ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জেরুজালেমের ভবিষ্যত কাদের হাতে -মু. মিজানুর রহমান মিজান

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭

জেরুজালেমের ভবিষ্যত কাদের হাতে  -মু. মিজানুর রহমান মিজান

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সেখানে নিজেদের এ্যাম্বাসি সরিয়ে নেয়ার কথা বলেন যা নিয়ে গোটা বিশ্বে হৈচৈ লেগে যায়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতারা এ নিয়ে কথা বলছেন এমন সুরে যেন অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু ট্রাম্প সেটা মনে করছেন না, তিনি বলছেন এতে অশান্তির সৃষ্টি হবে না বরং দু’পক্ষ অর্থাৎ ইসরাইল ও ফিলিস্তিন চাইলে চলমান দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধান করে দেবেন। বিশ্ববাসী এখনও পুরো নিশ্চিত নয়, কেন এই সিদ্ধান্ত। যতটা অনুমান করা যায়, এতে বোঝা যায় ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী কার্যতালিকার মধ্যে এটি অন্যতম। কারণ জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবেই মনে করেন ফিলিস্তিনীরা, যা ১৯৬৭ সালে দখল করে নিয়েছিল ইসরাইল। জেরুালেম কখনই ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি পায়নি, দেশটিতে যতগুলো দেশের দূতাবাস রয়েছে সবই তেল আবিবে। ট্রাম্পের জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণার আগেই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক, এটা ভাল ফল বয়ে আনবে না; আর স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইলের নেতানিয়াহু একে স্বাগত জানিয়েছেন, ব্রাসেলস সফরে তিনি আমেরিকার মতো ইউরোপও এমনটা করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে ঘোষণা করবে না বলে জানিয়েছে, আরও বলেছে আন্তর্জাতিক ঐকমত্যকেই তারা অনুসরণ করবে। সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বলেছেন, এই ঘোষণা ‘সারা পৃথিবীর মুসলিমদের ঘোরতর ভাবে প্ররোচিত করবে’। জাতিসংঘও একে ভাল ভাবে নিচ্ছে না, এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিনিধি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আঙ্গুল তুলে বলছেন যে, জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পরিবর্তে অশান্তিই চায়। অন্য সব বিশ নেতার মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে, ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন করছেন না, উল্টো উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। আর হামাস ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, এই সিদ্ধান্তু উক্ত অঞ্চলে ‘নরকের দ্বার খুলে দেবে।’ ইতোমধ্যেই সহিংসতায় প্রাণ গেছে অনেকেরই। সিদ্ধান্তটি ইসরাইল এক ভাবে নিলেও আরব বিশ্ব অন্যভাবে নেবে বলে অনেক সাংবাদিকের ধারণা যা আমরা মিডিয়াতে বিভিন্ন রিপোর্টের মাধ্যমে খবর পাই। ঘটনা কোন্্ দিকে যাবে সেটা বলা মুশকিল; ট্রাম্পের দাবি এ রকম একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত মঙ্গলের জন্যই নিয়েছেন, অনেকেই একে মঙ্গলের পরিবর্তে উস্কানিমূলক ভাবছে। যদি কেউ বলেন ট্রাম্প দু’পক্ষের কথা না ভেবে কেবল একদিকেই চোখ রাখছে, তাহলেও হয়ত তা অস্বীকার করা যাবে না। অবশ্য ২০১৭-এর শুরুতে রাশিয়াও জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেছে তবে সেটা পশ্চিম জেরুজালেম। কায়রোতে এক জরুরী বৈঠকে আরব লীগও এখন আমেরিকার কাছে পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানও ১৭ ডিসেম্বর বলেছেন, তিনি পূর্ব জেরুজালেমে একটি তুর্কী দূতাবাস খুলতে চান; কিন্তু কিভাবে এটা বাস্তবে রূপ দেবেন যেখানে পুরো জেরুজালেম ইসরাইল দখল করে আছে এবং নিজেদের অবিভাজ্য রাজধানী মনে করছে? বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রত্যাহার চাইছেন। ঘটনাটি মুসলমানদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বলেই মনে হয়। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার কোন মাথাব্যথা নেই যা তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে; দেখা যাচ্ছে একনিষ্ঠভাবে ইসরাইলের দিকেই তাকাচ্ছে। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে মুসলিমরা একবাক্যে এক কাতারে থাকবে বিশেষ করে জেরুজালেমের কারণে এটি মুসলিমদের জন্য পবিত্র স্থান; অবশ্য ইহুদী-খ্রীস্টানদের চোখেও জেরুজালেম সমান, আর প্রধান সমস্যা এখানেই। ইস্যুটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুসলিমদের একত্রিত হয়ে একটা বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি যে কোন সময় হতে পারে। হামাস ইতোমধ্যেই অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশ্বাস দানা বেঁধেছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে হয়ত একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু হয়নি। ফাঁকে চলে গেল অসলো চুক্তির ২৩ বছর। শান্তির কথা ভেবে যদি মি. ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেন তবে ফিলিস্তিনের কথা ভেবে তিনি কি সিদ্ধান্ত নেবেন? প্রশ্নটি করাই যায়। পাশাপাশি এরও একটা প্রশ্ন থাকে অদূর ভবিষ্যতে সহিংসতার মতো কোন পরিস্থিতি হবে না তো? মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষোভে শামিল হয়েছে ৫৬টি মুসলমান প্রধান দেশের ১৫০ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের জনসংখ্যার ২২ শতাংশের বেশি। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা নিজেদের অপমানিত ভাবতেই পারেন, কারণ মক্কা আর মদিনার পর জেরুজালেম তাদের সবার জন্য পবিত্র একটি স্থান। এটি হয়ত সব মুসলিম প্রধান দেশগুলোকে একই পতাকাতলে সমবেত হতে সাহায্য করবে, যাতে করে বিশ্ব আরও একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। কোন সম্প্রদায়ই চাইবে না অন্যরা নিজেদের অপমান করুক কিংবা তাদের জন্য অমঙ্গলজনক কিছু করুক। আর জেরুজালেম প্রশ্নে মুসলমানদের মতানৈক্য হওয়ার কথাও না। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি গোষ্ঠীও এতে আরও সহিংস হয়ে উঠবে বলে মনে হয়। কেউ কেউ সরাসরি বলে দিচ্ছেন যে, এটা সত্যিকার অর্থেই জঙ্গীদের জন্য বিশেষ উস্কানি। আগে যদি জঙ্গীরা তুষের মতো জ্বলত তবে এখন জ্বলবে দাউ দাউ করে। তারা একে সুযোগ হিসেবে নিতে পারে। জঙ্গীবাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। এবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তার খেসারত ইউরোপ-আমেরিকাকেই দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্রদের জন্যও ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অস্বস্তিকর। আন্তর্জাতিক মিডিয়াসমূহ বলছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিবাদে জাতিসংঘে এই প্রস্তাব তুলতে যাচ্ছে মিসর। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সমর্থনে অন্যান্য দেশ যেন জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর না করে, সে বিষয়টিও থাকবে প্রস্তাবে; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। ভবিষ্যতে আর যাই হোক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ঘিরে মঙ্গলজনক কিছু অপেক্ষা করছে না, যা অপেক্ষা করছে তা বিশ্বের জন্য বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্যের মানুষের জন্য অমঙ্গলজনকই হবে। দেখার পালা ট্রাম্প যেখানে নিজ দেশেই বিভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবে রূপ দিতে পারছেন না সেখানে দেশের বাইরে এমন একটি সিদ্ধান্ত কিভাবে ফলপ্রসূ করবেন? মুসলিম, খ্রীস্টান ও ইহুদীদের কাছে সমান মর্যাদার নগরী জেরুজালেমের ভবিষ্যত কাদের হাতে? মুসলমানরা তো মনে করছে জেরুজালেম হাতছাড়া হওয়া মানে মক্কা-মদিনাও হাতছাড়া হওয়া।
×