ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ কল্পতরু -মাসুদ আহমেদ

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

গল্প ॥ কল্পতরু -মাসুদ আহমেদ

কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিজের ইউনিটের অস্ত্রাগারে দাঁড়িয়ে চায়নিজ সাব-মেশিনগানের ব্যারেল পরিষ্কার করছিল সুবেদার আশরাফ কোতোয়াল। ওর বাড়ি জয়পুর হাটের চালিরকান্দি গ্রামে। ঘামে খাকি ইউনিফর্ম ভিজে জব্জব্। তাও চারদিকে গাছ আছে বলে রক্ষা। নইলে অবস্থা আরও খারাপ হতো। আজ ১৯৭১ এর মার্চের ২১ তারিখ। ও মনে করতে পারল না শেষ বৃষ্টি কবে হয়েছিল। কোয়েটাতে কি আর বর্ষা হয়? আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘের লেশ মাত্র নেই কোথাও। অস্ত্রটার কাজ শেষ হতে হতে আশরাফ ভাবছিল কবে বৃষ্টি হবে কে জানে। ওর সঙ্গের ৩০ জন সৈন্যও একই কাজে মগ্ন। কারও কারও কাজ শেষ। কয়েকজনের হওয়ার পথে। ও এবার সবার কাজ একে একে পরীক্ষা করল। ওর মুখে-চোখে সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠল। গতকাল বিকেলে অফিস শেষ হওয়ার সময় কমান্ডিং অফিসারের এই আদেশ হঠাৎ এসে হাজির। সমস্ত হাতিয়ার আজ বেলা বারোটার মধ্যে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। সবার কাজ শেষ। আশরাফ এবার ওর সৈন্যদের হুকুম দিল হাতিয়ারগুলো অস্ত্রাগারে জমা দিতে। অফিস বেলা দুটো পর্যন্ত। আশরাফ ঘড়ি দেখল। বেরেট্টা যথাস্থানে রেখে, ঘাম মুছে সিওর রুমের পাশে তাঁর সহকারীর রুমে গেল। সহকারী একজন হাবিলদার। নাম রুস্তম খান তালপুর। বাড়ি সিন্ধুর থাট্টায়। ওকে বলল, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তালপুর টেলিফোনে কথাটা সিওকে জানাল। সিও বাঙালী। তিনি অনুমতি দিলেন। স্যালুট শেষে আশরাফ বলল, স্যার, এক্টু বাড়ি যেতি চেয়েছিলাম। এই সময়ে? স্যার, কোন অসুবিধা? না না। মানে ঢাকায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আলোচনা চলতেছে। যে কোন সময় ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনার ঘোষণা হইতে পারে। তখন তো উৎসব হইব। ফায়ার ওয়ার্ক হইব। তখন ফৌজ লাগবো না? স্যার, ছোট চাকরি করি। এই সব খবর কি আর... না, আশরাফ। এখন সারা প্রদেশের মানুষই এই সব কথা জানে। যাই হোক তোমার কি খুব জরুরী দরকার? না স্যার, তা না। আমার মনে হয় তাইলে, একটু অপেক্ষা কর। তবে একান্ত জরুীর হইলে পরে কইও। বাঙালী হোক, পাঞ্জাবি হোক, এই পেশায় তর্ক বা যুক্তি প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই। আশরাফ বাঙালী সিওর হুকুম মেনে রুম থেকে বের হয়ে এসেছিল। আশরাফ স্বভাবে সরল। বের হওয়ার সময় সিও ওকে বলেছিলেন, কোতোয়াল, চোখ কান খোলা রাইখ মিঞা। সরল মন সরলই থাকে। আশরাফ শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবর নেয়া চাকরি বিধির পরিপন্থী বলে বিশ্বাস করে এসেছে। তবু ক্যান্টনমেন্টের থার্ড গেটে মিছিলের স্লোগান, জয়দেবপুর সেনানিবাসে গুলি