ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের আশার পোল্ট্রি শিল্প

প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা - এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা  - এস এম মুকুল

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণে কৃষির পরপরই সবচেয়ে বড় অবদানকারী শিল্পটির নাম পোল্ট্রি শিল্প। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সু-স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী হিসেবে গড়ে তুলতে এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রির মাংস ও ডিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমান সময়ে গরিবের পুষ্টি বলতে গেলেই চলে আসবে পোল্ট্রি শিল্পের নাম। সম্ভবত একারণেই পোল্ট্রিকে সোশ্যাল প্রোটিন হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- উৎসব আর সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, স্কুলের টিফিন, রোগীদের পথ্য থেকে শুরু করে মজাদার আধুনিক রেসিপিতে অনন্য স্বাদে ও পুষ্টিতে পোল্ট্রির মাংস ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে। খাদ্য হিসেবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত তালিকায় উঠে আসছে পোল্ট্রির ডিম। তৈরি পোশাক খাতের পর দেশে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে যে শিল্পটি তার নামও পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক শতাংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ যা ক্রমশই বাড়ছে। সোশ্যাল প্রোটিন পোল্ট্রি বাংলাদেশের আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দিন দিন বেড়ে চলছে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান। মোট প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই যোগান দেয় এই শিল্পটি। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন একজন মানুষ ৭ গ্রাম ডিম ও ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খেয়ে থাকে এবং এই খাদ্য থেকে আমিষ আসে যাথাক্রমে এক ও তিন গ্রাম অথচ প্রাণিজ আমিষ থাকার কথা কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। আশার দিকটি হলো- মানুষের মাঝে এখন স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। মানুষ এখন লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাংস খায়। লাল মাংস গরু বা ছাগলের মাংসে ক্যালরি, চর্বি ও দাম সবই বেশি। পক্ষান্তরে সাদা বা পোল্ট্রির মাংসে চর্বি, ক্যালরি ও দাম অপেক্ষাকৃত বেশ কম। তাই আধুনিক বিশ্বে এখন পোল্ট্রি সহজলভ্য ও সুলভ আমিষের যোগানদাতা হিসেবে সকল ধর্ম-বয়স ও পেশার মানুষের কাছে অগ্রগণ্য। সঙ্গত কারণেই পুষ্টি সমৃদ্ধিতে পোল্ট্রির গুরুত্ব বাড়ছে। দেশে প্রাণীজ আমিষের চাহিদার বড় অংশই পূরণ হচ্ছে পোল্ট্রির উৎপাদিত মাংস ও ডিম থেকে। দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। মোটকথা গার্মেন্টসের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। পোল্ট্রির মাংস ও ডিম দুটো এখন সহজপ্রাপ্য এবং অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যাওয়ার কারণে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমবেশি নিয়মিতই পোল্ট্রির মাংস খেয়ে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছে। দেশে পোল্ট্রির ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ডিম দিবস পালনের ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার প্রীতি বাড়ছে জনগণের মাঝে। আশার খবর হচ্ছে, পোল্ট্রির মাংস বহুমাত্রিক ব্যবহার করে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে চিকেন নাগেট, চিকেন বল, সসেজ, ড্রামস্টিক, বার্গার, চিকেন সমুচা, মিটবলসহ বিভিন্ন ধরনের মজাদার প্যাকেটজাত খাবার। সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করলে এ কথা বলা যায় যে- বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে সোশ্যাল প্রোটিন হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে পোল্ট্রির মাংস ও ডিম। আমাদের আশার পোল্ট্রি শিল্প আমাদের দেশেও খাদ্য হিসেবে পোল্ট্রির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি শিল্প অনন্য। মেডিকেল সায়েন্স মতে- একজন মানুষের বছরে ন্যূনতম ১০৪টি ডিম খাওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বে বছরে জনপ্রতি গড়ে ২২০টি ডিম খাওয়া হয়। জাপানে ডিম খাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি বার্ষিক জনপ্রতি ৬০০টি। আমাদের দেশে জনপ্রতি ডিম খাওয়ার পরিমাণ বছরে গড়ে ৫০টি। সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের বছরে কমপক্ষে ১৮-২০ কেজি মুরগির মাংস খাওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বে জনপ্রতি মুরগির মাংস গ্রহণের পরিমাণ ৪০-৪৫ কেজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বছরে গড়ে ৫১ দশমিক ১ কেজি মাংস খায় এবং কানাডায় জনপ্রতি বছরে মাংস ভোগের পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৫০ কেজি। অন্যদিকে বাংলাদেশে বছরে জনপ্রতি মাংস ভোগের পরিমাণ মাত্র ৩ দশমিক ৬৩ কেজি। তার চেয়ে বড় কথা, প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিম ও মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ আরও অনেক কম। মনে রাখতে হবে, দেশে এখনও প্রতি মাসে মাথাপিছু মুরগির মাংসের ঘাটতি প্রায় ৮০০ গ্রাম ও ডিমের ঘাটতি ৭০০ গ্রাম। ফলে এখনও শূন্য থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ খর্বাকায়, ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ কম ওজনের এবং ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষীণকায়। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পোল্ট্রির মাংস ও ডিম আমাদের খাদ্য তালিকায় যত বাড়বে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ততই বিস্তৃত হবে এ কথা সহজেই অনুমেয়। কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্ত কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত দেশের পোল্ট্রি শিল্পের অগ্রগতি আশার আলো জাগিয়েছে। আশির দশকে পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১৫শ’ কোটি টাকা যা বতর্মানে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি যে কোনো সূচকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত এখন পোল্ট্রি শিল্প। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর খাতটি এখন অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল। বাংলাদেশের রফতানিমুখী অর্থনীতির জন্য সম্ভাব্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে এ শিল্প থেকে। এ শিল্পের সঙ্গে জীবন-জীবিকায় জড়িত জনশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। বর্তমানে ২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ৬০ লাখ মানুষের। মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৭০০ টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি পিস। পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৭ লাখ টন। স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাক পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের তথ্য মতে, ডিম ও মুরগির মাংস রফতানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে উদ্যোক্তারা। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, প্রায় ১ লাখ প্রাণী চিকিৎসক, পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ, নিউট্রিশনিস্ট সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। নতুন আশা নিয়ে সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছে এই শিল্পটি। বিভিন্ন সূত্রে জানা জানায়, ২০২১ সাল নাগাদ দেশে প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি ডিম ও প্রায় ৪ হাজার টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। এই চাহিদা পূরণ করতে এ খাতে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়বে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২১ সাল নাগাদ পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ। তখন দেশের বৃহত্তর খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্প আত্মপ্রকাশ করবে। মুরগির বিষ্টা দিয়ে এখন বায়োগ্যাস ছাড়াও তৈরি হচ্ছে জৈব সার। পোল্ট্রি লিটার থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। দরকার সরকারের প্রণোদনা বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। তাই এ শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রথমে দরকার সরকারের প্রণোদনা। পোল্ট্রি শিল্পে দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। শিল্পের বর্জ্যকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনায় জৈব সারে রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। ছোট ছোট খামারিদের জন্য নামমাত্র সুদে ঋণ সুবিধা দিতে হবে। সহজ পলিসিতে পোল্ট্রি বীমা এবং প্রান্তিক খামারিদের জন্য আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ অফিসগুলোর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সহায়তা দিতে হবে। পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টদের দাবিগুলো বাস্তবতা যাচাই করে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ক্ষদ্র, প্রান্তিক স্বল্প পুঁজির খামারিরা বড় খামাড়ি বা বেদেশী বিনিয়োগের অসম প্রতিযোগিতায় সর্বস্ব হারিয়ে পথে না বসে। ভুলে গেলে চলবে না যে- এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে এবং লাভজনক শিল্পে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের তরুণ থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ দিন-রাত পরিশ্রম করেছে। তাই দেশী বড়, মাঝারি বা প্রান্তির ক্ষুদ্র খামারিদের সুযোগ সুবিধার প্রতি সরকারের বিশেষ মনোযোগ কাম্য। সর্বোপরি এ শিল্পের বিকাশে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পবান্ধব বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। যার ফলে পুষ্টি-কর্মসংস্থান, রফতানি এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টির নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হবে।
×