ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাগেরহাট ॥ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলি -সুশান্ত মজুমদার

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

বাগেরহাট ॥ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলি  -সুশান্ত মজুমদার

একাত্তর সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড। ৩ ডিসেম্বর এই খবর আমরা পেয়েছিলাম রেডিওর মাধ্যমে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন-কমান্ডের সদর দফতর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীও বাংলাদেশের চারপাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভারতের নবম ডিভিশন এগিয়ে আসে গৌরপুর-জগন্নাথপুর দিয়ে যশোর-ঢাকা মহাসড়কের দিকে। এতে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক হামলা চালাতে থাকে শত্রুবাহিনীর ওপর। শুরু হয়ে যায় জল-স্থল-আকাশ পথে পাকিস্তানীবাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ। বাগেরহাটের নদীর এপারের উত্তরাংশের মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমশ আগুয়ান হয় শহর দখলের উদ্দেশে। আমরা জানতে পারি, যৌথকমান্ড গঠনের সংবাদে বাগেরহাটের সুন্দরবন সাবসেক্টর বেশ প্রভাবিত হয়েছে। এই সাব সেক্টরের কমান্ডার এম. জিয়াউদ্দিন আহমেদ (সম্প্রতি প্রয়াত) এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে প্রতি ক্যাম্প থেকে দশ রাউন্ড করে গুলি আকাশে ছোড়ে। বাগেরহাটের দ্বিতীয় সাবসেক্টর আমাদের চিতলমারী-সন্তোষপুর ক্যাম্পে এমন কোন উল্লাস উত্তেজনা ছিল না। রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরেও খুশি বা বাড়তি কোন জোশ দেখা যায়নি। কারণ, বাগেরহাট শহর রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের বজ্র আঁটুনির মধ্যে। বাগেরহাটের উত্তরাঞ্চলের ব্যাপক এলাকামুক্ত থাকলেও শহরের সম্পূর্ণ দখল ছাড়া আমাদের কোন সুখ ও তৃপ্তি তখন নেই। বাগেরহাটের বর্তমান চিতলমারি উপজেলার সন্তোষপুর স্কুল ভবন, এলাকার তহশিল অফিস ও কয়েকটি বাড়ি নিয়ে ছিল দ্বিতীয় সাবসেক্টর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অনারারি ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম ছিলেন এই সাবসেক্টরের কমান্ডার। শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদের ওপারে উত্তর-পূর্ব গ্রামাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ছিল বিভিন্ন ঘাঁটি। এই অঞ্চলে আগস্ট থেকে নবেম্বর চারমাসে যত যুদ্ধ হয়েছে ডিসেম্বরে এসে কমে যায়। আমরা আলাপ-আলোচনা, স্বাধীন বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণীর মাধ্যমে বুঝতে পারছিলাম বিপুল শক্তি নিয়ে মিত্রবাহিনীর আক্রমণ, ব্যাপক বিমান হামলায় যুদ্ধ ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। ৮ আগস্ট হাবিবুর রহমান হবি, কাজী আমজাদুল হক, রফিকুল ইসলাম খোকন ও মল্লিক শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত একটি দল কচুয়া থানার রাজাকার ও পাকিস্তান মিলিশিয়াদের ঘাঁটি মাধবকাঠি মাদ্রাসা আক্রমণ করে দখল নেয়। ৯ সেপ্টেম্বর প্রায় দুই দিনব্যাপী পানিঘাটের যুদ্ধ হয়। এটাই ছিল বাগেরহাটের দীর্ঘস্থায়ী মুখোমুখি যুদ্ধ। ২৮ অক্টোবর পর পর দুইদিন মুক্ষাইট, পশ্চিমভাগ, কান্দাপাড়ায় যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানের তিনজন সৈন্য ও পাঁচ জন রাজাকার নিহত হয়। মুজাহিদ বাহিনীর এক সদস্য ধরা পড়ে। আমরা এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রচুর গোলাবারুদ। অস্ত্রশস্ত্র দখল করি। ৩০ অক্টোবর বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের পূর্বপ্রান্ত বাবুরহাট বাজারে যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প দখল। পরাজিত শত্রুপক্ষ প্রতিশোধ নিতে বাবুরহাট দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে। এবারও মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে। সুন্দরবন সাবসেক্টরের মুক্তিবাহিনী ৭ ডিসেম্বর শামসুল আলম তালুকদারের নেতৃত্বে প্রায় তিনশত জনের দল শরণখোলা থানার রায়েন্দাতে রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্য রওনা হয়। প্রবাহিত বলেশ্বর নদীর জন্য, পজিশন নেয়ার সুবিধাজনক অবস্থানের অভাব, শত্রুপক্ষের ক্যাম্পের দূরত্ব নির্ভূলভাবে নির্ণয় না করতে পারার জন্য যুদ্ধে গুরুপদ বালা, টিপু সুলতান, শেখ আবদুল আসাদ, সিরাজ, আলতাফ হোসেন। আলাউদ্দিন শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর সাবসেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিন শরীরে তীব্র জ্বর নিয়ে রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্প দখলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুপক্ষের থানা ভবন, ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসসহ ক্যাম্পসমূহের পতন হয়। ৭ ডিসেম্বর মঠবাড়িয়া থানা ও ৮ ডিসেম্বর রায়েন্দা থানা দখলের সংবাদ আমাদের দ্বিতীয় সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারি। তখনও বাগেরহাট শহর রয়েছে রাজাকারদের দুর্ধর্ষ কমান্ডার রজব আলী ফকিরের নিয়ন্ত্রণে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত সরকার কলকাতা পোর্ট কমিশনারের দু’টি লঞ্চ ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। এ দু’টির ছদ্মনাম ছিল ‘ভুলি নাই’ ও ‘মনে রেখো’। ৮ ডিসেম্বর পদ্মাও পলাশ মংলা বন্দর ও খুলনা নৌঘাঁটি দখলের জন্য অভিযান শুরু করে। ১০ ডিসেম্বর সকালে পদ্মা ও পলাশের নৌসেনারা মংলা বন্দর দখল করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বর্তমান পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণে বাগেরহাটের ধোপাখালি ও সন্তোষপুর ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করে। ৩ নবেম্বর দিবাগত রাতে নাজিরপুর থানা আক্রমণ করা হয়। এই যুদ্ধে কমান্ডার সারোয়ার হোসেন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা চিতলমারীর দিকে ফিরে আসার সময় কুমারখালি বাজারের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাটের মোল্লাহাট থানার মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। এই থানায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও ছিল বেশি। আশপাশের জেলায় গিয়ে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। মোল্লাহাট থানার দক্ষিণ-পশ্চিমের চরকুলিয়া বাজারের দক্ষিণে আলিমুদ্দির খালের ব্রিজের গোড়ায় ২৬ অক্টোবরের ঘোরতর যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তান সেনা নিহত হয়। বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের নিহত সৈন্যের সংখ্যা এটাই ছিল সর্বোচ্চ। ৬ ডিসেম্বর মোল্লার কুল হাটে টহলরত রাজাকাদের আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধে রাজাকার নিহত হয়। ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ভারত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে এই স্বীকৃতি আরও আত্মবিশ্বাসী ও রণাঙ্গণে উজ্জীবিত করে তোলে। চারপাশে তখন শুরু হয়েছে পাকিস্তান সেনা ও রাজাকারদের পলায়ন। ডিসেম্বরের ৯ তারিখ মোল্লাহাটের পাঞ্জাবি পুলিশ খুলনার দিকে পালিয়ে যেতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করে। শত্রুরা তখন ভীত হয়ে বরিশালের দিকে পালিয়ে যায়। সুযোগ বুঝে মুক্তিযোদ্ধারা মোল্লাহাটের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। ১০ ডিসেম্বর মোল্লাহাট কলেজ মাঠে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। বাগেরহাটের দ্বিতীয় সাবসেক্টরে ২ ডিসেম্বর অয়্যারলেসে ধরা পড়ে শত্রুপক্ষের একটা বার্তা। কচুয়া থানার প্রতিটি গ্রামে পাহারা জোরদার করা হবে যেন মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকতে না পারে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের কাছাকাছি কচুয়া থানার এলাকা। ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজাকারদের প্রতিরোধ বয়ারশিঙ্গা ও ছিটাবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ৮ জনের একটি গ্রুপ ভাসার বাজারে খালের পাড়ে এ্যাম্বুশ করে। ৩ ডিসেম্বর এই গ্রুপের ভ্রান্ত রণকৌশলের কারণে রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। যুদ্ধে আলফাজ হোসেন ননী, ওমর আবেদ আলী, আতাহার হাওলাদার, আতিয়ার রহমান শহীদ হন। মোহাম্মদ জবেদ আলী ও গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ শুকুর আলী শত্রুর ঘেরাও থেকে পালিয়ে যেতে পারেন। এতজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু আমাদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করে। প্রতিশোধ নিতে আমরা প্রস্তুত হই। ১০ ডিসেম্বর তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কচুয়া বাজারের কাছাকাছি মঘিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের অফিসে অবস্থান নেয়। ১১ ডিসেম্বর রাজাকার ক্যাম্পের চারপাশ থেকে মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। উভয়পক্ষের তুমুল গুলি বিনিময়ের মধ্যে ১২ ডিসেম্বর কচুয়ার রাজকারবাহিনী বাগেরহাট শহরে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন কচুয়া রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাট সবাসেক্টরে মুজিব বাহিনীরও ভূমিকা ছিল। নবেম্বরের শেষের দিকে রামপাল থানার মিঠাখালি ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে অবস্থানরত রাজাকারবাহিনীর সঙ্গে মুজিববাহিনীর যুদ্ধ হয়। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় ১৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। অস্ত্র পাওয়া যায় ২২টি। ১৪ ডিসেম্বর মোসলেম উদ্দিন হাওলাদারের নেতৃত্বে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মুজিববাহিনী মধ্যরাতে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ থানার টাউন স্কুলে প্রবেশ করে। খবর পেয়ে ভীত রাজাকাররা তাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। এলাকার জমিদার বাড়ির ক্যাম্পের রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। ১৫ ডিসেম্বর সকালে মোড়লগঞ্জ থানা রাজাকার মুক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসন থেকে উপমহাদেশ ভেঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট। একদিন পর ১৫ আগস্ট বাগেরহাট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতিহাসের কী পুনরাবৃত্তি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনা ও রাজাকারমুক্ত হয় বাগেরহাট। আমরা বাগেরহাটবাসী বিজয়ের স্বাদ পেয়েছি একদিন বিলম্বে। সন্তোষপুর সাবসেক্টর হেডকোয়ার্টারসহ সামনে পেছনের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আমরা এগিয়ে যেতে যেতে দেখি, বহু জায়গায় গভলি করে রাস্তা কাটা, গ্রাম বিধ্বস্ত প্রান্তর বিরান, ঘরবাড়ি অগ্নিদগ্ধ। আর্মস এ্যাম্বুনেশনসহ হাঁটতে হাঁটতে জেগে ওঠা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পথের দু’পাশের খানকুনির পাতা ছিঁড়ে চিবুতে থাকি। মাথার ওপর শীতার্ত দিনেরনীল আকাশের খাড়া সূর্যের রোদের দাহ, নদলি পাড়ে এসে দাঁড়াতেই হু হু করে আমার কান্না আসে। মুনিগঞ্জের খেয়া পার হয়ে আমরা ফেলে যাওয়া প্রিয় শহরের দখল নিতে যাচ্ছি। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল কমান্ডার সৈয়দ আলীর নেতৃত্বে সুলতানপুর গ্রাম ধরে নদী পার হয়ে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করবে। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার বাংলা ১লা পৌষ ১৩৭৮, দুপুর ২টা ৩৭ মিনিটে বাগেরহাট ডাকবাংলোর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্পের পতন ঘটে। ছাদে উড়িয়ে দেয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
×