বর্ষণের খবর কিভাবে যেন বাঙালী সৈন্যদের কাছ থেকে না শুনে পারেনি। ওর কানে লেগেছিল, ফায়ারওয়ার্কস হবে, রেডিওতে মুজিবের সরকারের কথা শোনা যাবে কথাগুলোতে। আশরাফ দুদিন ভেবেছিল। সাহেবের ইউনিটে সে আজ চৌদ্দ মাস ধরে আছে। ও সরল হলেও এটুকু বুঝে এসেছে যে সাহেব কেতাবি মিলিটারি গাম্ভীর্যের আড়ালেও অধস্তন বাঙালীদের সঙ্গে সাধ্যমতো ভাল ব্যবহার করেন। তবু আশরাফ ছুটির কথাটা আর তুলত না। কিন্তু দুদিন পর ওর গ্রাম থেকে চিঠি এলো। ওর বাবা তাতে লেখেছেন, আট মাস হয়ে গেল। নিজের প্রথম ছেলেকে দেখতে আসলি না একবার? আশরাফ কোতোয়ালের ইউনিট খেমকারান ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড ছিল। তখুনই শিশুটির জন্ম হয়। ইউনিট পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। অথচ আশরাফ-এর মধ্যে একবারও বাড়ি যেতে পারেনি। নতুন স্টেশনে এসেই ছুটি চাওয়া যায় না। তারপর ১ মার্চ থেকে ঢাকার অবস্থা কানে কানে শুনে ও আরও অপেক্ষা করা ঠিক বলে ভেবেছিল। আজ ভাবল এখন কথাটা পারা যায়। এটি এ বংশে প্রথম নাতি। কোতোয়ালের ছোট তিন ভাই আছে। তারা এখনও কেউ বিয়ে করেনি। শুনে মেজর মুস্তাফিজ ময়মনসিংহের ভাষায় বললেন, আরে মিয়া এইডায় কি আর না করণ যায়? খুব ভাল খবর। এই কথাডা তো আগে কও নাই। ছুটি দেবার ব্যাপারে কোন কড়াকড়ির নির্দেশ নেই উপর অলাদের কাছ থেকে। অতএব দুই মাস চাওয়া মাত্র কোতোয়াল ছুটি পেয়ে গিয়েছিল। সেটা সাত সপ্তাহ আগের ঘটনা। ছুটির আর দশ দিন বাকি আছে। প্রথম সন্তান, তাও আবার ছেলে। ওকে নিয়ে আশরাফের এতগুলো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেছে টেরই পায়নি। ওর বাবা এবং শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল। আকিকা আর ভুরিভোজ এ গ্রামের প্রায় কেউ বাদ পড়েনি। এ বাড়িতে কোন রেডিও না থাকলেও ২৬ মার্চ রাতে ঢাকায় যা হয়েছে তার বেশকিছু খবর কানে কানে এই গ্রামেও এসে পৌঁছেছিল। এই খবরে আশরাফের বাবা বলেছিলেন, তো ভাল কথা। শুনছি মহকুমা আর জেলা শহরগুলোতেও পাঞ্জাবি সৈন্যরা আসতেছে। আসা দরকার তো। যারা জয়বাংলা বলি ফাল পারতাছে হেই ডিসেম্বর মাস থেকি তারা তো ৪৭ এ মার পেটেও আসেনি। এই চাঁদ তারা নিশানের দাম হেরা কি বুঝবি? কতটুকু বুঝবি? এইটা বুঝানোর জন্যি এই সৈন্যদের আওনের দরকার আছে। আশরাফ কোতোয়াল পাঞ্জাবিদের সঙ্গে চাকরি করছে ছ’বছর ধরে। ১৯৬৫’র যুদ্ধের পর ও সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়। মুক্তিবাহিনীর কিছু কিছু কথা ও শুনেছে। ও মনে মনে তাতে একমত হয়নি। এদিকে শিশুপুত্র। সীমান্ত, এই গ্রাম থেকে খুব দূরে নয়। গ্রামের তরুণ-যুবক দু’একজন ওকে এর মধ্যেই বলেছে ও ওদেরকে ট্রেনিং দিতে পারে কিনা। উদ্দেশ্য শুনে ও চমকে উঠেছে। বলেছে ‘কি বলতিছ। জানতি পারলি জানে মারি ফেলাবে। তাছাড়া ওরা মুসলমান, লোক ভাল।’ কথাটা আর আগায়নি। ও ভাবছিল ছুটির একদিন থাকতেই ঢাকা রওনা হবে। ওদিকে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা ভাবছিলেন অন্য কথা। পাঞ্জাবি মিলিটারিরা নাকি এখন থানায় থানায়ও ঢুকছে। পাকিস্তানবিরোধী সন্দেহে কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিক থেকে তাহলে তাদের গ্রাম নিরাপদ। ওরা যদি আসেও এদিকে তখন দেখানো যাবে, তোমাদের দলের সৈন্য আছে এই গ্রামের পোলা। আবার তার বাবাও মুসলিম লীগার এবং শান্তি কমিটির সদস্য। অতএব গ্রাম নিরাপদ। চিন্তাটি যুক্তিযুক্ত বটে। আজ মে মাসের ১৮ তারিখ। বুধবার জ্যৈষ্ঠের ৪ তারিখ। গতকাল ভাল বৃষ্টি হয়েছিল। আজ সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার। বেলা দশটা। আম গাছের সবুজ পাতার ঘনছায়া এ বাড়ির চারদিকে। উঠানের এক কোণে ধান শুকাতে দেয়া। আশরাফের ছেলেটি উঠোনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। ওর বৌ রান্নাঘরে বড় দুটো মাটির রাইং এ ধান সিদ্ধ করছে। বাতাসে সেই ধানের গন্ধ। এই গন্ধ নাকে লাগতে লাগতে জয়নবের মনের একটা স্মৃতির জানালা খুলে গেল। সেটা একটা চিঠির লেখা। ওর স্বামীটি কথা কম বলে। হাতে শক্তি মারাত্মক। পড়াশোনা করেছিল ক্লাস টেন পর্যন্ত। তারপরই সৈন্যের খাতায় নাম লেখায়। বিয়ে হয়েছে তারও পাঁচ বছর পর। পাশের ইউনিয়নে বাড়ি। এই লেখার বিষয়টা হলো তার কাব্যপ্রীতি। বিয়ের পরই পশ্চিম পাকিস্তান। করাচি, কোয়েট, নয় শিয়ালাকোট। ওখান থেকে চিঠি লিখত। এবার গত জানুয়ারি মাসে লেখা চিঠিটায় একটা কবিতা ছিল। ‘কোন এক পূর্ণিমার আলো মাখা রাতে বকুলের মালা ছিল তব ভীরু হাতে লাজে নত মুখখানি বুকে অনুরাগ প্রদীপের শিখা মনে মমতার দাগ।’ এসব বাণী এমন অমোঘ যে অল্প বয়সী এবং সামান্য শিক্ষিত মানুষও এগুলো বুঝতে পারে। অনেক শান্ত মানুষের ভালবাসা কোন গহীনে যেন লুকানো থাকে ভেবে ক্লাস এইট পাস জয়নবের মনের গভীরে খুব ভাল লাগল। আহ কত দিন পর মানুষটাকে একটানা এতদিন কাছে পাচ্ছে। আশরাফ কোতোয়াল বৌকে বলে, বাড়ির বের হবে, লেদু খলিফার দোকানে যাবে। ওখান থেকে কিছু জিনিস আনতে হবে। আজ গঞ্জের হাটবার। গত সপ্তাহের হাঁট থেকে মেলা জিনিস কেনা হয়েছিল। তাই আজ আর ওখানে যাবার দরকার নেই। আশরাফের মা বলে দিয়েছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে। ছেলেকে সহজে কাছে পাওয়া যায় না। শীতকাল এমনি এমনি গেছে। পিঠা চিড়া কিছু খাওয়ানো হয়নি। আজ এই অসময়ে তিনি একটা পিঠা করছেন। দুপুরের খাবারের আগেই এটা খেতে হবে। চিতই পিঠা আর মোরগের মাংস। এই পিঠার অবশ্য ঋতু নেই। বছরের যে কোন সময় তৈরি করা যায়। আশরাফ বাড়ি থেকে বের হয়ে হালটের পথ ধরলো। দু’শ গজ পার হয়েছে। একটা জলপাই রং এর ট্রাক হালটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ছ’বছর সেনাবাহিনীর চাকরি এবং একটি প্রোমোশন পাওয়া সুবেদার আশরাফ কোতোয়ালকে এই বাহন এবং দৃশ্যপট চিনতে পাঁচ সেকেন্ডও ব্যয় করতে হলো না। তাৎক্ষণিক অনুভূতিটি ঠিক ভীতি না বিস্ময় না অনিশ্চিয়তার তা বুঝতে পারল না ও। তবু সৈন্য তো। মুহূর্তে নিজেকে প্রস্তুত