ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জনতাকে কাঁদিয়ে মা বাবার কবরের পাশে শায়িত মন্ত্রী ছায়েদুল হক

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

জনতাকে কাঁদিয়ে মা বাবার কবরের পাশে শায়িত মন্ত্রী ছায়েদুল হক

স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ লাখো মানুষকে কাঁদিয়ে পিতা-মাতার কবরের পাশেই শায়িত হলেন দেশের সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বর্ষীয়ান জননেতা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট ছায়েদুল হক এমপি। রবিবার দুপুরে হেলিকপ্টারযোগে নাসিরনগর কলেজ মাঠে তার কফিন পৌঁছলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা তার মরদেহ গ্রহণ করেন। এসময় তার কফিন ছিল লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত। কলেজ মাঠ থেকে লাশবাহী গাড়ি তার মরদেহ আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় রাস্তার দু’ধারে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে প্রিয় নেতাকে শেষ বিদায় জানান। হিন্দু, মুসলিমসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সকাল থেকেই। বিপুলসংখ্যক নারীকে দেখা যায় আশুতোষ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের কাছে। সকাল থেকেই প্রত্যন্ত বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় বিদ্যালয় মাঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ শ্রেণীপেশার মানুষ নাসিরনগর আশুতোষ বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হয়। পার্শ¦বর্তী মাধবপুর, সাতবর্গসহ আশপাশ এলাকার মানুষজন এসে জড়ো হয়। দুপুর ১টা নাগাদ পুরো মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। তখন মাঠে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। দুপুর প্রায় ১টায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন মাওলানা আব্দুল হাশিম চৌধুরী। জানাজার পূর্বে মন্ত্রীর পুত্র ডাক্তার রায়হান তার পিতার জন্য দোয়া চান। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম এমপি, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংসদ সদস্য মোকতাদির চৌধুরী, সরাইলের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তা, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ. কে, এম একরামুজ্জামানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নানা শ্রেণীপেশার মানুষ অংশ নেয়। জানাজার পূর্বে পুলিশের একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে জেলা প্রশাসন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এরপর তার মরদেহ লাশবাহী গাড়ীযোগে নিজ গ্রাম পূর্বভাগ গ্রামে নেয়া হয়। সেখানে ৩য় দফায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার মা-বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। দেশের অন্যতম সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত প্রয়াত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক। জানা যায়, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ভিটেবাড়িটি এখনও তার একমাত্র সম্বল। পিতার নির্মিত দোচালা টিনের ঘরটি এখনও জরাজীর্ণ। কোথাও কোথাও ভেঙ্গে পড়েছে। রাতের বেলায় বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা নেই। বাড়িতে আসলে পিতার নির্মিত বৈঠকখানায় রাত্রিযাপন করতেন। এখানেও তিনি ২টি টেবিল জোড়া দিয়ে চৌকি বানিয়ে ঘুমাতেন। বিলাসীজীবন তার পছন্দ নয়। তবে তিনি সবসময় পরিপাটি থাকতেন। চোখে সুরমা ব্যবহার করতেন। সহকর্মী রাজনৈতিক কর্মীদের দীক্ষা দিতেন কখনও অর্থের কোন অপচয় করো না। অতিরিক্ত অর্থ অপচয় করলে স্বভাব খারাপ হয়ে যায়। প্রয়াত মন্ত্রীর ৫১ বছরের সহযোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ভানেশ্বর দেবনাথ বলেন, উনি ছাত্রজীবনের পর যখন আইন পেশায় ভর্তি হন, তখন ১৭ বছর একাধারে একটি পাঞ্জাবি পরেছেন। সেলাই করে পাঞ্জাবি পরতেন। তার সঙ্গে থেকে আমার জীবনটাও সাধু সন্ন্যাসীর পর্যায়ে চলে এসছে। যদিও আমি সাধু নই। তিনি বলেন, তার জীবনে মূল্যবান কাপড় পরেননি। সাধারণ কাপড়েই তিনি চলাফেরা করতেন। একই গ্রামের আবদু মিয়া বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে একটি শাল পরেছেন। ১৪টি সেলাই দিয়ে তা ব্যবহার করতেন। ১০০/২০০ টাকা দামের লুঙ্গী পরে, খুবই সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন। করিম মিয়া বলেন, মন্ত্রী ছায়েদুল হক বাড়িতে আসলে ২টি টেবিল জোড়াতালি দিয়ে ঘুমাতেন। তিনি কখনও অন্যায়ভাবে টাকা গ্রহণ করেননি, টাকা দেন নি। পূর্বভাগ গ্রামের এক আত্মীয় বলেন, যে ঘরে এসে সে বসত, এটি তার বাবার ঘর। ঢাকা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার নিজের গড়া কিছুই নেই। তিনি সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তা না হলে তিনি কিভাবে ৫ বার এমপি হলেন। স্থানীয় স্কুলছাত্র রায়হান বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়, তিনি নাসিরনগরের মানুষকে একটি পরিবার মনে করতেন। পরিবারের অভিভাবক হিসেবে এমন ভাবেই তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার জরাজীর্ণ ঘরটি দেখলে মনে হবে পরিত্যক্ত কোন ঘর। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ঘরটি দেশের ৫ বারের নির্বাচিত জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী প্রয়াত ছায়েদুল হকের। সততার জ্বলন্ত এ দৃষ্টান্ত তার সহকর্মীসহ নাসিরনগরবাসীকে এখন কাঁদিয়ে বেড়াচ্ছে।
×