ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজয় দিবসে মা-বাবার হাত ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বিজয় দিবসে মা-বাবা ও বন্ধুদের সঙ্গে লাল সবুজ গায়ে জড়িয়ে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজির হয়েছে সাত বছর বয়সী আবির। পরনে তার লাল সবুজ পাঞ্জাবী বুকে লাল বৃত্ত, কপালে বাঁধা লাল সবুজের পতাকার ন্যায় ব্যান্ডেনা। তার হাতেও আছে একটি লাল সবুজ পতাকা। বিজয়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তারা এখানে জমায়েত হয়েছে বিজয় দিবস উদযাপন করতে। এ বয়সেই আবির জানে বিজয় দিবস কী? কীভাবে আমরা লাল সবুজ পতাকা অর্জন করলাম তাও জানে ৭ বছর বয়সী আবির। এটুকু বয়সেই সে শিখেছে জাতীয় পতাকার মাপ, জাতীয় পতাকা ওড়ানোর নিয়মাবলি। সে জনকণ্ঠকে বলল, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে আমাদের যোদ্ধারা বিজয় এনেছিলেন। তাদের জন্য আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি। আজ বন্ধুদের সঙ্গে আমরা লাল সবুজ পতাকা ওড়াতে এসেছি। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা জাদুঘর পরিদর্শন করেছি।’ শিশু তাসমিমা বিজয় দিবস উদযাপনে মাত্র ৫ বছর বয়সী এ শিশুটির বায়না ছিল লাল সবুজ জামা কিনবে। বাবা তাকে কিনে দিয়েছেন জামা। সে তার মা-বাবার সঙ্গে বিজয় উৎসবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়েছে। সে জানে বিজয় মানে কী? সে জনকণ্ঠকে বলল, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আমরা সেদিন লাল সবুজ পতাকা পেয়েছিলাম। আমাদের দেশ আজ স্বাধীন।’ তার মা বাবা তাকে ইতিহাস জানিয়েছে। তার অবসর সময় কাটে মুক্তিযুদ্ধের শিশুতোষ বই পড়ে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনে যায় এ শিশুটি। বিজয় দিবসে স্কুলের বন্ধুরা মিলে তারা সকলেই স্বাধীনতা জাদুঘর পরিদর্শনে এসেছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এভাবেই বিজয়ের চেতনায় বেড়ে উঠছে। এভাবেই মা, মাটি, দেশের পরিচয় হৃদয়ে ধারণ করে বিজয়ের চেতনায় বেড়ে উঠছে আবির, তাসমিমাসহ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। মনোবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন শিশুকে ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে যত সহজে কোন কিছু শেখানো যায়, পরে ততটা যায় না। এই বয়সের যে কোন শিক্ষা শিশুর মনে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। অনেক সময় মা-বাবা মনে করেন, বড় হলে নিজে থেকে শিখে নেবে। এটা ঠিক না। বড় হলে নিজে থেকে হয়ত শেখার সুযোগ থাকে। কিন্তু যা এত দিন ধরে জেনে এসেছে, তা ভুল কি না, সেই দ্বন্দ্বে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কেউ কেউ ভুলটাই মনে রেখে দেয়। ভুল পথেই থাকে। ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবার একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার স্তর। প্রতিদিন জীবনযাপনের ভেতর দিয়েই অভিভাবকরা শিশুকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে মা-বাবাকেই এগিয়ে আসতে হবে। শিশুকে অন্য সবকিছুর সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, বীর সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এসব সম্পর্কেও ধারণা দিতে পারেন। শিশুদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই কিনে দিতে হবে। প্রতিটি ঘরেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এমন কিছু রাখা উচিত, যা দেখে শিশুরা মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে জানতে আগ্রহী হবে, ধারণা পাবে। এটা আমাদের দেশপ্রেমের বহির্প্রকাশও। তিনি আরও বলেন, শিশু প্রথমে তার পরিবারের মাধ্যমেই প্রভাবিত হয়। অভিভাবকের সচেতনতার ওপর নির্ভর করে শিশু মানসিক বিকাশ। আমাদের প্রত্যেকেরই ঘরে-বাইরে নিজেকে আর পরিবারকে উজ্জীবিত রাখতে হবে বিজয়ের