করল। চালকের সিটের বাঁ-দিকে একজন ফর্সা মানুষ বসে আসে। মানুষটা নেমে আসল। সাত আটজন গ্রামবাসী এর মধ্যে হালটের আশপাশে কৌতূহলী চোখে ট্রাক’টার দিকে তাকাচ্ছে। মানুষটার পেছনে পেছনে ট্রাক থেকে জন পনের সেন্য নিচে নেমে এসেছে। প্রথম লোকটা একজন ক্যাপ্টেন। বেরেট আর খাকি ইউনিফরম পরনে লোকটার উচ্চতা ৬ ফুট হবে। ভীষণ খাড়া নাক। চোখে প্রবল সন্দেহ। তার হাতে কোন অস্ত্র নেই। সৈন্যদের কারও হাতে স্টেনগান, কারও ব্রেনগান কিংবা রাইফেল। মাথায় জলপাই রঙের নেট লাগানো একই রঙের স্টিলের হেলমেট। একজন সৈন্য ট্রাকের মাথার ওপর একটা মেশিনগান পেতে সেটার নল সামনের দিকে তাক্ করে রেখেছে। সে ট্রাক থেকে নামল না। আশরাফ এবার ট্রাকটার নম্বর দেখতে পেল। ২০ পাঞ্জাব। ওর সাহস এবং আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। ক্যাপ্টেন এখন আশরাফের দিকে এগিয়ে এসেছে। তার বুকে ঝোলানো প্লাস্টিকের প্লেটে নাম দেখা যাচ্ছে। ওয়াসীম নায়েক। আশরাফ এবার ওয়াসীমকে সালাম দিয়ে নিখুঁতভাবে স্যালুট করল। নায়েক স্যালুটের প্রত্যুত্তর করল না। আশরাফের পরনে লুঙ্গি, ওপরে হাওয়াই শার্ট, পায়ে একজোড়া রাবারের পাম্প সু। নায়েক কয়েকটি ভয়াবহ কঠিন পরীক্ষায় পাস করে এই চাকরি এবং দুটি পদোন্নতি পেয়েছে। তারপরও তার কাছে মনে হলো, ‘না, এটা কোন রাজাকার, কোন আল শামস বা কোন মুক্তির কাজ হতে পারে না। আমি কারও গান শুনেই বুঝতে পারি ওই শিল্পী কি এক বছরের না দশ বছরের পুরনো। আর এটা তো আমার পেশা। কোন চালবাজি নয়। এ লোক জেনুইন। এমন করে স্যালুট করতে পারা একজন খাঁটি সেন্যের পক্ষেই সম্ভব’। স্যালুটের প্রত্যুত্তর না পেয়ে আশরাফ একটুও মনোবল হারাল না। ইউনিফরম ক্যান্টনমেন্ট এ রেখে আসলেও ট্রেনিং আর অভিজ্ঞতা সঙ্গেই আছে- নিখুঁত উর্দুতে ও এবার জোরে বললÑ স্যার, আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুবেদার আশরাফ কোতোয়াল। ওর ডান হাত এখনও কপাল থেকে নামায়নি। এবার নায়েক জিজ্ঞেস করল, তোম লোগ কৌন সে ফৌজ মে হ্যায়? স্যার, সতেরো পাঞ্জাব। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। তোমহারা সিও কো নাম বাতাও। মেজর মুস্তাফিজুর রহমান, সাব। তোমহারা পারসোনাল নম্বর? পি-৫১০০৫ ডান্ডি কার্র্র্ড হায় তোমহারা পাছ? হামারি মোকাম ইছ গাঁও মে হ্যায়। ডান্ডি কার্ড উধার সে হ্যায়। আভি হাম ছোটি সে হ্যায় স্যার। বিশ্বাস এবং হাসি দুটোই ফুটে উঠল ক্যাপ্টেনের ফর্সা মুখে। এবার সে নিখুঁত আনুষ্ঠানিকতায় স্যালুটের প্রত্যুত্তর করল। পেছনের সৈন্যদের মধ্যে যে টান টান ভাবটা ছিল তা এখন চলে গেছে। ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে এই অধঃস্তনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। তারপর তাদের মধ্যে ছুটির কারণ, দেশের বর্তমান অবস্থা, গ্রামের এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদের মনোভাব নিয়ে আলোচনা হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নায়েক যেন আশরাফের মনোভাব পড়তে পেরে জানতে চাইল, তোমার বাড়ি কতদূর? আশরাফ একান্ত খুশি মনে বলল, স্যার সাহস করিনি এতক্ষণ। ওই যে বাড়ি দেখা যায়। স্যার, অনুমতি করলে একটা কথা বলি? বল। চলেন আমার বাড়িতে চলেন। আমার বাবা, মা, বৌ সবাই খুশি হবে। দুপুরের খানা খাবেন ওখানে। সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ মেকলে ১৩০ বছর আগে বলেছিলেন বাঙালী উর্ধতনের সঙ্গে তোষামদি করে। এই মুহূর্তে আশরাফ ঠিক সেই অনুভূতিতে আক্রান্ত না হলেও উর্ধতনের কাছ থেকে নিরাপত্তা বোধে আকান্ত্র। মনের এই অবস্থায় মানুষের মনের কথা দ্রুত বের হয়ে আসতে পারে। ও বিনা চিন্তায় ফট করে বলে ফেলল, স্যার, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গরিব হলেও তারা অতিথিপরায়ণ। ক্যাপ্টেন নায়েকের মুখভাবের পরিবর্তন হলো না তবে মনোভাবের হলো। তার মানে সৈন্য হয়েও এও অন্যান্য বাঙালীর মতো রাজনীতি করে। তার মনে ‘পূর্ব পাকিস্তানীরা গরিব’ কথাটা গেঁথে গেল। তার মানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ধনী? আরও প্রশ্ন এদের গরিবানার জন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই একই উত্তর সবার মনে। কোন সৈন্য বা খাঁটি মুসলমান এমনভাবে রাজনীতি করতে পারে না। আর দেশের এ দুর্দিনে এ ছুটি নিয়েছে কেন? হিন্দুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিছিন্ন করার জন্য? নিশ্চয়ই তাই। ক্যাপ্টেন হাসি মুখে বলল আলবৎ। তোমার দাওয়াত কবুল। তবে আমরা বিশজন মানুষ। এত রান্না বান্নার তকলিফ... সুবেদার জানালো, না কোন অসুবিধা হবে না। সব কিছু ঘরেই আছে। ক্যাপ্টেন নায়েক এবং তার বাহিনীর আহার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। লড়াকু সৈন্য। তার মধ্যে আর্য বংশ। গরম আর ভেজা বিদেশ বিভুঁই। তাই খাদ্য পানীয় নিঃশেষ হলো প্রচুর। গ্রামের রান্না বলে রক্ষা। শহরের হলে এই পরিমাণটা পর্যাপ্ত হতো না। গ্রামে রান্না করা হয় বেশি। খাবারের আগেই আশরাফ তার বাবা ওমর আলী কোতোয়ালের সঙ্গে ক্যাপ্টেনকে পরিচয় করিয়ে দিলেও আর একটা কাজ করতে ও ভুল করেনি। দেরিও করেনি। তা হলো ওর ইউনিট আইডেনটিটি কার্ডটা নায়েককে দেখানো। ইমানের দেশ হলে হবে কি চাক্ষুস প্রমাণপত্র বড়ই জরুরী। নায়েক খুব হাল্কাভাবে কার্ডটায় চোখ বুলাল। কারণ সে প্রথমেই বুঝতে পেরেছে যে কোতোয়াল খাঁটি পাকিস্তানী সৈন্য। আর তাছাড়া খাঁটি সৈন্য হলেই বা...? এখন উদাসী এবং রোদেলা দুপুরে গাছের ছায়ারা দীর্ঘ। চেয়ার আর বেঞ্চিতে সবাই বসে আছে। গ্রামে মেহমান এলে সাধারণত আশপাশের মানুষরা জড়ো হয়, নিমন্ত্রণ না পেলেও। আজ তেমন একজনও আসেনি। বরং দু’চারজন যারা ছিল তারা কখন যেন নীরবে সরে পড়েছে। পানাহারে তৃপ্ত হলেও উঠোনের চার কোণে বসা এবং দাঁড়ানো পাঁচ ছয়জন সৈন্যের হাতে ভারি আগ্নেয়াস্ত্রগুলোকে এতটুকু শ্লথ দেখা যাচ্ছে না। আশরাফের বাবা, মা, স্ত্রী এবং কাজের মেয়েরা তা খেয়াল না করলেও