ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজয় পতাকা হাতে যারা আসে -জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

বিজয় পতাকা হাতে যারা আসে   -জাফর ওয়াজেদ

মুক্তির ছয়চল্লিশতম দিবসটি পার হলো আরও এক আনন্দ উৎসবে। বাঙালীর হৃদয়ে-মননে ডিসেম্বর মাস; মূলত বিজয়ের মাস। পাশাপাশি স্বজন হারানোর বেদনার মাস। একই সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আতঙ্কের দিবস। সেই ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী (যা আজ ষোলো কোটি ছাড়িয়েছে) নবজীবন পেয়েছিল এই ডিসেম্বরেই। মনে হয়েছিল তাদের, এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় সুদীর্ঘ কালরাত্রি শেষে গৌরবোজ্জ্বল ভোরের মুখ দেখেছিল। বাঙালীর জাতীয় ইতিহাসে একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল সেদিন। যে জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল না পূর্বসূরিদের। সেদিনা বাঙালী তেমন একটি নতুন জীবনপ্রবাহে প্রবেশ করেছিল। আজ থেকে ছয়চল্লিশ বছর আগে ষোলো ডিসেম্বরে ঘটেছিল সেই ঘটনা। সাড়ে সাত কোটি প্রাণপ্রহরী প্রদীপ জ্বেলে মুক্তির জয়গান গেয়ে উঠেছিল। যদিও তখনও দেশের অনেকস্থানে শত্রুরা আত্মসমর্পণ করেনি। লড়াইয়ের ময়দানে তখনও মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর সমর্থিত মিত্রবাহিনী হানাদারদের পর্যুদস্ত করার জন্য ছিল সক্রিয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অস্ত্রের জোরে দখল করে নেয়। এর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালী ক্রমে সশস্ত্র হয়ে ওঠে। গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ। রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে পাকিস্তানী হানাদারদের। সেসব মুুক্তিযোদ্ধা জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য হিসেবে ধারণ করে সম্মুখে শত্রু হননে মত্ত হয়েছিল। সেসব দিনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও ইতিহাস আজও মেলেনি। সবই খ- খ- চিত্র। সেই বীরত্বগাথা ধরে রাখার চেষ্টা তেমন হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারাও ক্রমশ এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ক্রমশ কমে আসছে তাদের সংখ্যা। বীরের মতো যারা লড়াই করেছে তাদের একটিই লক্ষ্য ছিল। দেশকে হানাদারমুক্ত করা। পুরো নয় মাস তাই চলেছে মুক্তির যুদ্ধ। এবারের বিজয় দিবসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক তরুণ কিশোর জানতে চেয়েছে, নয় মাসকে কেন স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা হবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের যে তফাৎ, তা তার ধারণায় সন্নিবেশিত না হবার কার্যকারণ পঁচাত্তর পরবর্তী ইতিহাস পাল্টে দেবার কারণে। রাজাকার পুনর্বাসনকারী ও ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে অভিহিত করে এক সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছিল। সর্বচেষ্টা চালিয়েছিল ইতিহাসকে তার নিজের মতো গড়ার। পাকিস্তানী ভাবধারা ফিরিয়ে এনেছিল। বাঙালী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে সেই বায়ান্ন সালে। ভাষা আন্দোলন বাঙালীকে তার স্বকীয়তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে সামনে এনেছিল। নামিয়ে দিয়েছিল লড়াইয়ের, সংগ্রামের ময়দানে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন শেষে বাঙালী স্বাধীনতা পেয়েছিল একাত্তরের ২৬ মার্চ। বায়ান্ন থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছিল তারই পরিণতি ২৬ মার্চ, একাত্তর ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্বাধীন বাংলাদেশ দখল করে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। দেশকে হানাদার মুক্ত করে স্বাধীনতা বহাল রাখার জন্য বাঙালী সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল বলে নয়মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য