চেতনায়। শুধু গল্প বলে নয়, নানাভাবে বিজয়ের চেতনায় শিশুকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। স্টেশনারি দোকানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিত্রসংবলিত প্রচ্ছদের খাতা, ড্রইং বই পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রচ্ছদভিত্তিক এ ধরনের খাতা, ড্রইং বই, স্মারক বই কিনে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে শিশুকে পরিচিত করাতে পারেন। বিজয়ের দিবস উৎসবের দিন, আনন্দের দিন হলেও বিজয়ের উৎসবকে অন্য সব উৎসবের সঙ্গে মেলানো উচিত নয়। এটা সারা জাতির চিন্তা-চেতনায় রক্তের সঙ্গে মেশানো উৎসব। এদিন উৎসবের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিতও হতে হবে। ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যে এক হয়ে দেশের কল্যাণে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করতে হবে। এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে আর শ্রদ্ধা জানাতে পটভূমি হয়ে উঠেছে পোশাক। বিজয়ের দিবস, স্বাধীনতা দিবসে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কদের বসনেও এখন শোভা পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পোশাক। এ পোশাক কি শুধুই ফ্যাশনে আবদ্ধ? নাকি গৌরবের চেতনাবোধ থেকেই ধারণ করছে তরুণ প্রজন্ম? ফ্যাশন ডিজাইনাররা মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম দেশকে ভালবেসে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই এমন পোশাকে বিশেষ দিনে সাজেন। তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার অহঙ্কারে গৌরবান্বিত হয়ে এমন পোশাক পরছেÑ এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে মনে রাখতে হবে, এ বিজয় শুধু একদিন উদযাপনের জন্য নয়, সারা বছরই হৃদয়ে ধারণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধ আর দেশপ্রেম। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু এই বিজয় দিবসটি কি আমরা সহজেই পেয়েছি? না, তা নয়। এই বিজয় দিবসের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ৩০ লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বিজয়, পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে। ইতিহাসের পাতায় হয়ে উঠেছি বীর-বাঙালী। বাংলাদেশের অস্তিত্ব অর্জন ও বিজয় ইতিহাস বাঙালীর অত্যন্ত গৌরবের ইতিহাস। তাই তো প্রজন্মের থেকে প্রজন্ম ধরে বয়ে নিয়ে চলছে জাতীয় পতাকা। প্রতিবছর বিজয় দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে এবং বিশ^কে মনে করিয়ে দিই মুক্তিযুদ্ধের কথা, বীর শহীদের কথা। এই দিনে আমরা অনুপ্রাণিত হই আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করে। উদ্বুদ্ধ হই বিজয়ের চেতনায় অগ্রগতির পথযাত্রায় এগিয়ে যেতে। সারা দেশেই দিনটি সাজে লাল সবুজে। দোকানে, রাস্তায়, অফিসে, স্কুল-কলেজে, এমনকি গাড়ির সামনে শোভা পায় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিজয়ের ইতিহাসকে অমলিন রাখতে আমরা যেমন হৃদয়ে লালন করি বিজয়ের চেতনা, তেমনি আমাদের জীবনযাপনেও মিশে রয়েছে বিজয়। তবুও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই এখনও তরুণ প্রজন্মের অজানাই রয়ে গেছে বলে মনে করেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। তিনি বলেন, নানা ঘটনাবহুল আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের অনেক কিছুই তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিপূর্ণরূপে জানাতে পারিনি। এটি আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা। তারপরও আজকের তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার, তারা দেশের গান গায়, তারা লাল সবুজ রঙ অঙ্গে জড়ায় এটা আমাকে মুগ্ধ করে। তবে স্বাধীনতাকে শুধু হৃদয়ে লালন করলেই হবে না, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসও জানাতে হবে।
×