বিষয়টা আশরাফের চোখ এড়ায়নি। এত মেহমানদারি, এত চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়, এত পরিতৃপ্তির ঢেকুর। তবু ওর মনে কোথায় কি যেন একটা খচ্ খচ্ করে। ক্যাপ্টেন আলাপের ভঙ্গিতে আশরাফ এর বাবাকে জিজ্ঞেস করে কি সুন্দর গ্রাম আপানাদের। কচুরিপানা, পুকুর, হাঁস, মুরগি। এত সবুজ ছায়া। ঘাস ভরা মাঠ, ধান ক্ষেত। অথচ কিছু লোক এই শান্ত সুন্দর দেশটাতে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আশরাফের বাবা, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বলে, এই দেশের শান্তি কেউ নষ্ট করতে পারবে না। আপনারা আছেন, আমরা আছি। নায়েক এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলে অথচ জানেন, আমার বাড়ি রাওয়ালপিন্ডির পাশে ঝং জেলায়। সেখানে কি গরম। নাই গাছ, নাই বৃষ্টি, নাই এ রকম পুকুর বা ঘাস। কত কষ্টে আমরা ওখানে জীবনযাপন করি। এখন পান খাওয়া চলছে। আশরাফ তার শিশুসন্তানকে কোলে করে ক্যাপ্টেন নায়েকের সামনে নিয়ে আসে। বলে স্যার, ইয়ে মেরে আওলাদ হ্যায়। নায়েক মুখ ভরা হাসি নিয়ে প্রশ্ন করে ইস্কা উমর কিত্না হ্যায়?আশরাফ উত্তর দেয়। ক্যাপ্টেন এবার শিশুটির চিবুকে হাত ছুঁয়ে বলে, বেটে তোমহারা নাম কিয়া হ্যায়? আশরাফ উত্তর দেয়। বলে, আকবর, স্যার। বহুৎ আচ্ছা নাম। মোঘল বাদশাহর নাম। গরমের মধ্যে স্বাস্থ্যবান শিশুটি একটি সুতির নিমা পরে রয়েছে। ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়ানো একজন সৈন্য হাতে ধরা আগ্নেয়াস্ত্রের নল সে তার নখ দিয়ে পরীক্ষা করছে। এসব বস্তু চেনার বয়স তার হয়নি। বাঘ বা সাপ এর অর্থ তার কাছে একই। সৈন্যটিও হাসিমুখে শিশুটির এই কাজটি দেখতে থাকে। বাধা দেয় না। উর্দু বলতে না পারায় ওমর আলী কোতোয়া ছেলের মাধ্যমে কথাবার্তা বলছিল। এবার সে বাড়ির ভেতরে যায়। ছেলের সঙ্গে সে আগেই একটা বিষয়ে পরামর্শ করেছে। ‘বাব্বা, খাস পাঞ্জাবি সাহেব। ছেলের উপরওয়ালা। অতএব, বিশেষ একটা কিছু করতে হবে।’ উঠোনের কথাবার্ত এখন প্রায় থেমে গেছে। বড় শোবার ঘর আর রান্না ঘর থেকে নারীরা এই মেহমানদের আহার গ্রহণ এবং আলাপচারিতা লক্ষ্য করছিল। তারা এগুলো রান্না এবং সরবরাহও করেছে এতক্ষণ ধরে। যদিও সামনে আসেনি। এখন ক্যাপ্টেন আস্তে করে ওর পাশে বসা নায়েব সুবেদার লছমন খান আশ্রাবিয়াকে কি যেন বলে। কথাগুলো গুরুমুখী ভাষায় বলায় ভাল উর্দু জানা সত্ত্বেও আশরাফ বুঝতে পারে না। আশ্রাবিয়া মাথা নাড়ে এবং সৈন্যদের দিকে তাকায়। আশরাফ এবার ক্যাপ্টেনকে বলে, ওর বাবা ওদের দলকে বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে চান। এতে কোন আপত্তি আছে কিনা? ক্যাপ্টেন বলে, আপত্তি নাই। আশরাফ বাবাকে জোরে ডেকে উঠানে আসতে বলে। ওমর আলী পেছনে তার তিন পুত্র এবং হাতে একটি পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে উঠানে নামে। অনেকটা গার্ড অব অনারের ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়ায় এবং চারজনে স্লোগান দেয় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ।’ এ সময় এক সঙ্গে তিনজন সৈন্যর হাতের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ঝিমধরা বিকেলের নীরবতাকে ভেঙ্গে দেয়। সেই সঙ্গে ওর স্বপ্নভরা দেশ পাকিস্তানের স্বপ্নও ভেঙ্গে যেতে থাকে। মুহূর্ত আগে আশরাফ এর কাছে কাছাকাছি এমন একটা কিছু কেন যেন মনে হয়েছিল। কিন্তু পাশের সৈন্যটির সাব-মেশিনগানটি কেড়ে নেয়ার কথা ভাবার আগের সেকেন্ডেই প্রথম গুলিটি ওর শিশুপুত্র এবং ওকে একসঙ্গে বিদ্ধ করল। একই সঙ্গে ব্রাশ ফায়ারে, জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শন রত ওর বাবা এবং তিন ভাই নায়েকের সামনে লুটিয়ে পড়েছে প্রবল আর্তনাদে। আর একজন হাবিলদার রান্নাঘরের ভেতরে একটা স্টেনগানের ম্যাগাজিন নিঃশেষ করেছে। ওখান থেকে তিনজন অন্তঃপুরবাসিনীর আর্তনাদটুকুও শোনা গেল না। উপরে আমগাছের শাখা থেকে এক ঝাঁক কাক আর শালিকের দল ডানা ঝটপট করতে করতে উড়ে চলে গেল। গুলি চলছে। আশরাফ উঠোনে পড়ে গেলেও এখনও জ্ঞান হারায়নি। যদিও ইউরিপাইডিস এর দার্শনিক উক্তি, ‘একজন খারাপ মানুষের কাছে উপহারের কোন মূল্য নেই’ একজন সাধারণ সৈন্যের জানার কথা নয় তবুও মনের চোখ ওর খুলে গেছে। আধো বোজা চোখে ওর ঠিক সামনে একজন সৈন্যর বুট সমেত পা দেখতে পাচ্ছে। পুত্রর লাশ ও দেখতে পাচ্ছে না। আরও দেখতে পাচ্ছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। রাখালরা উঠোনের খড় বা ধানের ভেতর অনেক সময় এই জিনিসগুলো রেখে দেয়। দুটো কাস্তের বাট দেখা যাচ্ছে ওর চোখের ঠিক সামনে। আশরাফ একটা কাস্তে তুলে নিল। প্রদীপ নিভে যাবার আগে দপ্ করে জ্বলে উঠে। এই দেশী অস্ত্রটা দিয়ে ও সামনের বুট সমেত দু’পা এর পেছনের মাংসে এক সঙ্গে পোঁচ দিল। গত পাঁচ বছর বাঙালী কোতোয়াল বিশ জন পাঞ্জাবি সৈন্যকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। ওর হাতে এখন সেই অধিনায়কের শক্তি। প্রচ- চিৎকারে সিপাই লস্কর ওয়ালিয়া আশরাফের উপর পড়ে গেল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু ডান হাতে সঞ্চয় করে ও সিপাইটার গলায় কাস্তেটা চালিয়ে দিল। একই সঙ্গে সামনে থেকে একটা স্টেনগানের একরাশ গুলি আশরাফকে ঝাঁঝরা করে দিল। এখন এখানে কোন শব্দ নেই। উঠোনময় সুনসান নীরবতা। উদরভরা মোরগের মাংস, চিতই পিঠা, কাতল মাছ, ভাত, নারিকেল আর রসগোল্লা নিয়ে ক্যাপ্টেন ওয়াসীম নায়েকের দলটি বাড়ির বাইরে নেমে আসতে থাকল। ওয়াসীম, লছমনকে বলল, আচ্ছা, বাঙালী আবার মুসলমানই কি মুসলিম লীগই কি? বল তো। লছমন বলল, হাঁ সাব, আপনে ঠিক বোলা। ওরা বের হয়ে ট্রাকে উঠল। পেছনের উঠোনে পড়ে রইল। একটি প্রত্যাখ্যাত পতাকা। চারটি বিশ্বাসী পুরুষের লাশ। আজ প্রত্যুষ থেকে অভুক্ত তিনজন অন্নপূর্ণার নিষ্প্রাণ দেহ। জন্ম-মৃত্যু বুঝতে পারেনি এমন একটি নিষ্পাপ শিশুর বিচূর্ণ মাথা। একজন মৃত মুক্তিযোদ্ধা। বিশটি ডাবের খোসা এবং অসংখ্য কৃতঘœ বুটের চিহ্ন।
×