ঘটানো হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট; যার ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। স্বাধীনতার শত্রুরা এখনও তাই তৎপর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতা আবার আশীর্বাদস্বরূপ ফিরে এসেছে। বাঙালীর মনে আবার স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অবশ্য এটা ঠিক যে, স্বাধীনতার অনুমতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতার আচরণ সমান মূল্যবান। তথাপি স্বাধীনতার আচরণবিধি যদি সমাজের অভিজ্ঞতায় তৈরি না হয়, তাহলে স্বাধীনতার অনুমতি ঘটাতে পারে অনর্থ। স্বাধীনতা কিন্তু বুদ্ধির ব্যাপার নয়। স্বাধীনতা মনের ও মেজাজের ব্যাপার। ইতিহাসে যদি প্রমাণ খোঁজা হয় যে স্বাধীনতা মানুষের প্রগতির একমাত্র পথ, তাহলে ব্যর্থ হতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ইতিহাসের নজির খুঁজে কিছুই প্রমাণ করা চলে না। প্রথমত, কোন ঘটনা একবার কিংবা অনেকবার ঘটেছে, অতএব আবার ঘটবে, এই বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়। দ্বিতীয়ত, একই কারণ ইতিহাসে একই ফল নাও আনতে পারে। প্রকৃতি এবং ইতিহাসের এখানেই পার্থক্য। তৃতীয়ত, ইতিহাসের কোন যুক্তি বা ছক নেই। ইতিহাসবিদ গণৎকার নয়। যারা ইতিহাসের আইনে বিশ্বাস করেন তারা স্বাধীনতার শত্রু। তলিয়ে দেখলে স্বাধীনতার প্রত্যয় মানুষের আত্মসম্মানের অনুভূতি। আত্মসম্মান জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ মানেই কিছু কিছু অধিকার জন্ম অধিকার বলে মনে করেন। নিজে বিভিন্ন অধিকার দাবি করব, অন্যকে দেব না; এমনটি হওয়া উচিত নয়। সেজন্য আত্মসম্মানবোধ থেকে মানুষের মর্যাদা, ব্যক্তির অধিকার এবং সমাজে স্বাধীনতার প্রত্যয় জন্মায়। সমাজভেদে স্বাধীনতা এবং অধিকারের বোধ পাল্টায়। কিন্তু আধুনিক স্বাধীনতা বিশ্বজনীন হয়েছে। কার্যকর হয়েছে কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু বিভিন্ন সংস্কৃতিতে একই স্বাধীনতা আজ স্বীকৃত। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি দৃঢ় হয়। কোন বিশেষ সিদ্ধান্তে যদি পৌঁছতে হয়, তাহলে খোলামনে, সমস্ত যোগ্য লোকের সঙ্গে, সযতেœ সমস্যা নিয়ে আলোচনা কর্তব্য। নতুবা সিদ্ধান্তে ভুল হতে পারে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সেজন্য স্বাধীনতা আবশ্যক। মানুষের মর্যাদা এবং শিক্ষার প্রয়োজন; এই দুই বস্তু স্বাধীনতাকে আধুনিক মানুষের মনে ধরে রেখেছে। সমাজ পাল্টাচ্ছে কিন্তু স্বাধীনতার ইচ্ছা থাকছে। স্বাধীনতার আচরণবিধিতে সেজন্য থাকা দরকারÑ মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার করা ও মর্যাদা দেয়া এবং সযতœ সর্বজনীন আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া। সমাজের জীবনে, দৈনন্দিন ব্যবহারে এই দুটি প্রত্যয় যদি ফুটে ওঠে, তাহলে নির্বাচনে চাতুরী বা রাজনৈতিক পটুত্বে রাষ্ট্র চালনা সম্ভব হয়। কিন্তু স্বাধীনতা যেহেতু মানুষের মেজাজে থাকে, সেজন্য আইন করে স্বাধীনতা সৃষ্টি করা চলে না। আইন অনুমতি দিতে পারে, আইন নিষেধ করতে পারে, কিন্তু আইনের জোরে মেরুদ-হীন মানুষ মেরুদ- লাভ করে না। আত্মসম্মান যদি না থাকে তবে স্বাধীনতার বোধ আসতে পারে না। এখন, ভারতীয় মানুষ মেরুদ-হীন একথা মনে করার কারণ আছে। যদিও এই আবিষ্কারে ভেঙ্গে পড়ার কারণ দেখা যায় না। এ সমস্যা জটিল এবং সংক্ষেপ-সরল করে বলার চেষ্টা শোনাতে পারে বেয়াদপি। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাঙালী মোহাম্মদ আলী জিন্নার ধর্ম-সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের নাম ও নিশান বাংলাদেশের মাটিতে। মুক্ত হয়েছিল শোষক উচ্চবিত্ত শ্রেণী এবং অর্ধশিক্ষিত অথবা কুশিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্নাসিক সংস্কৃতির নাগপাশা হতে। এদেশের হিন্দু, মাসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, আদিবাসী মিলে এক অভিন্ন জাতি হিসেবে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান করেছিলÑ বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে এনেছিল কারাগার থেকে। তেমনি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান মিলে অভিন্ন বাঙালী জাতিরূপে তারা যুদ্ধ করেছে, মরেছে এবং খতম করেছে বর্বর পাকিস্তানী হানাদারদের শক্তি। তারপরও সাড়ে তিন বছরের অধিককাল বাঙালী জাতি জাতীয়তা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে জাতীয় চার লক্ষাদর্শরূপে রক্ষা করেছে। জয় বাংলাকে রেখেছে তার জাতীয় জীবনের সেøাগান হিসেবে। এসবই তো আধুনিক জগত এবং আধুনিক ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার নীতি ও পথ। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় কারও কারও মতে এই যে, তারা যুদ্ধ করতে চাননি; যুদ্ধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। আত্মরক্ষার জন্য সক্রিয় হওয়া স্বাভাবিক জৈবধর্ম। জৈবধর্মের সঙ্গে বিমূর্ত লক্ষ্যাদর্শের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। তেমনি আত্মরক্ষা এবং আত্মবিস্তার এক বস্তু বা জিনিস নয়। যে বিমূর্ত চেতনাবোধ আধুনিক ভৌগোলিক জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির ভিতভূমি এবং তার মূল সর্বক্ষণিক শক্তি, যার নাম জাতীয়তা বা ন্যাশনালিজম। আত্মরক্ষার বিষয়টি জীবদেহের স্বভাবজাত, স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া। সুতরাং, নেতিবাচক জৈবধর্ম। পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ায় আমরা যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলামÑ এ চিন্তার মধ্যে একটি আলাদা জাতিরূপে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যাদর্শে উদ্বুদ্ধ জনতার আক্রমণাত্মক অভিযানের দৃঢ় সংকল্প নেই। অথচ আধুনিক ইতিহাস প্রমাণ দিচ্ছে যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের প্রতিটি জাতীয় যুদ্ধ প্রকৃতই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ। বিদেশী শাসককে বিতারিত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শত্রুকে আক্রমণ শুরু করে। এখন হতে দু’শ’ বছর পূর্বে মার্কিন জাতি ব্রিটিশ প্রভুদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করেছিল, অভিন্ন ধর্ম, জাতীয় চেতনা সম্প্রসারণ ও কেলাসনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার আগেই তারা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিরূপে বিদেশী সেনাবাহিনী বিতাড়নের সংগ্রাম শুরু করেছিল। জয়লাভের এত বছর পরে কোটি কোটি মার্কিন তাদের জাতীয় দিবসে রাজপথে বেরিয়ে আন্দোলনেও মত্ত হয়। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মরেও শত শত লোক। বাংলাদেশেও ’৭৫ পরবর্তী দুঃশাসনকালে বিজয় দিবসে বৃহত্তম বাঙালী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দোল্লাস ও সংযোগ দেখা যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটিত হতে থাকলে বিজয় পতাকা হাতে অগণিত মানুষ বেরিয়ে আসে রাজপথে। এবারের বিজয় দিবসে তরুণ প্রজন্মের আনন্দ আর উল্লাস ছিল অনিবার্ণ জ্বলতে থাকা দীপশিখার মতো প্রজ্বলিত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর, উৎপীড়িত জনসাধারণ এবং সরাসরি তাদের মধ্য হতে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ইতিবাচক জাতীয় চেতনা তার আক্রমণাত্মক বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়েই সক্রিয় ছিল। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ হতে আত্মরক্ষার নানাবিধ জৈব স্বয়ংক্রিয়তা নিঃসন্দেহে একটি চাপ। কিন্তু শত্রুপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করাও এ চাপ হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার পন্থা হিসেবে গণ্য। