বিটকয়েন বাজারে আসে। মাত্র ২.১ কোটি : পৃথিবীতে মাত্র ২.১ কোটিই বিটকয়েন তৈরি করা সম্ভব। কারণ মাইনারদের রিওয়ার্ড দেয়া শুরু হয়েছিল ৫০ বিটকয়েন দিয়ে। প্রতি ২.১০ লাখ ব্লকে তা অর্ধেক হয়। অর্থাৎ, ৫০ এর পরে ২৫, তার পরে ১২.৫, ৬.২৫ ইত্যাদি। হিসেব অনুসারে, প্রতিবার রিওয়ার্ড অর্ধেক হতে চার বছর লাগে। এখন তা ১২.৫। এভাবে চলতে থাকলে ২১৪০ সালে গিয়ে ২.১ কোটি বিটকয়েন তৈরি করা যাবে, যখন ওই রিওয়ার্ড হবে প্রায় শূন্য। অর্থাৎ, নতুন বিটকয়েন আসবে না। তবে অঙ্ক অবশ্য বলে যে, এই নিয়ম মানলে তার থেকে বেশি বিটকয়েন তৈরি সম্ভব। কারণ, তখন দশমিকে বা শাতোশি-তে হিসেব হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটি বিটকয়েন তৈরিতে কয়েক শ’ বছর লাগতে পারে। তাই সেই কাজ মাইনারদের পক্ষে কতটা লাভজনক, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে ২.১ কোটিকেই চূড়ান্ত সংখ্যা হিসেবে ধরা হয়। বিতর্কের সূত্রপাত ॥ প্রথম দিকে বিটকয়েন নিয়ে সে ভাবে কেউ মাথা না-ঘামালেও, প্রথম তা চোখে পড়ার মতো উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে। ওই বছরেই বিটকয়েনের দাম ছাড়ায় ১,০০০ ডলার। আর তার পরেই এই মুদ্রা নিয়ে সতর্কতা জারি হয় বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৩ সালে আমেরিকায় বাজেয়াফত করা হয় বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ এমটি-গক্সের এ্যাকাউন্ট। এর মাধ্যমে বেআইনী লেনদেন হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে বিটকয়েন ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও সামনে আসে। পরের বছরের শুরুতেই খবরের শিরোনামে উঠে আসে বিটকয়েন। প্রায় ৮.৫০ লাখ বিটকয়েন চুরি যাওয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসে টোকিওতে বন্ধ হয়ে যায় মুদ্রাটির অন্যতম বড় এক্সচেঞ্জ এমটি গক্স। শেষমেশ দেউলিয়া ঘোষণা। বিটকয়েনের দাম নামে ৩০০ ডলারে। তবে গত বছরের শেষ থেকেই ফের দাম বাড়তে থাকে বিটকয়েনের। দু’বছর পরে ফের পৌঁছোয় ১,০০০ ডলারে। চলতি বছরের বেশ কয়েক বার হ্যাকিংয়ের জেরে খবরে আসে বিটকয়েন। যেমন, ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে কম্পিউটারে হানা দেয়া হয়। সেখানে কম্পিউটার বন্ধ করে, বিটকয়েনের মাধ্যমে টাকা দাবি করে হ্যাকাররা। একইভাবে একটি টিভি চ্যানেলের ওয়েবসাইট হ্যাক করে বেশ কিছু স্ক্রিপ্টের গোপন তথ্যও চুরি করা হয়। সে ক্ষেত্রেও বিটকয়েন মারফত টাকা দাবি করা হয়েছিল। অর্থাৎ, বেআইনী কাজের সঙ্গে বার বার নাম জড়িয়েছে বিটকয়েনের। বিভিন্ন দেশেই বিটকয়েন নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। কোন দেশ বা শীর্ষ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। অস্ত্র, মাদকের মতো বিভিন্ন বেআইনী লেনদেনে বিটকয়েনের ব্যবহার নিয়েও সতর্ক করেছে নিয়ন্ত্রকরা। চীনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে বিটকয়েনের উপর। দক্ষিণ কোরিয়া জানিয়ে দিয়েছে, সে দেশের কোন ব্যাংক বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেন করতে পারবে না। ওই দেশে বিটকয়েন এখন দেউলিয়া! বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিটকয়েনকে অবৈধ আখ্যায়িত করে এর লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে জাপানে। দেশটির এক সংস্থা কর্মীদের বিটকয়েন মারফত বেতনের একাংশ দেয়ার কথা জানিয়েছে। সম্প্রতি শিকাগোর আগাম পণ্য বাজারে চালু হয়েছে এর লেনদেন। এতে উৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ কারা এর নিয়ন্ত্রক, সমস্যা হলে কার কাছে দৌড়াতে হবে, বিটকয়েনে কিছুই স্পষ্ট নয়। তাই রাতারাতি এই বাজার ধসে গেলেও তেমন আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু হবেন না। বিটকয়েন ধনকুবের ॥ ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া তৈরির চিন্তা প্রথম তাদের মাথাতেই এসেছিল বলে মার্ক জুকেরবার্গের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিলেন উইনভাইয়েরা। সেই মামলায় ৬.৫ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়ে আপোসে মেটান ক্যামেরন এবং টাইলার উইনকলভস। মামলা থেকে পাওয়া অর্থের মধ্যে ১.১ কোটি ডলার ঢেলেছিলেন বিটকয়েনে। তারাই বিশ্বের প্রথম বিটকয়েন ধনকুবের। এই ডিজিটাল মুদ্রায় যাদের লগ্নির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১০০ কোটি ডলার। তবে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড খুলতে তাদের আর্জি অবশ্য খারিজ হয়েছে মার্কিন মুলুকে। বাংলাদেশে বিটকয়েন! বাংলাদেশে বিটকয়েন নিষিদ্ধ হলেও বাইরের অনেক প্রতিষ্ঠান এ ভার্চুয়াল মুদ্রায় পেমেন্ট নিয়ে থাকে। তাই অনলাইনে বিটকয়েন আয়ের সুযোগ খুঁজতে থাকেন ফ্রিল্যান্সার আবু আবদুল্লাহ। সুযোগটি পেয়েও যান। দুই মাসে তিনি বিটকয়েনে আয় করেছেন ১৫০ ডলারের মতো। এ বিটকয়েন দিয়ে এখন ডোমেইন ও হোস্টিং কেনার কথা ভাবেন এ ফ্রিল্যান্সার। ভার্চুয়াল এ মুদ্রা লেনদেনে পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ থাকায় অস্ত্র ও মাদক ছাড়াও অবৈধ নানা পণ্য কিনতে ব্যবহার হচ্ছে এটি। এমনকি যারা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার নজরদারির বাইরে থেকে লেনদেনে আগ্রহী, এমন অনেকেই বেছে নিয়েছেন বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেনের সুযোগটি। বাংলাদেশেও ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ ভার্চুয়াল মুদ্রা। আর এর লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের বড় অংশই ফ্রিল্যান্সার। অবশ্য আগ্রহী বেশকিছু ব্যক্তি বিটকয়েনের বৈধতা পেতে ২০১৪ সালে উদ্যোগও নেন। এর অংশ হিসেবে ওই সময় তারা বেশকিছু ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিট কয়েন কোন দেশের ইস্যুকৃত বৈধ মুদ্রা নয়। বিটকয়েন বা বিটকয়েনের মতো কিংবা অন্য কোন কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সরকারের কোন সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন বহির্ভূত এসব লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিজ্ঞপ্তির পর দেশে বিটকয়েন চালুর উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে। সর্বশেষ, বিটকয়েনের দশ বছরও পেরোয়নি! আর যতটুকু দেখা গেছে, তাতে অনিশ্চয়তাই বেশি। অর্থ আপনার, বিনিয়োগের সিদ্ধান্তও আপনার। তাই শুধুমাত্র লোভে পড়ে কষ্টের সঞ্চয় এখানে ঢালার আগে কয়েকবার চিন্তা কুরুন। চিন্তা করুন, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার নেশায় সব খোয়ানোর ঝুঁকি নেবেন কিনা?
×