ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ অ-১৫ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্দার অভিব্যক্তি,;###;আজ নেপালের মুখোমুখি স্বাগতিক বাংলাদেশ

বিজয়ের মাসে শিরোপায় চোখ মারিয়ার

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

বিজয়ের মাসে শিরোপায় চোখ মারিয়ার

রুমেল খান ॥ বাংলাদেশে ছেলেদের ফুটবল যেখানে দিন দিন যাচ্ছে রসাতলে, সেখানে মেয়েদের ফুটবল চলছে দারুণ তালে। ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয় মহিলা ফুটবলের চর্চা। কিন্তু সাফল্য আসতে শুরু করে এর মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই। ২০১০ সাল থেকেই এই সাফল্যের কাহিনী শুরু। গত সাত বছরের সাফল্যের ফিরিস্তিগুলো শুনুন : সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রৌপ্যপদক অর্জন (২০১৬)। এসএ গেমস ফুটবলে দু’বার তাম্রপদক (২০১০ ও ২০১৬)। এএফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়ন (আঞ্চলিক) আসরে দু’বার চ্যাম্পিয়ন (২০১৪ ও ২০১৫)। একবার তৃতীয় হয়ে ফেয়ার-প্লে ট্রফি লাভ (২০১৩)। এএফসি অনুর্ধ-১৬ আসরের বাছাইপর্বেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূলপর্বে উন্নীত (২০১৬)। এই প্রাপ্তিগুলো সমৃদ্ধ করার জন্য আবারও সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ দল নিজেদের মাটিতেই। তবে সিনিয়র, অনুর্ধ-১৪ বা অনুর্ধ-১৬ দল নয়। এবার পালা অনুর্ধ-১৫ জাতীয় দলের মেয়েদের। আজ থেকে ঢাকার কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে শুরু হচ্ছে ‘সাফ অনুর্ধ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে’র প্রথম আসর। সেখানেই নিজেদের সাফল্যগাঁথা রচনা করার পালা গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যাদের। আজ দিনের প্রথম খেলায় সকাল সাড়ে ১১টায় মাঠে ভারত মোকাবেলা করবে ভুটানকে। দ্বিতীয় ম্যাচে দুপুর আড়াইটায় মাঠে নামবে স্বাগতিক বাংলাদেশ। তাদের প্রতিপক্ষ হিমালয়ের দেশ নেপাল। বাংলাদেশ দলের সুবিধা হলো এই দলে আছে অ-১৪ ও অ-১৬ এবং জাতীয় দলে খেলা বেশকিছু ফুটবলার (বয়স কম থাকার সুবিধার কারণে অ-১৬ ও জাতীয় দলের কিছু ফুটবলার অ-১৫ দলে খেলার সুবিধা পাচ্ছে)। এর কয়েকমাস আগে থাইল্যান্ডে গিয়ে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে খেলা বাংলাদেশ দলের ১১ ফুটবলারকে অ-১৫ দলে নিয়েছেন ছোটন। আজকের ম্যাচে কেমন করবে বাংলাদেশ? ছোটন বলেন, ‘ভারত ও নেপালের মহিলা ফুটবল ইতিহাস অনেক পুরনো। সাফল্যও বেশ ঈর্ষণীয়। কাজেই তারা শক্তিশালীও বটে। ভুটানও সম্প্রতি ভাল খেলছে। তারা উঠতি শক্তি। তবে বিগত সময়ের পারফর্মেন্সের আলোকে বাংলাদেশ দলও অনেক ভাল খেলছে এবং তিনটি আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কাজেই আমরাও বেশ শক্তিশালী। আমি তো মনে করি, এই টুর্নামেন্টে আমরাই শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে ফেভারিট।’ পুরুষ জাতীয় দলের পারফর্মেন্স ও ফিফা র‌্যাঙ্কিং যেখানে ক্রমশ অধোগতির, সেখানে নারী জাতীয় ফুটবল দলের ঠিক উল্টো দৃশ্য। প্রতিনিয়তই উন্নতি করছে তারা। শুক্রবার ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে দেখা গেছে ছয় ধাপ উন্নতি করেছে সাবিনা-কৃষ্ণারা। ১০৬ নম্বর থেকে ১০০ নম্বরে উঠে এসেছে তারা। এজন্য তাদের অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। এটাই এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা দলের সেরা র‌্যাঙ্কিং। এশিয়ার মধ্যে এখন তারা আছে ২৪তম এবং সাফ অঞ্চলে দ্বিতীয় অবস্থানে। সাফ অঞ্চলে বাংলাদেশের আগে আছে ভারত (এশিয়ায় ত্রয়োদশ, বিশে^ ৫৭তম) এবং নেপাল (এশিয়ায় ২২তম, বিশ্বে ৯১তম)। এ বিষয়টি ছোটনকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘র‌্যাঙ্কিংয়ে আমাদের উন্নতি হয়েছে ভাল কথা। তবে আমরা এটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। কারণ মাঠের খেলাটাই আসল। জিতলে বা সাফল্য পেলে র‌্যাঙ্কিং এমনিতেই ভাল হবে। এটা নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হবার কিছু নেই।’ ২০১৫ সালে এএফসি অ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপে (আঞ্চলিক জোন, সাউথ এ্যান্ড সেন্ট্রাল) অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ওই আসরে ভারত, ভুটান ও নেপালের বিরুদ্ধে খেলেছিল বাংলাদেশ, সেই দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই আছে এবারের অ-১৫ দলে। কাজেই এটাকে দলের বাড়তি শক্তি হিসেবেই দেখছেন ছোটন। ২০১৫ সালের ওই আসরটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল নেপালে। ফাইনালের আগে প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। এতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফাইনাল খেলা স্থগিত করা হয় (কয়েক মাস পর সেটি নেপালেই অনুষ্ঠিত হয়)। বাংলাদেশ দল সেখানে আটকা পড়ে। পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় বিশেষ বিমানে করে বাংলাদেশ দলকে ফিরিয়ে আনা হয়। ছোটনের কাছে সেই ভয়াল স্মৃতি এখনও তরতাজা, ‘বাংলাদেশে ফিরে আসতে এবং ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে নেপাল দলের স্টাফরা আমাদের যে সহায়তা করেছিলেন তা কোনদিনও ভুলব না। পরে তাদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কই হয়ে যায়।’ সেই নেপালের বিরুদ্ধেই আজ ছোটনের শিষ্যাদের লড়াই। কিন্তু মাঠে কি সেই আন্তরিক সম্পর্ক থাকবে? ‘অবশ্যই না। মাঠে আমরা আগ্রাসী থাকব। খেলা থাকবে খেলার জায়গায়।’ ছোটনের ভাষ্য। অ-১৪ আসরে নেপালকে দু’বার হারিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা যথাক্রমে ১-০ এবং ৯-০ গোলে। কাজেই আজকের ম্যাচে বাংলাদেশই ফেভারিট, এতে কি কোন সন্দেহ আছে? বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্দার জবাব, ‘দেখুন, আমরা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমাদের প্রস্তুতিও ভাল। দেশের মাটিতে খেলা। বিজয়ের মাস চলছে। একাত্তরে আমরা যেমন বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম, তেমনি ফুটবল মাঠেও ভাল খেলে আমরা এবার বিজয় ছিনিয়ে আনতে চাই। এজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’ শনিবার সকালে বাফুফে আর্টিফিসিয়াল টার্ফে অনুশীলন করে মারিয়া বাহিনী। এর আগে তারা মাঠে ঢোকে বাংলাদেশের বিশাল আকারের একটি পতাকা নিয়ে। এ থেকেই বোঝা যায় দেশপ্রেমে কতটা উদ্বুদ্ব তারা। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুরের মেয়েরা এখন বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের গর্ব। কলসিন্দুরের ক্ষুদে এই ফুটবলারদের আছে একেকটি গল্প। অধিকাংশ খেলোয়াড়ই দরিদ্র মা-বাবার সন্তান। কেউ রিকশাচালক, কেউ শ্রমিক, কেউ কাঠমিস্ত্রী, কেউ বর্গাচাষী ও কেউবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সন্তান। এরা দারিদ্র্যকে জয় করে সাফল্যের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এদেরই একজন মারিয়া মান্দা। বাংলাদেশ অ-১৫ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। আজ থেকে চার বছর আগেও একজোড়া বুট কেনার সামর্থ্য ছিল না তার। স্কুল শিক্ষকরা বললেন, যারা খেলতে চাও তাদের বুট কিনতে হবে। কিন্তু মারিয়ার বুট কেনার মতো পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য নেই। তার বাবা বীরেন্দ্র মারাক আগেই মারা গেছেন। মা এনতা মান্দা। গৃহকর্মীর কাজ করেন। মাঝে মাঝে দিনমজুরিও করেন। নিজের জমিজমা নেই, অন্যের জমিতে ধানের চারা লাগান। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় গ্রামের রাস্তায় মাটিও কাটেন। শ্রমিকের কাজ করে ডাল-ভাত খেয়ে না খেয়ে কষ্টে সংসার চালান। ক্ষুদে মারিয়ার ফুটবল খেলার স্বপ্ন পূরণে তার মা তিনদিন শ্রমিকের কাজ করেন। সেই টাকা দিয়ে বুট কিনে খেলায় অংশ নেয় মারিয়া। সেই মারিয়া কি আজ সতীর্থদের নিয়ে আবারও নেপাল-বধ করে শুভ সূচনা করতে পারবে?
×