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে বিমূর্ত চিন্তাভাবনা ও লক্ষ্যাদর্শ গৌণ বিষয়। পক্ষান্তরে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যাদর্শে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত কোটি কোটি সাধারণ মানুষের অপ্রতিরোধ্য সংকল্প সম্পূর্ণ অন্য ধরনের চাপ। এ চাপ ইতিবাচক, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন তার লক্ষ্য। পালিয়ে এ চাপ হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় নেই। অপ্রতিরোধ্য ইতিবাচক চাপে পড়েই পাকিস্তানী আমলের বিশেষ সুবিধাভোগী বাঙালী শ্রেণীটি মুক্তিসংগ্রাম এবং শেষ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল অথবা সহযোগিতা করেছিল। ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই থাকে। ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সে সময়ের বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীটির মস্তিষ্ক পূর্ববৎ বিশৃঙ্খল চিন্তার উর্বর ভূমি হিসেবেই বহাল ছিল। আধুনিক জগতের ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন জিন্নার ধর্ম-সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিবর্তীক্রিয়া হতে তারা যে কারণে মুক্ত হতে পারেনি, তা হচ্ছেÑ একদিকে ধর্মের নামে ধর্মের ব্যবসা শ্রেণীটির বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণ ও পরিবৃদ্ধির পক্ষে বিশেষ সহায়ক। অপরদিকে মার্কিন, ফরাসী, ব্রিটিশ এমনকি আলজিরীয়, লাওসী ও ভিয়েতনামীদের মধ্যে যে ধর্মরিপেক্ষ ইতিবাচক জাতি চেতনার সঞ্চার নানা আর্থ-সামজিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তন ক্রিয়ার মধ্যে হয়েছিল, বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতাবান উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে অনুরূপ অবিভাজ্য জাতীয় চেতনার আনন্দ উদ্ভব হয়নি। তবে পশ্চাদপদতার মূলে রয়েছে বাংলার ধর্ম সাম্প্রদায়িকতাহীন মানবিক লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্রহীন এক অভিনব উন্নাসিক আভিজাত্যবোধ। ব্রিটিশদের গোলামি এই উন্নাসিক সংস্কৃতির জনক, মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়ার মধ্যে জাগ্রত জনতার চাপ এবং আত্মরক্ষার জৈব চাপ ছাড়াও অন্য একটি আকর্ষণ ছিল। প্রভুরা বিতাড়িত হলে আসনগুলো খালি হবে। শূন্য আসনগুলোর মানমর্যাদা ও পদবি বহাল রেখে সেগুলোতে বসার বাসনা তাদের অর্ধমগ্ন চেতনায় সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতার চিহ্নিত শত্রুদের যোগসাজশে শ্রেণীস্বার্থান্ধ সামরিক জান্তা শাসকরা দেশকে পুনরায় বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খল চিন্তার পঙ্কিল আবর্তে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তারা সংবিধানের মূল নীতিকে ধ্বংস করেছে। কখনও ধর্মের নামে, কখনও কোটারি স্বার্থের তাগিদে, কখনও ক্ষমতার আকর্ষণে দেশাতিগ আনুগত্যকে দেশমুখী অনুগত্য অথবা দেশপ্রেম রূপে প্রচার করেছে। যে ইতিবাচক জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ মুক্তিসংগ্রাম করেছিল সে চেতনাকে সমাজের সর্বস্তরে স্থায়িত্ব করার পরিবর্তে তার প্রাণশক্তিতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে জান্তা শাসকরা আর তাদের স্নেহধন্য একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীরা। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। সেই অবস্থা ঘুচে গেছে? শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতহনায় ফিরিয়ে নিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য জাতি হিসেবে বাঙালী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এবারের বিজয় দিবস নতুন প্রণোদনা নিয়ে এসেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। তারা বিজয়ের গান গেয়েছে। শ্রদ্ধা জানিয়েছে লাখো শহীদের প্রতি। দেশ রক্ষা ও গড়ার শপথ নিয়েছে। একাত্তরে যেমন ভাবতাম, বিজয় পতাকা হাতে যারা আসে তারা আমারই ভাই। আজ এই ছয়চল্লিশ বছরের মধ্যগগনে দাঁড়িয়ে আবারও একই উচ্চারণ করতে হয় তরুণ প্রজন্মকে সামনে রেখে। দেশ তার হারানো গৌরবকে আবার ফিরে পাচ্ছে। আবার ধ্বনিত হতে থাকবে ‘জয় বাংলা’।
×