ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণ ॥ আমার বিজয় দিবস ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা -শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

স্মরণ ॥ আমার বিজয় দিবস ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা  -শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী

ষোলো ডিসেম্বর আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরে। কিছুতেই পারি না এড়াতে। চেষ্টা করেছি অনেক। ব্যর্থ হয়েছি। চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ছবিগুলো একে একে ভিড় করে। চোখ বন্ধ করলে কী হবে? মনের বিশাল ক্যানভাসে স্থিরচিত্র হয়ে ওরা সেঁটে আছে। সরাতে পারি না। কত ঘটনা কত উত্থানপতনের সাক্ষ্য বহন করে উপনীত হয়েছি শেষ অধ্যায়ে। ভুলে গেছি জীবনযুদ্ধের শত সহ¯্র চালচিত্র কিন্তু বিস্মরণ পারেনি মুছে দিতে আশা-নিরাশার দোলাচলের সেই বিজয়ের দিনকে। পনের ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আভাস পাওয়ায় বাঁধভাঙ্গা আনন্দ মুহূর্তে পরিণত হলো সীমাহীন যন্ত্রণায়। তখন শুনছিলাম রেডিওতে “হাতিয়ার ডাল দো”। ‘আমরা তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি। পালাবার সব পথ রুদ্ধ। আত্মসমর্পণ ছাড়া তোমাদের আর কোন উপায় নেই।’ জেনারেল মানেকশর প্রত্যয়ী ঘোষণা স্বর্গীয় বাণীর মতো মনে হচ্ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানী সেনাদের জলস্থল অন্তরীক্ষের অনুপস্থিতির নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে ভারতীয় মিগের একচেটিয়া বোমাবর্ষণ আমাদের বিজয় ঘোষণা করছিল। আমার স্বামী আলীম, মা এবং আমি দোতলার সামনের বারান্দায় বসে দেখছিলাম পিলখানার বোমাবর্ষণ। আলীম হাসতে হাসতে বললো, ‘আর দেরি নেই বিজয়ের। অথচ মৌলানা মান্নানরা ভাবছে সেভেনথ ফ্লিট এসে ওদের বাঁচাবে। ওরা বোকার স্বর্গে বাস করছে।’ ঠিক তক্ষুণি এলো একটি কাদালেপা মাইক্রোবাস। নিচতলার মান্নানের ইশারায় বন্দুকের মুখে তিন আলবদর আলীমকে তুলে নিলো। ভীতসন্ত্রস্ত আমাকে মান্নান বললো। ‘ঘাবড়াবেন না, আমার আলবদর ছাত্ররা ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে গেছে। ওরা ডাঃ ফজলে রাব্বীকেও নিয়েছে। বোমায় আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য। কাজ শেষ হলেই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।’ সারারাতের দীর্ঘ অপেক্ষার পর এক সময় সকাল হলো। পথ চেয়ে বসেই আছি কখন ফিরবে আলীম। হঠাৎ শুনি চারদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। তাকিয়ে দেখি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে ছাদে ছাদে। আমার লুকিয়ে রাখা পতাকা বের করে টানাবো উঁচু বাঁশের আগায় আর প্রাণখুলে বলবো ‘জয় বাংলা’ আগে আলীম এসে নিক। এক সঙ্গে দু’জন মিলে বহু কাক্সিক্ষত সাধ পূরণ করব। এলো মুক্তিযোদ্ধা কবীর ও ওর বন্ধু হাতে অস্ত্র। বললো, কোথায় সেই মান্নান শয়তান? ওই-ই আলীম ভাইকে মারার জন্য আলবদরদের হাতে তুলে দিয়েছে।আপা, আপনি কাঁদবেন না। আমরা যাচ্ছি। যেখান থেকে পারি সেখান থেকে আলীম ভাইকে নিয়ে আসবো’। ভাবলাম তাই হবে। এখন যুদ্ধ শেষ। আর কেউ আলীমকে আটকে রাখতে পারবে না। পথে নেমে এলাম তাঁর খোঁজে। রাজপথ জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল। সবার হাতে আমাদের প্রাণজুড়ানো বাংলাদেশের পতাকা। মুখে জয়বাংলা আমিও মিশে গেলাম ওদের সাথে। কিন্তু জয়বাংলা বলতে যেয়ে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেলো। কান্নার আওয়াজ বের হলো। মিছিলের মধ্যে আকুল হয়ে খুঁজলাম একটি মুখ। জনে জনে খুঁজে হয়রান হয়ে বাসায় ফিরি। চারদিক লোকে লোকারণ্য। সবার মুখে মুখে শুনি যাদের ধরে নিয়ে গেছে তাদের কেউ বেঁচে নেই। এমন বিজয়ের দিন যে শুধু আমারই ছিল তা নয়। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং তিন লাখ লাঞ্ছিত মা-বোনের জন্যও ছিল একই অনুূভূতি। আমরা শোকে মুহ্যমান হয়েও বিজয়কে বরণ করে নিয়েছি। মনে মনে বারবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়েছি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আমরা সর্বস্ব হারিয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্বল করে সমস্ত শোককে শক্তিতে পরিণত করেছি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সন্তানদের মাঝে সেই চেতনাকে চিরস্থায়ী করে প্রোথিত করে দিতে। সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণাকে জয় করতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছি বলে। এই চেতনার বীজ আমাদের অন্তরের গহীনে বুনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের ভাষণে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে আত্মত্যাগের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। পাকিস্তানের কিছু পদলেহনকারী ছাড়া কারও কখনও মনে হয়নি আমরা কেন জীবন দেব? বরং কিশোর থেকে বৃদ্ধ সকলের চেষ্টা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার। কতো মা নিজেই ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। স্ত্রী ও বোনেরাও একই কাজ করেছেন। প্রায় সংসারেই সক্ষম পুরুষেরা হয় যুদ্ধে গেছেন না হয় গোপনে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাজ করেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদররা সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গেছে বলে পুরো পরিবারকে মেরেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তবু কেউ পিছপা