ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড

(গতকালের পর) বাঙালী ক্যাপ্টেন পরিচয় পেয়ে একটি মোটরসাইকেল দিয়ে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে দেয়া হয় (মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ইতিহাস ৪র্থখ- আবুল কাশেম পৃষ্ঠা-৯৪)। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ৪র্থ বেঙ্গলের বাকি সৈন্যরা ২৯ তারিখে জানতে পারেন খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সৈন্যরা স্বাধীনতার পক্ষ নিয়েছেন। তখন ক্যান্টনমেন্টে মাত্র ৭০-৮০ জন সদস্য রয়েছে ৪র্থ বেঙ্গলের। কমান্ডার হওয়ার মতো কোন বাঙালী অফিসার বা জওয়ান তখন ছিল না। নেতৃত্বের অভাবে এরা কোন এ্যাকশনে যেতে পারেনি। ৩১ মার্চ বিকেল ৪টায় এই সৈন্যদের ওপর চারদিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালায়। প্রায় ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর ৪র্থ বেঙ্গল ইউনিট লাইন দখল করে নেয় এবং এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৪র্থ বেঙ্গলের ৮-১০ জন জওয়ান শহীদ হন। এই যুদ্ধে নায়েব সুবেদার এমএ সালাম অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ৪র্থ বেঙ্গলকে বিভক্ত না করলে হয়ত কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রথমে বাংলাদেশের পতাকা উড়ত। এবার আসা যাক, পাক সেনাদের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শেষ পরিণতির কথা। ২৪ মার্চ ১৯৭১ থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট কুমিল্লা শহরে এবং এর আশপাশে যেভাবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাঙালী সৈন্য এবং নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছিল তাদের শেষ পরিণতি ছিল খুবই ভয়াবহ এবং করুণ। মহান আল্লাহ কোন সীমা লঙ্ঘনকারীকে ভালবাসেন না এবং ক্ষমা করেন না। পাকবাহিনীর বেলায়ও তা ঘটেছিল। এক মুসলমান হয়ে অন্য এক মুসলমানকে বিনা দোষে এরূপে হত্যা করবে তা বিশ্বের ইতিহাসে খুবই কম আছে। ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা হতে শহরে কার্ফিউ ঘোষণা করা হয়। ওই দিনই কার্ফিউর মধ্যে পাকসেনারা কুমিল্লার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পালিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করে। ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে কুমিল্লা মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষের পর বিমানবন্দর শত্রুমুক্ত হয়। বিমানবন্দর এলাকায় বহু পাকসেনার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। লোকজন সেখানে জড় হয়ে উল্লাস করতে থাকে। কুমিল্লা শহরের জনগণের বিজয় উল্লাস কমাতে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের অনেক বেগ পেতে হয়। ৭ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় জেনারেল অরোরা হেলিকাপ্টার যোগে কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সর্বস্তরের মানুষ জেনারেল অরোরা এবং বাংলাদেশ বাহিনীকে পুষ্পস্তবক প্রদান করে। ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের কাছে কুমিল্লা শহরের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব দিয়ে জেনারেল অরোরা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। জনতা প্রথমে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনকে চিনতে পারেনি। পরে চিনতে পেরে তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং ফুলের মালা প্রদর্শন করে। ১০ ডিসেম্বর নবম বেঙ্গলের মুক্তিসেনারা কুমিল্লা শহরের রেলওয়ে ক্রসিং থেকে ময়নামতি ছাউনির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিত্র বাহিনীর ৩টি ট্যাঙ্ক তাদের সহায়তার জন্য মেজর আইন উদ্দিনের কমান্ডে দেয়া হয়। রেল ক্রসিংয়ের দেড় মাইল পশ্চিমে অগ্রসর হতেই টেক্সাইল মিল এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে গোলাগুলির সম্মুখীন হয়। নবম বেঙ্গলের অপর একটি কোম্পানি কোটবাড়ির পথে ময়নামতির দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এরা পাকসেনাদের অবস্থানগুলো দখলের চেষ্টা করে বুঝতে পারে তাদের অবস্থান বেশ শক্ত। পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আইন উদ্দিন ট্যাঙ্কগুলোকে নিরাপদ স্থানে রেখে পাকসেনাদের বাংকারগুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। এই সাঁড়াশী অভিযানের পরে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে তিন দিন আক্রমণ চলায় পাকসেনাদের ১৫০ জন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং অনেকে ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাকসেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটি। এরা ক্যান্টনমেন্টকে একটি দুর্গে পরিণত করে রেখেছিল। যৌথবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে অবরুদ্ধ করে রাখার কথা তখনকার কয়েকটি পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়। বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর কুমিল্লার সদর দফতর থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজি: নবম ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার মেজর আইন উদ্দিন হতে জানা যায়, গত ৮ ডিসেম্বর হতে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সাতদিনে চাঁদপুর হতে ৭ জন অফিসারসহ ১৩০০ জন, চান্দিনা হতে ১১ জন অফিসারসহ ৪০১ জন এবং কুমিল্লা হতে জেসিওসহ মোট ১৯৭৭ জন পাকবাহিনীর সৈনিককে বন্দী করা হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই আত্মসমর্পণকারী (মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা, আবুল কাশেম পৃষ্ঠা ২০১)। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের সময় কিংবা তারপরেও কুমিল্লায় অন্তত তিনটি স্পটে পাকসেনারা তৎপর কিংবা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে ছিল। কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের চিত্রটা ছিল তখন প্রকৃতির। এখানে পাকবাহিনীরা যৌথবাহিনীর সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। নানা অবস্থান থেকে হটিয়ে তাদের ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তখন ১১৭ ব্রিগেডের বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় ব্রিগেডিয়ার আতিফ পাকবাহিনীর হাল শক্তভাবে ধরে রেখেছেন। মেজর আইন উদ্দিন যতই আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছেন অবরোধের মুখে পড়ে পাকবাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করছে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের কথা জানার পর ওই দিনই ময়নামতি গ্যারিসন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আতিফ আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করে সংবাদ পাঠান। ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় ২ জন ব্রিগেডিয়ারসহ ৭৬ জন অফিসার, ১৭৫ জন জেসিও এবং ৩৯১৮ জন পাকসেনা আনুষ্ঠানিকভাবে নবম বেঙ্গল এবং মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ১৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় কুমিল্লায় ভারতীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল হীরা এবং ব্রিগেডিয়ার মিত্র হেলিকপ্টারযোগে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আসেন। ক্যান্টনমেন্ট স্টেডিয়ামে আত্মসমর্পণকারী ব্রিগেডিয়ার শেখ মনজুর হোসেন আতিফের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করে বন্দী শিবির পরিদর্শন শেষে ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করেন। আত্মসমর্পণ করা পাকবাহিনীকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে। এর আগে তাদের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরিয়ে কুমিল্লার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়। তখনকার সাপ্তাহিক ‘কুমিল্লার আমোদ’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, আত্মসমর্পণের পর প্রায় সাড়ে চার হাজার বন্দী পাকসেনাকে কোটবাড়ী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে বন্দী রাখা হয়। পাকসেনারা এ সময় দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। ১৯৪৭ সালে যে আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার, জনগণের সে আশা ও আকাক্সক্ষা মেটাতে ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ ২৪ বছর নানা সংগ্রামের ফসল হিসেবে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের উচিত ছিল প্রথম থেকেই ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে দুই অংশের মধ্যে সমতা নিয়ে চলা, পৃথিবীর বিভিন্ন যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মতো পাকিস্তানকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। তাদের আরও মনে রাখা উচিত ছিল, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যা অর্জন করা যায় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তা করা যায় না। আলাপ-আলোচনা এবং জনমতের প্রাধান্য দিলে পাকিস্তানকে হয়তবা ভাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা করা যেত। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ
×