হয়নি। অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। আর তাদের জন্য অর্থ, অস্ত্র, রসদ, নিরাপদ আশ্রয়, চিকিৎসাসহ যাবতীয় সাহায্য করেছেন অবরুদ্ধ এলাকার জনসাধারণ। এমন কোন শহর বা গ্রাম পাওয়া যায়নি যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি ছিল না। ঘরে ঘরে মায়েরা ভাত রেঁধে বসে থাকতেন গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আসবে এই আশায়। পেশাজীবী, ব্যবসায়ীসহ যারাই উপার্জনক্ষম ছিলেন তারাই নিজের প্রয়োজনের অর্থটুকু রেখে বাকি সবটাই দিয়ে দিতেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এমনই ভালবাসা ও আত্মত্যাগের উদাহরণ ছিল বাংলার ঘরে ঘরে। বাঙালীর সেই সুমহান চেতনাকে ধ্বংস করেছেন পাকিস্তানের চর জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫-এর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর শাসনক্ষমতায় বসে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বাঙালীকে মুক্তিযুদ্ধ ভুলিয়ে দেবেন। খুব চতুরতার সাথে পাকিস্তানের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তখনকার স্কুল পর্যায়ের বইগুলোতে ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা। যাবতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধ্যায়গুলো বাদ দিয়ে রাতারাতি পাল্টে দেয়া হলো পাঠ্যবই। সব পর্যায়ে একই পদক্ষেপ নেয়া হলো। স্বাধীনতাবিরোধীদের অফিস আদালতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক বীমা ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র বসিয়ে দেয়া হলো। মূল ক্ষমতাই চলে গেলো স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার দালালদের হাতে। জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরিরাও একই পথে হেঁটেছেন। কোন ব্যতিক্রম করেননি। ত্রিশ বছর চলেছে দেশকে পিছিয়ে নেয়ার এই ষড়যন্ত্র। সেই সময়কার কয়েক জেনারেশন মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত মিথ্যা ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাকে বলে জানে না। কোনো শ্রদ্ধা নেই তাদের বঙ্গবন্ধুর প্রতি, কোন ভালবাসা নেই মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। বীরাঙ্গনা কাকে বলে জানে না। তাদের সন্তানসন্তুতি এখন স্কুলে পড়ে। বাপ-মায়ের মতো ওরাও দেশের এই মহান গৌরব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। মুক্তিযুদ্ধকে ওরা একেবারেই অগ্রাহ্য করে। ওরা বেশিরভাগই ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, মাদ্রাসা এবং জামাতিদের স্কুলে পড়ে। শুধুমাত্র যাদের ঘরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা আছে তাদের সন্তানরা এটি ধারণ করে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা অন্তরে এই চেতনাকে লালন করেছেন। সন্তানদের এই চেতনা দিয়েই বড় করেছেন। ভুলতে দেননি মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। দেশে তাই আজ মোটা দাগের দুটি ভাগ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি শহীদের রক্তে রঞ্জিত। এ মাটি জাতির পিতা, তাঁর পরিবার ও চার জাতীয় নেতার পবিত্র শোণিত ধারায় সিক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশীদের কোন অধিকার নেই এ ভূখন্ডের ওপর। কারণ ওরা এদেশের শত্রু। দেশবাসীকে এই শত্রুদের চিনতে হবে। শহীদের রক্তের ঋণ শোধ তখনই হবে যখন এ দেশে কোন স্বাধীনতাবিরোধী থাকবে না। মনে রাখতে হবে এ দেশটি শুধু তাদের যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, যাদের জীবনযাপন ও চিন্তাচেতনা এর বাইরে যায় না, এ কারণেই বারবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে হবে। আমাদের ভুললে চলবে না একুশ বছর অপশক্তি ক্ষমতায় থেকে এদেশকে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছিল। একথা ঘোষণা না করলেও দেশবাসীর ওই সময়ের জীবনযাপন ঠিক পাকিস্তানী শোষকদের শাসনামলের মতোই ছিল। এক ফোঁটা উন্নতির চিহ্ন কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। দেশ পঞ্চাশ বছর পেছনে হেঁটেছে। গরিবের অর্থ পাচার করে ওরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ যেন হয়েছিল এক মৃত্যু উপত্যকা। পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে শুরু করেছে তখনই যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি এমনই রাষ্ট্রনায়ক যিনি ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে দেশকে মুক্ত করে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে দিতে সফল যাত্রা শুরু করেছেন। বিশ্ব আজ এই অগ্রগতির স্বীকৃতি দিয়ে বারবার নানা পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করছে। যদিও তিনি নিজে কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা কখনও করেন না। তিনি শুধু জানেন কী করে পিতার আদর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তাঁর গড়া এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবেন, কী করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন যা ছিল পিতার আজীবনের স্বপ্ন। দেশবাসীকে আজ নির্ধারণ করতে হবে ত্যাগী জননন্দিত রাষ্ট্রনায়কের হাতে দেশ থাকবে, না মানুষ পুড়িয়ে মারার নিষ্ঠুর শাসকের অধীনে থাকবে। আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি আবার ফিরে যাবো অন্ধকার কলুষময় হাওয়া ভবনের রাজত্বে, না থাকব শহীদের পবিত্র রক্তে গড়া সোনার বাংলার শান্তির নীড়ে। নিজের বিবেককে সবাই প্রশ্ন করুন দুর্নীতিবাজদের ত্যাগ করবেন, না মদদ যোগাবেন, সে যে দলেরই হোক।
×